ঢাকা     মঙ্গলবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৭ ১৪৩১

বয়ঃসন্ধিকালে পরিবার ও সামাজিক শিক্ষায় গুরুত্বের পরামর্শ 

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২৬, ২৯ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৫:২৭, ২৯ জানুয়ারি ২০২১
বয়ঃসন্ধিকালে পরিবার ও সামাজিক শিক্ষায় গুরুত্বের পরামর্শ 

প্রতীকী ছবি

রাজধানীর কলাবাগানে ছেলে বন্ধুর বাসায় গিয়ে এক স্কুলছাত্রীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সারা দেশে আলোচনা হচ্ছে কিশোর-কিশোরীদের সম্পর্ক বিষয়ে।  কেন এমন হচ্ছে, এসব ঘটনার পেছনে কী কারণ, এর প্রতিকারই বা কী- এসব বিষয় নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন তৈরি করেছেন রাইজিংবিডির জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেসবাহ য়াযাদ। আজ পড়ুন এর দ্বিতীয় পর্ব।

দেশে দিন দিন কিশোর অপরাধ বেড়েই চলেছে।  হত্যা, আত্মহত্যা, ধর্ষণ, মাদক, ইভটিজিংসহ ভয়াবহ সব ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে।  বিষয়টি সমাজবিজ্ঞানী, অপরাধবিজ্ঞানী, আইনবিদ, রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলছে।

শিশু-কিশোরদের অপরাধের অন্যতম কারণ মনস্তাত্ত্বিক। বয়ঃসন্ধিপ্রাপ্ত ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সহনশীলতার অভাব দেখা যায়।  অপরিণত আবেগ বৃদ্ধি পায়।  এদের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে বাধা আসলেই সহনশীলতার অভাব ঘটে।  এই বিপর্যয়ই অনেক অঘটনের মূল। এদের পরিবার বা স্কুল-কলেজ থেকে আমরা অনেক কিছুই ঠিকমতো শেখাই না।  ফলে বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে তারা সেভাবে সচেতন হয়ে উঠতে পারে না। জীবনে সবকিছু পাওয়া যায় না। পাওয়া আর না পাওয়ার বিষয়টা যে জীবনেরই একটা অংশ, সেটাও আমরা তাদের শেখাই না।  এই দায় পরিবার, সমাজ, শিক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষক সবার।

দেখা যায়, কোনো কোনো ছেলে-মেয়ে কিশোর বয়সেই মিথ্যেবাদী হয়ে উঠে। মিথ্যার ওপর ভিত্তি করেই তাদের জীবন গড়ে উঠে। এরা অবাস্তব স্বপ্ন দেখে। বাবা-মায়ের সঙ্গে মানসিক বিভেদ, বাড়িতে অশান্তি, এসব যত বাড়তে থাকে ততই এদের মিথ্যাচারও বাড়তে থাকে।  এক সময় এরা জেদী, রাগী, একগুঁয়ে, সন্দেহপ্রবণ হয়ে এমন পর্যায়ে চলে যায় যে, শেষ পর্যন্ত জীবনবিমুখ হয়ে পড়ে।  জীবনের সব আনন্দ, স্পৃহা, উৎসাহ থেকে দূরে চলে যায় এরা।

এসব কিশোর-কিশোরীদের অপরাধী হওয়ার নেপথ্যে কিছু স্বভাবগত কারণ রয়েছে।  পরিবারের সদস্যদের কাছে পাওয়া নির্দয় ব্যবহার, অতিরিক্ত অবাধ্যতা, স্কুল-পালানো, দেরি করে ঘরে ফেরা, অনিয়মিত খাওয়া-দাওয়া, অপরিষ্কার আর নোংরা পোশাক পরা, শারীরিক অপরিচ্ছন্নতা, দুঃসাহসিকতা, অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়তা এবং অতিমাত্রায় ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস আসক্তিও অন্যতম কারণ।

এ বিষয়ে গৃহিনী শারমীন জাহান শাম্মী বলেন, সমাজের অবক্ষয় রোধে এসব বিষয় নিয়ে মা, বাবা, শিক্ষক,আত্মীয় সবারই ভাবা উচিৎ।  মায়ের ভূমিকা সর্বোচ্চ, তারপর বাবা। সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে প্রয়োজনীয় শাসন করলে সন্তান অনেকটাই দায়িত্বশীল হবে।  মাঝে মাঝে পারিবারিক আড্ডা, মজার ছলে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করা উচিৎ।  প্রায় বাবা-মা সন্তানের সঙ্গে দুরত্ব রেখে চলেন।  এতে ওরা মনে করে বাবা মা শুধু শাসন করে, ভালোবাসে না।  সন্তান কাদের সঙ্গে মেশে, কোথায় যায় সে ব্যাপারেও খেয়াল রাখতে হবে কৌশলে।  পরিবারের পর স্কুল, কলেজের শিক্ষকদের ও ভূমিকা আছে।

মনোবিজ্ঞানী ডা. মোহিত কামাল বলেন, কোনো কোনো মা-বাবা দুজনই চাকরি করেন। এদের সন্তান উপযুক্ত স্নেহ-শাসন থেকে বঞ্চিত হয়।  অনেক ক্ষেত্রেই তারা আচরণে বিদ্রোহধর্মী হয়ে পড়ে।  আবার মৃত্যু বা বিবাহ বিচ্ছেদের কারণেও কেউ কেউ মা অথবা বাবাকে হারায়।  এমন সব কারণেও কিশোরদের স্বাভাবিক বিকাশে সমস্যা দেখা দেয়।  তারা সমাজবিরোধী কাজকর্মে লিপ্ত হয়।  যৌথ পরিবারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সংস্কৃতির কারণে অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা মানসিক দিক থেকে অনেক সুখী ছিলাম।  কিন্তু বর্তমানে সময়ের প্রয়োজনে আর নানা কারণে যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়ায় সে সুখের জায়গায় চিড় ধরেছে।  পারিবারিক বন্ধনগুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে।  এর শিকার হচ্ছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এনায়েত করিম বলেন, কিছু ক্ষেত্রে মাতা-পিতার কারণেও সন্তানরা অপরাধী হয়ে উঠে।  বাবা-মা সঠিকভাবে সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণ না করে অনেক সময় সংসারত্যাগী হন। সন্তান তাদের স্নেহ-মমতা থেকে বঞ্চিত হয়ে বেড়ে উঠে। অনেক বাবা-মা আবার সন্তানকে পাপের মধ্যে রেখে বড় করেন।  কখনো বা সন্তানকে দিয়েও পাপ কাজ করান।  কেউ কেউ সন্তানের অপকর্মে সহায়তা করেন, উৎসাহ দেন।  আবার কেউ কেউ নির্বিচারে সন্তানের সামনেই নানা অসামাজিক কাজ করেন ও বিশ্রি ভাষায় কথা বলেন।  সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে যে অবক্ষয় ঘটছে, তারই প্রভাবে শিশু-কিশোর অপরাধ বাড়ছে।

তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের সিনিয়র সচিব এন.এম.জিয়াউল আলম বলেন, কিশোর অপরাধের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী আকাশ সংস্কৃতি এবং অনলাইন প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব। আকাশ সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ না করলে কিশোর অপরাধ দমন করা কঠিন এবং অসম্ভব।
 

ইন্টারন্যাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা.সিয়াম সাদ্দাম ভূঁইয়া বলেন, বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে ও মেয়ে উভয়ের শরীর ও মনে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটে। এ সময় ছেলে-মেয়েরা যেমন দ্রুত বেড়ে উঠতে থাকে, তেমনি তাদের চিন্তা চেতনায় দেখা দেয় ব্যাপক পরিবর্তন।  এই অবস্থায় পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানেরও কৌশলী ভূমিকা পালন করতে হবে।

মেসবাহ/সাইফ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়