ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

সবজির চারায় কৃষকদের দিনবদল

এইচ মাহমুদ, নরসিংদী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৭, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১   আপডেট: ১১:৫৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১
সবজির চারায় কৃষকদের দিনবদল

নরসিংদীতে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হচ্ছে সবজির চারা। উৎপাদিত এ চারা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। বিক্রি করে ইতোমধ্যে অনেক কৃষকেরই দিনবদল হয়েছে।

এ জেলার সবজির খ্যাতি দেশজুড়ে। সবচেয়ে বেশি সবজি হয় শিবপুর উপজেলায়। তবে ভালো ফলন চাইলে প্রথমে প্রয়োজন ভালো বীজতলা। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে উপজেলার বাঘাব ইউনিয়নের ৫/৬টি গ্রামে গড়ে উঠেছে সবজি চারা উৎপাদনের নার্সারি। সর্বমহলের কাছে বিশেষ পরিচিত হয়ে উঠেছে এখানকার চারা।

সব রকমের মৌসুমি ও আগাম সবজির চারার উৎপাদন করা হয় এখানে। উৎপাদনে নিয়োজিত রয়েছেন এই এলাকার প্রায় দুই থেকে তিন শতাধিক কৃষক। এসব চারার গুণগত মান ভালো হওয়ায় দেশের বিভিন্ন জেলার কৃষকদের মাঝেও রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। লাভজনক হওয়ায় দিন দিন বাড়ছে উৎপাদনকারী কৃষকের সংখ্যাও।

কৃষকরা জানান, শিবপুর তথা নরসিংদীর স্থানীয় কৃষকরা একসময় মুন্সিগঞ্জ থেকে সবজির চারা কিনে চাষ করতেন। কিন্তু নিজেদের প্রয়োজনীয় চাহিদার কথা ভেবে আজ থেকে দীর্ঘ দুই যুগ আগে এ চারা উৎপাদন শুরু করেন এখানকার কৃষকরা। এরপর থেকে ধীরে ধীরে এলাকাটি চারা উৎপাদনের জন্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এখন প্রায় ৪০ বিঘার বেশি জমিতে এ চারা উৎপাদন করা হয়। বাজার মূল্যে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার উপরে। এই চারা বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন শুধু বাঘাব ইউনিয়নেরই দুই শতাধিকেরও বেশি কৃষক।

স্থানীয় কৃষকরা জানান, ভালো ফলন পেতে হলে ভালো জাতের চারা হওয়া চাই। আর ভালো ফলনের চারা মানেই শিবপুর উপজেলার বাঘাব ইউনিয়নের চারা। এই ইউনিয়নের কুন্দারপাড়া, গাংপাড়া, খড়কমারা, ব্রাহ্মন্দী, লামপুর, নাওহালা ও বংপুর এলাকার উৎপাদিত সবজির চারার রয়েছে সুনাম। এখানকার কৃষকরা বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মরিচ, লাউ, শসা, টমেটো, পেঁপে, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, শালগম, করলাসহ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিভিন্ন ধরনের উচ্চ ফলনশীল সবজির চারা উৎপাদন করে থাকেন।

চলতি মৌসুমের আগস্ট থেকে ডিসেম্বরে প্রতিবছর এই সময় বদলে যায় এ এলাকার চিত্র। ভোরের আলো উঠার সঙ্গে সঙ্গেই মাঠে পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন কৃষকরা। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বর মাসজুড়ে চারা উৎপাদন ও বিক্রি চলে। পলিথিনে মোড়ানো শেড করে ৪ থেকে ৫ বার পর্যন্ত বীজ অঙ্কুরোদগমের মাধ্যমে চারা উৎপাদন করে বিক্রি করতে পারেন তারা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শিবপুর উপজেলার কুন্দারপাড়া বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকার মাঠজুড়ে পলিথিনে মোড়ানো বীজতলা। এখানে কৃষকরা নিরানিসহ বিভিন্ন উপায়ে পরিচর্যা করছেন। বিভিন্ন জেলা থেকে লোকজনও আসছেন চারা কেনার জন্য। অনেক চাষি চারা তুলছেন বিক্রয়ের জন্য। কেউ কেউ বীজতলার উপরের পলিথিন খুলে উন্মুক্ত করে দিচ্ছেন। আবার কেউ আগাছা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

এসময় কথা হয় সবজির চারা উৎপাদনকারী কৃষকের সঙ্গে। তারা জানান, মৌসুমের আষাঢ় মাস থেকে বীজতলা প্রস্তুত করে বাঁধাকপি, ফুলকপি, বেগুন, মরিচ ও টমেটোর বীজ বপন করেন। ওই বীজ অঙ্কুরোদগমের মাধ্যমে চারা গজালে তা পরিচর্যা করে একমাস বয়সে তুলে অন্য কৃষকদের কাছে বিক্রি করেন। পরবর্তী সময়ে ওই চারা কৃষকরা কিনে অন্তত তিন মাস পরিচর্যা করে ফলন বিক্রির উপযোগী করে তোলেন।

তারা আরও জানান, ভালো মানের প্রতিটি ফুলকপির চারা ৮০ পয়সা থেকে ১ টাকা এবং বাঁধাকপির চারা মানভেদে ৬০ থেকে ৮০ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিবিঘা জমিতে ফুলকপির বীজ বপন করে চারা উৎপাদন পর্যন্ত অন্তত এক লাখ টাকা ব্যয় হয়। তবে এতে ৩ লক্ষাধিক চারা উৎপাদন করে আনুষঙ্গিক খরচ বাদেও কমপক্ষে ২ লাখ টাকার বেশি বিক্রি হয়। তাদের উৎপাদিত সবজির চারা নরসিংদী জেলাসহ পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে কৃষকরা এসে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। প্রতিদিন এখানে নরসিংদী জেলাসহ সিলেট, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী, চাঁদপুর, বি-বাড়িয়া, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, গাজীপুর ও টাঙ্গাইল এলাকার কৃষকরা সবজি চারা ক্রয় করতে আসেন।

কুন্দারপাড়া এলাকার সবজির উৎপাদনকারী শওকত আলী বলেন, আমি বিগত ২৫ বছর ধরে এ ব্যবসা করে আসছি। চারা বিক্রি করে ভালো আছি। আমি ৩৫ শতাংশ জমিতে চারা উৎপাদন এবং বিক্রি করে প্রতি বছর লাখ দুয়েক টাকা আয় করতে পারছি। আমাদের এখানে এখন ৪০ বিঘার জমির উপরে প্রায় দুই শতাধিক কৃষক চারা উৎপাদন করছেন। এখান থেকে বছরে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার উপরে চারা বেচাকেনা হয়।

একই এলাকার কৃষক দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমি বিগত ২০ বছর ধরে বিভিন্ন প্রকার সবজির চারা উৎপাদন করে আসছি। এ বছর ১ বিঘা জমিতে সবজির চারা উৎপাদন করতে বীজতলা তৈরি করছি। কোনো রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এখান থেকে আমি ৩ লাখ টাকা লাভ করতে পারবো বলে আশা করছি।

নাওহালা এলাকার সবজির চারা উৎপাদনকারী আতাউর রহমান জানান, তিনি এ বছর ৪০ শতাংশ জমিতে বেগুন, মরিচ, কপি, টমেটো, শালগমসহ বিভিন্ন সবজির চারা উৎপাদন করছেন। এতে তার খরচ হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। ঝড়-বৃষ্টি যদি তেমন একটা ক্ষতি না করে, তাহলে তিনি ৫ লাখ টাকা বিক্রি করতে পারবেন।

সবজির চারা ক্রেতারা বলেন, একসময় আমরা মুন্সিগঞ্জ থেকে সবজির চারা কিনে চাষ করতার। এখন প্রতিবছর এ কুন্দারপাড়া থেকে চারা কিনি। এখানের সবজির চারার মান ভালো। রোপণ করে আশানুরূপ ফলন পেয়েছি। 

বাঘাব ইউনিয়নের কৃষি উপসহকারী কর্মকর্তা জোসনা বেগম বলেন, সবজির চারা উৎপাদন করা নার্সারি একটি লাভজনক ব্যবসা। তাই এ বাঘাবা ইউনিয়নেই ৫/৬টি গ্রামের প্রায় দুই-তিন শত কৃষক এ সবজির চারা উৎপাদন করেন। আমরা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে তাদের বিভিন্ন প্রযুক্তি সম্পর্কে পরামর্শ দিয়ে থাকি।

শিবপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিন সাদেক বলেন, এ উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে প্রায় ৬ হেক্টর জমিতে সবজির চারা উৎপাদন করা হয়। চারা উৎপাদন করে নিজেদের জমিতে রোপণের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি অন্যত্র বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে এখানকার কৃষকরা। তাই আমাদের কৃষি অফিস তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সবজির চারা উৎপাদন বাড়াতে প্রতি বছরই কৃষকদের দক্ষতা অর্জনে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।

/মাহি/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়