ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

রমজানে দাম বাড়ানো যেন ‘রেওয়াজ’

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:১০, ১৮ মার্চ ২০২৩   আপডেট: ২৩:০১, ১৮ মার্চ ২০২৩
রমজানে দাম বাড়ানো যেন ‘রেওয়াজ’

ছবি: সংগৃহীত

রোজা শুরু হতে সপ্তাহেরও কম সময় বাকি। রমজান মাসে তেল, চিনি, ছোলা, ডাল, খেজুর, পেঁয়াজসহ বেশকিছু ফলের চাহিদা বেড়ে যায়। গত বেশ কয়েক বছর থেকে রমজানের আগে এসব পণ্যের দাম ও সরবরাহ ঠিকঠাক রাখার প্রতিশ্রুতি দেন পাইকারি ব্যবসায়ী, খুচরা, আমদানিকারক ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। যথারীতি এবারও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সভায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু বাজারের চিত্র পুরোই ভিন্ন। রমজানকে ঘিরে বেড়েছে এসব পণ্যের দাম, কমেছে সরবরাহ।

ইফতারে অন্যতম আইটেম ‘ছোলা’। যার দাম বছরজুড়ে ছিল ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা। গত ১৫ দিনে ছোলার দাম বেড়ে বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা। ছোলার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিনি ও তেলের বাজার। চিনির দাম এতটাই উঠানামা করছে যে, অনেক খুচরো ব্যবসায়ীরা দোকানে রাখছেন না।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, দেশে বছরে চিনির চাহিদা ১৮-২০ লাখ টন। রোজায় এ চাহিদা আরও বেড়ে যায়। অথচ দেশে সব মিলিয়ে চিনি উৎপাদিত হয় মাত্র ৩০-৩৫ হাজার টন। শুধু রোজার মাসে চিনির চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় আড়াই থেকে তিন লাখ টন। দেশে উৎপাদন না থাকায় চাহিদার বড় অংশই জোগান দেওয়া হয় আমদানির মাধ্যমে।

শনিবার (১৮ মার্চ) রাজধানীর একাধিক বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খোলা চিনি (সাদা) বিক্রি হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকা। প্যাকেটজাত (সাদা) ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা। যদিও সরকার নির্ধারিত দামে প্রতিকেজি খোলা চিনি ১০৭ এবং প্যাকেট ১১২ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা। অপরদিকে, আখের চিনি (লাল) বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায়। অথচ, গত ২৬ ফেব্রুয়ারি আমদানিতে অপরিশোধিত চিনির ওপর কেজিপ্রতি সাত টাকা এবং পরিশোধিততে ১০ টাকা শুল্ক প্রত্যাহার করেছে সরকার।

নিউ মার্কেটের মায়ের দোয়া জেনারেল স্টোরের বিক্রেতা আব্দুল মোমিন বলেন, চিনি কোম্পানিরা এখন আর চাহিদামত সরবরাহ করে না। পাইকারি বাজারে সিন্ডিকেট করে বিক্রি করে। দোকান চালানোর স্বার্থে সেসব বড় পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আমাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। অন্যদিকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোম্পানি নির্ধারিত দামে চিনি দেয় না। বরং অনৈতিকভাবে বাড়তি টাকা নিচ্ছে।

চিনির সরবরাহ এবং বেশি দাম প্রসঙ্গে পাইকারি চিনি ব্যবসায়ী ও মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা বলেন, ভ্যাট কমানোর ঘোষণার পরও মিল থেকে চিনির দাম কমেনি বরং বেড়েছে। সরকার নির্ধারিত দামে ডিলারদের কাছে ১০২ টাকা দরে চিনি দেওয়ার কথা মিলগুলোর। তারা ডিও-তে ১০২ টাকাই লিখছে, কিন্তু বাস্তবে ১০৫ থেকে ১১০ টাকা পর্যন্ত দাম নিচ্ছে। এই বিষয়ে আমরা সরকারের বিভিন্ন মহলে অভিযোগও করেছি। কিন্তু কোনও প্রতিকার হয়নি।

ব্যবসায়ী সমিতির এই নেতার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, মিল থেকে সরকার নির্ধারিত মূল্যেই আমরা চিনি বিক্রি করছি। আমরা রশিদ ছাড়া কোনও পণ্য বিক্রি করি না। আমাদের কাছে প্রমাণ রয়েছে। তাই, নির্ধারিত মূল্যের বাইরে বেশি নেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। 

এদিকে, দেশে বোতলজাত সয়াবিন তেল আমদানি ও শীর্ষ সরবরাহকারী হিসেবে রয়েছে- সিটি গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, দেশবন্ধু গ্রুপ। এসব কোম্পানি বোতলজাত তেলের পাশাপাশি চিনিও আমদানি ও সরবরাহ করে থাকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্ববাজারে সব পণ্যের দাম বেড়েছিল। সেই উত্তাপ এখন অনেকটা কমেছে। গত কয়েক মাসের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেল, চিনি, ডাল ও ছোলার মতো বেশকিছু পণ্যের দাম কমেছে। কিন্তু দাম বৃদ্ধির অজুহাতে দেশের বাজারে যে মূল্য বেড়েছিল, সেটা আর কমছে না। রমজানের সময় বাড়তি চাহিদার সুযোগে ব্যবসায়ীরা দাম সমন্বয় না করে বরং কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। 

বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, গত এপ্রিল থেকে জুন মাসে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১ হাজার ৯০০ ডলার। বর্তমানে তা ১ হাজার ৩৫২ ডলারে নেমেছে। অথচ বিশ্ববাজারে দাম কমার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না দেশের বাজারে। বরং কিছু পণ্যে দরবৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা এখনও আমদানি-ব্যয় বৃদ্ধিকে দুষছেন। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও এর কারণে পণ্যের করভার বেড়ে যাওয়ার কথাও বলছেন তারা। পাশাপাশি বলছেন, পণ্যগুলোর আমদানি সময়সাপেক্ষ। কমদামের পণ্য এখনও দেশে এসে পৌঁছায়নি। এর সুফল ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় লাগবে।

এ বিষয়ে মেঘনা গ্রুপের সিনিয়র সহকারী মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার বলেন, এখন ছোলা-খেজুর বা চিনি জাতীয় কোনও পণ্য বিশ্ববাজার থেকে কেনা হলে সে পণ্য দেশে আসবে রোজার পরে। ফেব্রুয়ারি মাসে যেসব কোম্পানি পণ্য কেনার জন্য এলসি করেছেন, তারা কিছুটা কম দামে পণ্য পাচ্ছেন। যদিও এসব পণ্য আরও বেশ কিছুদিন পরে আসবে। তখন ভোক্তা পর্যায়ে এর সুফল পাওয়া যাবে। বর্তমানে বাজারে যেসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে, এসব পণ্য বেশ চড়া দামে আমদানি করা বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের জেনারেল ম্যানেজার বলেন, মে মাস পর্যন্ত দেশে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। এখন সেটা বেড়ে হয়েছে ১০৬ টাকা। আমদানি করার এলসি খোলার জন্য কখনও কখনও ১১০ টাকা পর্যন্ত খরচ পড়ে যাচ্ছে। এরপর কর আদায়ের ক্ষেত্রে ডলারের দামের প্রভাব পড়ে। দাম যত বেশি হয়, করভার তত বাড়ে। অনেক ব্যবসায়ী এলসি নিষ্পত্তিতে ডলার সংকটের কারণে বন্দরে পণ্য খালাস না করতে পেরে জরিমানা গুনছেন। এসবের প্রভাব পড়ে আমদানিকৃত পণ্যের ওপর। 

অন্যদিকে, ব্যবসায়ীদের এসব কথাকে ‘অজুহাত’ বলে মনে করেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া। তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমার পরও দেশের বাজারে সেটা সমন্বয় না হওয়া ব্যবসায়ীদের একটি ‘অপকৌশল’। খেয়াল করবেন, বিশ্ববাজারে দাম বাড়লেই ব্যবসায়ীরা সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারে সেটা সমন্বয় করে। রাতারাতি সেটা কার্যকর করে ফেলে। 

তিনি বলেন, বৃদ্ধিটা যদি সঙ্গে সঙ্গে সমন্বয় হয়, কমতিটাও সেভাবেই কার্যকর করতে হবে। ব্যবসায়ীরা কোনোভাবেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন না। তারা নানা ধরনের অপকৌশলে লিপ্ত।

ঢাকা/এনএইচ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়