‘দিন-তারিখ পাল্টায়, বিচার তো পাই না’
হুমায়ুন আজাদ (ফাইল ফটো)
‘ভাইকে হারিয়েছি ১৭ বছর আগে। দিন, তারিখ, যুগ পাল্টায়; কিন্তু এখনও তো বিচার পাই না। তাকে হারিয়ে পুরো পরিবার কঠিন সময় পার করছি।’
এসব কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ভাই মঞ্জুর কবির। এত দিনেও হুমায়ুন আজাদ হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে দুর্বৃত্তদের হামলায় গুরুতর আহত হন হুমায়ুন আজাদ। ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ২২ দিন এবং ব্যাংককে ৪৮ দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। ২০০৪ সালের ১২ আগস্ট জার্মানির মিউনিখে মারা যান হুমায়ুন আজাদ।
হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার পরদিন তার ভাই মঞ্জুর কবির বাদী হয়ে রাজধানীর রমনা থানায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন। হুমায়ুন আজাদ মারা যাওয়ায় তা হত্যা মামলায় রূপান্তর হয়। ১৭ বছর ধরে ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক সাজার অপেক্ষায় হুমায়ুন আজাদের স্বজনরা।
এদিকে, শিগগির হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলার বিচার হবে বলে আশা করছে রাষ্ট্রপক্ষ।
হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলা ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মাকছুদা পারভীনের আদালতে বিচারাধীন। এ মামলায় গত ১৮ জানুয়ারি চার আসামির সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর আসামিপক্ষ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে। আগামী ৪ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষের আইনগত বিষয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের তারিখ ধার্য রয়েছে। হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলার ঘটনায় দায়ের করা বিস্ফোরক আইনের মামলায় গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্যের তারিখ ধার্য ছিল। ওই দিন একজন সাক্ষ্য দেন। আগামী ১২ এপ্রিল এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ধার্য আছে।
মামলা সম্পর্কে মো. মঞ্জুর কবির বলেন, ‘ভাইকে হারানোর ১৭ বছর হয়ে গেল। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিচার পাইনি। বিচারের জন্য আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে? ৫ বছর আগে ব্লগার অভিজিত, প্রকাশক দীপন হত্যার শিকার হয়েছেন। সেসব হত্যার বিচার হলো। কিন্তু ১৭ বছরেও ভাই হত্যার বিচার পেলাম না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাস এলে অসুস্থ হয়ে পড়ি। কঠিনভাবে ভাইয়ের অভাব অনুভব করি। তার অভাব তো পূরণ হবে না। ভাইকে হারিয়েছি, তাকে তো আর ফিরে পাবো না, বরং ভাই হত্যার বিচার চাই। তবে আশা করব, প্রকৃত দোষীরা যেন সাজা পায়।’
মঞ্জুর কবির বলেন, ‘হামলার পর আমার ভাই তো মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিল। তখন তিনি জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে হামলার জন্য দায়ী করেছিলেন। কিন্তু তাকে তো মামলায় সম্পৃক্ত করা হয়নি, আটক করা হয়নি। কী আশা করতে পারি আমরা?’
সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর বিপুল দেবনাথ বলেন, ‘আসামিপক্ষের আইনজীবীদের গাফিলতির কারণে মামলাটির বিচার এতদিনেও শেষ হয়নি। তারা মামলার বিচার বিলম্বিরত করছে। তবে হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়া প্রায় শেষের পর্যায়ে। আশা করি, মার্চ মাস নাগাদ মামলাটির রায় ঘোষণা হবে। রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছে। আশা করছি, তাদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড হবে। এরপর আমরা বিস্ফোরক আইনের মামলাতেও সাক্ষীদের হাজির করে যত দ্রুত সম্ভব মামলাটির বিচার শেষ করব।’
আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, ‘ন্যায়বিচার পাওয়া সবার অধিকার। মামলাগুলোতে দীর্ঘদিনেও বিচার শেষ হয়নি। হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি।’ আসামিরা খালাস পাবেন বলে আশা করছেন তিনি।
হুয়ায়ুন আজাদের ওপর হামলায় ঘটনায় তার ভাইয়ের দায়ের করা মামলাটি তদন্ত করে ২০০৭ সালের ১৪ নভেম্বর সিআইডির পুলিশ কাজী আবদুল মালেক পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি চার্জশিট দাখিল করেন।
২০১২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর হত্যা মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন আদালত। এ মামলায় মোট ৪১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। আত্মপক্ষ শুনানি শেষে মামলাটি যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর্যায়ে আছে।
অন্যদিকে, বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় ২০০৯ সালের ৭ অক্টোবর আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন আদালত। মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে আছে। এ মামলায় ৪৯ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ১৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। মামলাটিতে ২০০৭ সালের ১৪ নভেম্বর হত্যাচেষ্টার অভিযোগে জেএমবি নেতা শায়খ আব্দুর রহমান, আতাউর রহমান সানি, নূর মোহাম্মদ সাবু ওরফে শামীম, মিনহাজ ওরফে শফিক, আনোয়ার ওরফে ভাগ্নে শহিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। ঝালকাঠির বিচারক হত্যা মামলায় শায়খ আব্দুর রহমান ও আতাউর রহমান সানির মৃত্যুদণ্ড হওয়ায় তাদের অব্যাহতি দিয়ে অপর আসামিদের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি চার্জ গঠন করেন ঢাকা সিএমএম আদালত। এরপর মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে বাদী মামলাটির বর্ধিত তদন্তের আবেদন করেন।
২০১২ সালের ৩০ এপ্রিল সিআইডি’র পরিদর্শক লুৎফর রহমান পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার পরিবর্তে হত্যার অভিযোগে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। তারা হলেন—জেএমবির শুরা সদস্য আনোয়ারুল আলম ওরফে ভাগ্নে শহিদ, সালাহউদ্দিন ওরফে সালেহীন, মিজানুর রহমান ওরফে মিনহাজ ওরফে শাওন, রাকিবুল হাসান ওরফে হাফিজ মাহামুদ ও নুর মোহাম্মদ ওরফে সাবু।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রিজন ভ্যান থেকে তিন আসামি ছিনিয়ে নেয় জঙ্গীরা। ওই তিনজনের মধ্যে সালাহউদ্দিন ওরফে সালেহীন এবং রাকিবুল হাসান ওরফে হাফিজ মাহামুদ এ মামলার আসামি। এদের মধ্যে রাকিব ওই দিন রাতে ধরা পড়ে এবং পরে ক্রস ফায়ারে নিহত হয়। মিজানুর রহমান এবং আনোয়ারুল আলম কারাগারে আছে। নুর মোহাম্মদ এবং সালেহীন পলাতক।
মামুন/রফিক
আরো পড়ুন