ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ছোট্ট মাঠে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশ জয়

শাহীন আনোয়ার, মাগুরা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৪৪, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৭:৫৮, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১
ছোট্ট মাঠে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশ জয়

স্কুল শেষে বিদ্যালয়ের এই ছোট্ট মাঠে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশ জয় করেছেন মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার নারী ফুটবলাররা।অবাক করা বিষয় হলো, এ বছর জাপান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনে (মহিলা) মাগুরা জেলা টিমের যে ১২ জন মেয়ে অংশগ্রহণ করে জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন, তাদের ১০ জন একই স্কুলের ছাত্রী। তাদের সবার বাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার একেবারে শেষ সীমান্তে গোয়ালদা ও তার আশেপাশের গ্রামে।

মাত্র সাড়ে ১২ হাজার বর্গফুটের (২৯ শতক) একটি খেলার মাঠ। সেখানেই চলে অনুশীলন। এই ছোট্ট মাঠেই প্রশিক্ষণ নেন একেবারেই অজপাড়াগাঁয়ের হতদরিদ্র পরিবারের মেয়েরা। তাদের কারো বাবা ভ্যান চালক, কারো বাবা ভূমিহীন কৃষক আবার কারো বাবা দিনমজুর। বিস্ময়ের বিষয় হলো এসব মেয়েই এখন দেশের সেরা ফুটবল খেলোয়াড়। 

সরেজমিনে, চর-গোয়ালদা প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে গিয়ে দেখা যায়, মেয়েরা ফুটবল খেলা অনুশীলন করছেন। ওয়ার্মআপের পরে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক কসরত করছেন বিভিন্ন বয়সী মেয়েরা। আর তাদের সাথে মাঠে নেমে ফুটবল খেলার বিভিন্ন ধরনের কলাকৌশল শেখাচ্ছেন তাদেরই প্রশিক্ষক প্রভাষ রঞ্জন দেব জ্যোতি।

আকাশ ছোঁয়া সফলতার নেপথ্যের গল্প শোনার আকাঙ্ক্ষা জানালে প্রভাষ রঞ্জন দেব জ্যোতি বলেন, ২০১৪ সালে হঠাৎ করেই মাথায় আসে বতর্মান সরকার যেহেতু নারীর ক্ষমাতায়নের জন্য অনেক পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তাই স্কুল শেষে বিদ্যালয়ের মেয়েদের ফুটবল খেলার প্রশিক্ষণ দিয়ে আমি মেয়েদের একটি ফুটবল টিম গঠন করবো। সে অনুযায়ী ছাত্রীদের অভিভাবকদের সাথে কথা বলি। তখন সবাই আমার কথায় রাজি হয়ে যান। এর পর থেকেই প্রতিদিন স্কুল শেষে বিদ্যালয়ের এই ছোট্র মাঠেই তাদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করি।

এরপর ছাত্রীদের নিষ্ঠা, কঠোর অনুশীলন আর একাগ্রতার কারণে আমার টিম মাগুরা জেলা দল হিসেবে ২০২০ সালে প্রথম বারের মতো জাতীয় পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু নবম গেমসে অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। এছাড়া জেএফএ (জাপান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন) চ্যাম্পিয়নশিপ-২০২০ এবং ২০২১-এ অংশ নিয়ে আমরা দুইবারই চ্যাম্পিয়ন হই।

তিনি আরও বলেন, যে মেয়েরা আজ দেশ সেরা ফুটবল খেলোয়াড় হিসেবে স্বীকতি ও কৃতিত্ব অর্জন করেছে, তাদের সবার বাড়ি এই গ্রামে। আর এদের প্রত্যেকেই হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। এরা পছন্দসই ভালো মানের খাবারও খেতে পারে না। তাদের কারো বাবা ভ্যান চালক, কারো বাবা ভূমিহীন কৃষক আবার কারো বাবা দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালিয়ে আসছেন।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বর্তমানে আমার টিমে ৫৫ জন ছাত্রী আছে। এদের মধ্যে দুইজন বাদে আর সবাই হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। তাদের সবাই আমার প্রথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আর কয়েকজন আমার বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে পার্শ্ববর্তী চর-মহেশপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। আমার পাঁচজন ছাত্রী বর্তমানে ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) পড়াশোনা করছে।

মুখভরা হাসিতে তিনি বলেন, প্রথমবারের মতো শ্রীপুরের ইউএনও মহোদয় আমাদের ছাত্রীদের আনুষ্ঠানিকভাবে সংবর্ধনা দিয়েছেন, আমরা অত্যন্ত খুশি। সারাদিন স্কুলে পড়িয়ে কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই প্রতিদিন এইসব মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেই। আমি ও আমার সহকারী শিক্ষক মো. শহিদুল ইসলাম পরিকল্পনা করি আমরা এই এলাকার সন্তান। তাই এলাকার শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যদি মানসম্মত ও ভালো খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তুলতে পারি, তাহলে একদিকে যেমন এলাকার সুনাম বৃদ্ধি পাবে, তেমনি এদের দরিদ্র পিতা-মাতা একদিন সুখের মুখ দেখবেন।   

অনুশীলন শেষে এই মাঠে দাঁড়িয়ে কথা হয় এবারের জেএফএ-ফাইনাল খেলায় সবোর্চ্চ গোলদাতা বৃষ্টির সাথে। তিনি  বলেন, আমি প্রভাষ স্যারের ছাত্রী। ছয় বছর ধরে স্যারের কাছে প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। আমি এখন পাশ্ববর্তী মহেশপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। ৫ ম্যাচে সর্বোচ্চ ৭ গোল দিতে পেরে আমি খুশি। 

অনুভূতি জানতে চাইলে গোলদাতা বৃষ্টির বাবা প্রশান্ত মন্ডল বলেন, আমার মনির ঠিকমতো খাবার-পড়বার দিতি পারিনে। আমার মনি যে গোল করিচে, তার জন্যি আমার খুব আনন্দ। প্রভাষ স্যার এইসব মায়েগের (মেয়েদের) জন্যি যা করতিচে, তা ভাষায় প্রআশ (প্রকাশ) করা যায় না।  

ফাইনাল খেলায় অংশ নেওয়া এবারের মাগুরা জেলা টিমের ক্যাপ্টেন অর্পিতা বিশ্বাস বললেন, প্রতিদিন স্কুল শেষে প্রভাষ স্যার বিনা পারিশ্রমিকে আমাদের এই মাঠে প্রশিক্ষণ দেন। স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞ। আমি বর্তমানে বিকেএসপি’র সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী।

অনুশীলনে ব্যস্ত এই বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির ছাত্রী কুলসম খাতুন বলেন, প্রায় তিন বছর ধরে স্যার আমাকে ফুটবল খেলা শেখাচ্ছেন। আমিও ভবিয্যতে জাতীয় পর্যায়ে অনূর্ধ্ব-১৪ তে খেলতে চাই।      

উল্লেখ্য , গত ৯ সেপ্টেম্বর রাজশাহী মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় জেএফএ (জাপান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন) অনূর্ধ্ব-১৪ চ্যাম্পিয়নশিপ-২০২১-এর ফাইনাল খেলা। আর এই ফাইনাল খেলায় দুই-শূন্য (২-০) গোলে রাজশাহী জেলা দলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন শিরোপা অর্জন করে মাগুরা জেলা দল। আর এই দলের ১২ জন খেলোয়াড়ের ১০ জনই মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার চর-গোয়ালদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থী। এদের প্রশিক্ষক সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রভাষ রঞ্জন দেব জ্যোতি।

শ্রীপুর উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার রবিউল ইসলাম বলেন, ফাইনালে জয় লাভ করে আমাদের উপজেলার সাধারণ মেয়েরা সারা জেলার মুখ উজ্জল করেছে।

শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) লিউজা-উজ-জান্নাহ এই ফুটবল টিমের প্রশিক্ষক শ্রীপুর উপজেলার গোয়ালদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক প্রভাষ রঞ্জন দেব জ্যোতিকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এবার আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের সংবর্ধনা দিতে পেরে নিজকে ধন্য মনে করছি। জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় খেলোয়াড়দের জন্য জেলা প্রশাসক মহোদয় ১ লাখ টাকা আর বিভাগীয় কমিশনার মহোদয় ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।

মাগুরার জেলা প্রশাসক ড. আশরাফুল আলম বলেন, জেলা টিম চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় জেলা প্রশাসক হিসেবে আমি গর্বিত। এসব মেয়ের প্রয়োজন অনুসারে সব ধরনের সাপোর্ট দেওয়া হবে। ভবিষ্যতে তাদের একটি ফান্ড করে দেওয়া যায় কিনা ভাবছি।

/মাহি/   

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়