ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০২ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৯ ১৪৩১

উচ্চ রক্তচাপ নীরব ঘাতক, প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:১৭, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২  
উচ্চ রক্তচাপ নীরব ঘাতক, প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ

উচ্চ রক্তচাপকে এক ধরনের নীরব ঘাতক বলা হয়ে থাকে, কারণ খুব সহজে এর উপসর্গ বোঝা যায় না, কিন্তু নীরবে হৃৎপিণ্ডের ক্ষতিসাধন করে থাকে।

অধিকাংশ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন কিন্তু অনেকেই প্রথমে তাদের এই রোগটা ধরতে পারেন না। কিন্তু যখন বুঝতে পারেন তখন হার্ট-অ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) বলছে, উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগে থাকেন বিশ্বের প্রায় ১৫০ কোটি মানুষ। আর এই সমস্যায় সারা বিশ্বে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ প্রতি বছর মারা যায়।

চলতি বছরের জুলাই মাসে ‘বাংলাদেশ হাইপারটেনশন কন্ট্রোল ইনিশিয়েটিভস’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীদের ৬৫ শতাংশ এখনো চিকিৎসাসেবার আওতার বাইরে। এর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মাত্র ১৪ শতাংশ রোগীর। অর্থাৎ ৮৬ শতাংশ রোগী তাদের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন না। শুধু তাই নয়, দেশের মোট দুই কোটি ২০ লাখ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত থাকলেও তাদের ৫১ শতাংশই এখনো শনাক্তের বাইরে রয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (এনসিডিসি) এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের যৌথ পরিচালনায় উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির বার্ষিক বাস্তবায়ন খরচ নির্ণয়ে ব্যবহৃত হার্টস কস্টিং টুল নামের একটি অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে এসব তথ্য জানা গেছে বলে অনুষ্ঠানে জানানো হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এনসিডিসি প্রোগ্রাম, প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান), ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ, গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর (জিএইচএআই) ও রিজলভ টু সেভ লাইভস এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তারা জানায়, বছরে রোগী প্রতি মাত্র ৯ ডলার (প্রতি ডলার ৯৪ টাকা হিসাবে ৮৪৬ টাকা) খরচ করেই সারাদেশে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশনের মানসম্মত চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত নতুন এক গবেষণার তথ্যের বরাত দিয়ে বলা হয়, হৃদরোগ, স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক ঝুঁকির প্রধান কারণ উচ্চ রক্তচাপ, যা প্রতিরোধযোগ্য।

উচ্চ রক্তচাপ কী?

হৃৎপিণ্ডের ধমনীতে রক্ত প্রবাহের চাপ অনেক বেশি থাকলে সেটিকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেশার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। দুটি মানের মাধ্যমে এই রক্তচাপ রেকর্ড করা হয়- যেটার সংখ্যা বেশি সেটাকে বলা হয় সিস্টোলিক প্রেশার, আর যেটার সংখ্যা কম সেটা ডায়াস্টলিক প্রেশার। প্রতিটি হৃৎস্পন্দন অর্থাৎ হৃদপিণ্ডের সংকোচন ও সম্প্রসারণের সময় একবার সিস্টোলিক প্রেশার এবং একবার ডায়াস্টলিক প্রেশার হয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের রক্তচাপ থাকে ১২০/৮০ মিলিমিটার মার্কারি। কারও ব্লাড প্রেশার রিডিং যদি ১৪০/৯০ বা এর চেয়েও বেশি হয়, তখন বুঝতে হবে তার উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা আছে। অন্যদিকে রক্তচাপ যদি ৯০/৬০ বা এর আশেপাশে থাকে, তাহলে তাকে লো ব্লাড প্রেশার হিসেবে ধরা হয়। যদিও বয়স নির্বিশেষে রক্তচাপ খানিকটা বেশি বা কম হতে পারে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি অঙ্গে জটিলতা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

কী সমস্যা তৈরি হয়?

অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ থেকে হৃদযন্ত্রের পেশি দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এর ফলে দুর্বল হৃদযন্ত্র রক্ত পাম্প করতে না পারায় ব্যক্তির হৃদপিণ্ড কাজ বন্ধ করতে পারে বা হার্ট ফেল করতে পারে। এছাড়া, এমন সময় রক্তনালীর দেয়াল সংকুচিত হয়ে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কাও থাকে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনি নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি থাকে, মস্তিষ্কে স্ট্রোক বা রক্তক্ষরণও হতে পারে। এরকম ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। এছাড়া বিশেষ ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কারণে রেটিনায় রক্তক্ষরণ হয়ে একজন মানুষ অন্ধত্বও বরণ করতে পারেন।

লক্ষণ

উচ্চ রক্তচাপের একেবারে সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ সেভাবে প্রকাশ পায় না। তবে সাধারণ কিছু লক্ষণের মধ্যে রয়েছে- তীব্র মাথাব্যথা করা, মাথা গরম হয়ে যাওয়া এবং মাথা ঘোরানো। ঘাড়ব্যথা করা, বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া, অল্পতেই রেগে যাওয়া বা অস্থির হয়ে শরীর কাঁপতে থাকা, রাতে ভালো ঘুম না হওয়া, মাঝে মাঝে কানে শব্দ হওয়া, অনেক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলা। 

কিছু কার্যক্রমের সুফল পাওয়া যাচ্ছে

বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য বিষয়ক অলাভজনক সংস্থা রিজলভ টু সেভ লাইভসের সহযোগিতায় ২০১৮ সাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে এনসিডিসি এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ যৌথভাবে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যার উদ্দেশ্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত করা, চিকিৎসা দেওয়া এবং ফলোআপ কার্যক্রম শক্তিশালী করা। সফল এই প্রাথমিক প্রকল্পটি আরও সম্প্রসারণ করা হলে দেশে স্বল্প খরচেই হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনি বিকল হওয়ার মতো ব্যয়বহুল রোগ প্রতিরোধের মাধ্যমে অসংখ্য জীবন বাঁচানো যাবে।

রিজলভ টু সেভ লাইভসের প্রেসিডেন্ট ও সিইও এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) সাবেক পরিচালক ডা. টম ফ্রিইডেন বলেন, বাংলাদেশে প্রতি পাঁচ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজনের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের উচ্চ রক্তচাপজনিত চিকিৎসা দেওয়ার জন্য সরকারের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নেওয়া হলে অসংখ্য জীবন বাঁচানোসহ হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

তিনি বলেন, সাধারণ ওষুধের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলেও, বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র ৪৯ শতাংশের উচ্চ রক্তচাপ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। তাদের মাত্র ৩৫ শতাংশ চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন এবং ১৪ শতাংশ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছেন।

এনসিডিসি ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের যৌথ পরিচালনায় উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি এরই মধ্যে দেশের ৫১টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সফলভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এই কর্মসূচির আওতায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হাটর্স টেকনিক্যাল প্যাকেজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রোগীদের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের সেবা দেওয়া হচ্ছে। কর্মসূচির আওতায় চিকিৎসার জন্য এ পর্যন্ত নিবন্ধিত ১ লাখ রোগীর মধ্যে ৫৮ শতাংশই উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছেন।

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির বার্ষিক বাস্তবায়ন খরচ নির্ণয়ে ব্যবহৃত হার্টস কস্টিং টুল নামের একটি অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে এই গবেষণায় সুপারিশ করা হয়েছে যে, ডাক্তার ও এই সেবায় যুক্ত অন্যদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগাভাগি (টাস্ক-শেয়ারিং) নিশ্চিত করা, টাস্ক-শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে পুরো প্রক্রিয়ায় স্থানীয় কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মীদের আরও বেশি সম্পৃক্ত করা এবং গুণগত মান ঠিক রেখে প্রতি ইউনিট ওষুধের দাম আরও কমিয়ে আনা গেলে হার্টস প্যাকেজ বাস্তবায়ন আরও বেশি সাশ্রয়ী হবে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের ভূমিকা আরও বাড়ানো হলে বিপুল অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব।

প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ ক্রমবর্ধমান। এই সংকট মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতসহ সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংস্থা, গণমাধ্যম সবাইকেই সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।’

বয়স্ক জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত নগরায়ন, শারীরিক পরিশ্রম অত্যন্ত কম এমন জীবনাচরণ, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য গ্রহণ এবং অন্যান্য আর্থ-সামাজিক ও জীবনযাত্রা সম্পর্কিত বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপের বোঝা আগামী বছরগুলোতে বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প সম্প্রসারণ করা হলে অল্প ব্যয়ে অনেক জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে।

হাসান/ফিরোজ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়