ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

হাসপাতালের মেঝেতেও ডেঙ্গুরোগী

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:৪৭, ২৩ অক্টোবর ২০২২   আপডেট: ২২:৫৬, ২৩ অক্টোবর ২০২২
হাসপাতালের মেঝেতেও ডেঙ্গুরোগী

ছবি: সংগৃহীত

প্রতিদিনই সারাদেশে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুও। শিগগিরেই ডেঙ্গু সংক্রমণ কমার কোনও সম্ভাবনা নেই বলেও জা‌নি‌য়ে‌ছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। ইতোমধ্যে এক দিনে প্রায় হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। বর্তমা‌নে হাসপাতালের বেড রোগী‌তে পূর্ণ হ‌য়ে মেঝেতেও চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকে।

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১৩ অক্টোবর সর্বোচ্চ ৮ জনের মৃত্যু হয়ে‌ছে। এবছর ২২ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩০ হাজার ২৯ জন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ২৬ হাজার ৫১৩ জন। আর মারা গেছেন ১১২ জন।

ডেঙ্গুরোগীতে ভরে গেছে রাজধানীর হাসপাতালগুলো। বিশেষ করে মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং শিশু হাসপাতালে সিট না থাকলেও প্রতিদিনই আসছেন আক্রান্তরা।

এসব হাসপাতালে প্রতিদিন যত ডেঙ্গু আক্রান্ত মানুষ সুস্থ হচ্ছেন, তার চেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। যার কারণে দিনশেষে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রতিদিনই চাপ বাড়ছে হাসপাতালে। হাসপাতালের শয্যার চেয়ে বেশি রোগী আসছে বলে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। 

সরেজমিন রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতাল এবং শিশু হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, এসব হাসপাতালে সিটের চেয়ে রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। প্রতিদিন নতুন রোগী আসছেন গড়ে ২০ থেকে ২৫ জন। ওয়ার্ড বা কেবিনে সিট না থাকায় মেঝেতে রেখেই অনেককে চিকিৎসাসেবা নিতে দেখা গেছে। সারাদেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের অবস্থাও প্রায় একই। শিগগিরই ডেঙ্গুর এই অবস্থা কমার সম্ভাবনাও নেই বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। 

মহামারির মতো ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার কারণে মহাখালীর ডিএনসিসি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সে অনুযায়ী ২৩ অক্টোবর থেকে এই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা শুরু হচ্ছে। ইতোমধ্যে হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য চারটি ইউনিট চালু করা হয়েছে। একইসঙ্গে সেখানে ১২ জন চিকিৎসককে তিন শিফটে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

প্রাথমিকভাবে ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালে ডেঙ্গুর চারটি ইউনিট খোলা হলেও কেবল ডেঙ্গুরোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য একটি ডেডিকেটেড হাসপাতালের ব্যাপারে ভাবা হচ্ছে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম। তিনি বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় কোনও একটি ডেডিকেটেড হাসপাতাল নিয়ে ভাবা হচ্ছে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আমাদের (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) অনুমোদন দিলেই কার্যক্রম শুরু করা হবে। 

অধ্যাপক ডা. নাজমুল বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তদের চিকিৎসায় পুরনো পাঁচটি হাসপাতালে আমাদের পক্ষ থেকে স্পেশাল অ্যাটেনশন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের জন্য আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে একটি নির্দেশনা রয়েছে। যে হাসপাতালে ডেঙ্গু কর্নার করা সম্ভব, সেখানে করা হবে। আর যে হাসপাতালে আলাদা ডেঙ্গু ওয়ার্ড করা সম্ভব, সেখানে ওয়ার্ড করা হবে। হাসপাতালে রোগী যা-ই হোক না কেন শঙ্কার কোনও কারণ নেই, কাউকে ফেরা‌নো হ‌বে না। সবাইকে সাধ্যম‌তো চিকিৎসা দেওয়া হবে।

প্রাকৃতিক নিয়মে ডেঙ্গু সংক্রমণ সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে কমে যাওয়ার কথা থাকলেও এ বছ‌রের চিত্র ভিন্ন। কমছে তো না-ই, বরং সংক্রমণ বাড়ছে প্রতিদিন। কবে নাগাদ ডেঙ্গু সংক্রমণ কমতে পারে- এমন প্রশ্নের উত্তরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক নাজমুল বলেন, এই মাসের (অক্টোবর) মধ্যে কমার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এই সংক্রমণ কমতে নভেম্বর মাসেরও এক-দুই সপ্তাহ হতে পারে। বৃষ্টিপাত না হলে, পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে; নাগরিকরা আরও বেশি সচেতন হলে নভেম্বরের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে ডেঙ্গু সংক্রমণ কমে যাবে বলে আশা করছেন তিনি। 

মিরপুরের পল্লবী থেকে ছয় বছরের শিশু মামুনকে নিয়ে শিশু হাসপাতালে এসেছেন তার বাবা-মা। কোনও বেড না পাওয়ায় শিশু ওয়ার্ডের বারান্দায় মামুনের চিকিৎসা চলছে। তার শারীরিক অবস্থা প্রসঙ্গে মা আমেনা বেগম বলেন, ছেলের অনেক জ্বর ছিল, না কমাতে এখানে নিয়ে এসেছি। সিট ছিল না, তারপরও ওনাদের অনুরোধ করাতে মেঝেতে চিকিৎসা চালাচ্ছেন। ওর এখন স্যালাইন চলছে, তার মধ্যে কয়েকবার বমি করেছে। মুখে কিছুই খাচ্ছে না। তবে এখানকার ডাক্তাররা খুব খেয়াল রাখছেন। মেঝেতেও চিকিৎসা দিচ্ছেন।

বেডে এবং মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন এমন বেশ কয়েকজন রোগীর অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিদিন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী আসছেন হাসপাতালে। কিন্তু সিট পাচ্ছেন না অনেকে। ফলে মেঝেতেও চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। তবে বেশিরভাগ রোগীরাই এখানকার চিকিৎসক, নার্সের কাজের প্রশংসা করেছেন। কিন্তু হাসপাতালের পরিবেশ, ময়লা, দুর্গন্ধ- এসব বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ‌কে নজর দেওয়ার কথা প্রায় সবাই বলেছেন।  

শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. সোহেলী আহমেদ বলেন, এখন প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। আমাদের হাসপাতালে প্রতিদিন যে পরিমাণ রোগী আসছে, তাতে সবাইকে সেবা দিতে গিয়ে আমরা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছি। রোগীর চাপ বাড়ছে, দ্রুত কমবে বলেও মনে হচ্ছে না। রোগী বেশির কারণে সবাইকে শয্যা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমরা কাউকে ফিরিয়েও দিচ্ছি না। চেষ্টা করছি মেঝেতে রেখে হলেও সবাইকে যথাসাধ্য সেবা দিতে।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। তাদের হিসাবে ২ হাজার ৩৭২ জন ডেঙ্গু রোগী এ বছর (২২ অক্টোবর) মুগদা মেডিক্যালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ২ হাজার ১৭৯ জন। বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ১৯৩ জন ডেঙ্গুরোগী। তবে মুগদা হাসপাতালে এখন পর্যন্ত কোনও ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়নি বলেও জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। 

কেবল মুগদা হাসপাতাল নয়, ডেঙ্গু রোগীর অনেক চাপ রয়েছে শিশু হাসপাতালেও। গত দুই সপ্তাহে এই হাসপাতালে শিশু রোগীর চাপ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। নির্দিষ্ট ওয়ার্ড ছাড়াও ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে চিকিৎসা চলছে বলে হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

গত শনিবার (২২ অক্টোবর) হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৭২টি শিশু ভর্তি ছিল। হাসপাতালের চতুর্থ তলার ২৪ শয্যাবিশিষ্ট ১৪ নম্বর ওয়ার্ডটির ১২টি শয্যা ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের জন্য, বাকি ১২টি অন্যান্যদের জন্য। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, ২ নম্বর ওয়ার্ডে ২৪টি শয্যায় ডেঙ্গুরোগী আছে। আইসিইউতে আছে ৬টি শিশু। বাকি ২৮টি শিশু বিভিন্ন ওয়ার্ডে রয়েছে। এ বছর এখন পর্যন্ত শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০টি শিশু মারা গেছে বলেও জানান তারা। 

এ বছর রোগী ভর্তির হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। হাসপাতালটিতে মোট রোগী ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৭৬১ জন। তাদের মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ১ হাজার ৫৯৮ জন। বর্তমানে ভর্তি রয়েছেন ১৫২ জন এবং এ বছর এখন পর্যন্ত মিটফোর্ড হাসপাতালে ১১ জন ডেঙ্গুরোগীর মৃত্যু হয়েছে।

এই বছরের ডেঙ্গু ভর্তি রোগীর হিসেবে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৭৩৬ জন ডেঙ্গুরোগী। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ১ হাজার ৫২২ জন। বর্তমানে হাসপাতালে ডেঙ্গুরোগী ভর্তি আছেন ২০২ জন, আর এখন পর্যন্ত ঢামেক হাসপাতালে ডেঙ্গুতে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে।

সবমিলিয়ে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ১৯টি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতালে চলতি বছর সর্বমোট ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হয়েছেন ১১ হাজার ৩০৭ জন। সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ১০ হাজার ৪১ জন। বর্তমানে সর্বমোট রোগী ভর্তি আছেন ১ হাজার ২৩০ জন। আর এসব হাসপাতালে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৩৬ জন।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৩টি ওয়ার্ড ডেঙ্গুতে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সেগুলো হচ্ছে- ১, ১১, ১৪, ১৬, ১৯, ২০, ২১, ২৪, ২৮, ৩৩, ৩৪, ৩৫ এবং ৩৯ নং ওয়ার্ড। পাশাপাশি জরিপে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৪টি ওয়ার্ড ডেঙ্গুতে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বলে জ‌রি‌পে উঠে এসেছে। এলাকাগুলো হচ্ছে- ৭, ৮, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ২৪, ৩৪, ৩৮, ৩৯, ৪১, ৪২, ৪৮ এবং ৫১ নং ওয়ার্ড।

ডিএনসিসির উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লে. কর্নেল ডা. গোলাম মোস্তফা সারওয়ার বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ কমানোর জন্য আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা অভিযান, ওষুধ ছিটানো, নগরবাসীকে সচেতন করার জন্য বিভিন্নভাবে প্রচার-প্রচারণা চলছে।

ডিএনসিসির এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, মোবাইল কোর্টের অভিযানে গত দুদিনে প্রায় ১৭ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। কেবল জরিমানায় কাজ হবে না। এজন্য নগরবাসীকে সচেতন হয়ে নিজেদের বাসা-বাড়ি বা নতুন তৈরি ভবনের বিভিন্ন পাত্রে জমে থাকা পানি নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। নতুবা ডেঙ্গুর এই সংক্রমণ রোধ করা একা ডিএনসিসির পক্ষে প্রায় অসম্ভব।

এদি‌কে অধ্যাপক ডা. ফরহাদ মনজুর ব‌লে‌ছেন, কা‌রও জ্বর হ‌লে ২৪ ঘণ্টার ম‌ধ্যে তার ডেঙ্গু পরীক্ষা ক‌রতে হ‌বে। প‌জি‌টিভ হ‌লে শিশু, যুবক, বৃদ্ধ যেই হোক- দ্রুত চি‌কিৎস‌কের পরামর্শ নি‌তে হ‌বে। কো‌নোভা‌বে রোগী‌কে বাসায় রাখা যা‌বে না। আর বাসার বি‌ভিন্ন পা‌ত্রে যা‌তে পা‌নি জ‌মে না‌ থাকে, সে‌দি‌কে সবাইকে খেয়াল রাখ‌তে হ‌বে।

ঢাকা/এনএইচ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়