ঈদকে সামনে রেখে উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স বৈঠক
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও নিত্যপণ্যের উৎপাদন, আমদানি, মজুত, বাজারে সরবরাহ ও দাম পর্যালোচনা করে পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নিতে গত বছর ১৭ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠন করে সরকার। অভিযোগ রয়েছে, কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে চিনি, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, আদা, রসুন ও মসলাপাতির দাম বাড়ানোর কারসাজি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। ফলে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। এ অবস্থায় করণীয় নির্ধারণে বৈঠকে বসতে যাচ্ছে সরকারের উচ্চপর্যায়ের এই টাস্কফোর্স।
জানা গেছে, ঘন ঘন লোডশেডিং এবং বিদ্যুৎ সংকটের কারণে চিনি ও ভোজ্যতেলসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে বলে মিল মালিকরা দাবি করছেন। পাশাপাশি বিশ্ববাজারে বেশকিছু ভোগ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ও আমদানি কম হওয়ার কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর সাথে রয়েছে বৈশ্বিক সংকটের প্রভাবও। এদিকে, চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে উদযাপিত হবে মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা। সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এবারের টাস্কফোর্স বৈঠক অনেকটাই গুরুত্ববহ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
আগামীকাল রোববার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে টাস্ক ফোর্সের সপ্তম সভা আহ্বান করা হয়েছে। মূলত বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা এবং দ্রব্যমূল্য কীভাবে কমিয়ে এনে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়া যায় সেই বিষয়ে কৌশল নির্ধারণ করে থাকে টাস্ক ফোর্স কমিটি। বাণিজ্য সচিবের সভাপতিত্বে এ কমিটিতে সরকারি-বেসরকারি খাতের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন।
এর আগে গত মার্চে রমজানের শুরুতেই ভোক্তাদের অতিরিক্ত পণ্য না কেনার বিষয়টির ওপর গুরুত্বারোপ করে জোরেশোরে প্রচার চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। রমজানের সময় স্থানীয় পর্যায়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং পণ্যের ন্যায্য দামের বিষয়টি জেলা প্রশাসকগণ সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। এর পাশাপাশি সরকারের আরও দুই সংস্থা নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর এবং জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বাজার মনিটরিং করার সিদ্ধান্ত হয়। এ লক্ষ্যে গত ১৮ মার্চ দেশের আট বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া, একই দিনে দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের আরেকটি বৈঠক হয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলার সংকট তৈরি হওয়ায় কয়েক মাস ধরে ভোগ্যপণ্য আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। এ কারণে চাহিদার তুলনায় পণ্যের সরবরাহে কিছুটা ঘাটতি রয়েছে বাজারে। অন্যদিকে পেঁয়াজ ও আদার মতো পণ্যের দেশীয় উৎপাদন ভালো হওয়ার পরও কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে মজুত বাড়িয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। তবে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির ফলে বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে পেঁয়াজের দাম কমেছে খুচরা বাজারে। বিদ্যুৎ সংকটের কথা বলে চিনি ও আলুর দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করা হচ্ছে। কয়েক দফা বেড়েছে মসলাপাতির দাম। এ অবস্থায় কোরবানির আগে দ্রব্যমূল্য কমাতে চায় সরকার।
সূত্র জানায়, ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের দাম কমাতে আমদানি বাড়ানো, কৃষিপণ্য সংরক্ষণসহ সাত বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় গঠিত টাস্কফোর্সের বৈঠকে নিত্যপণ্যের দাম কমাতে নতুন কৌশল নির্ধারণ করা হবে। আশা করা হচ্ছে, সরকারি উদ্যোগগুলো বাস্তবায়িত হলে ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
অভিযোগ রয়েছে, দ্রব্যমূল্য অস্থিরতার পেছনে অসাধু ব্যবসায়ীদের বড় ভূমিকা রয়েছে। পণ্যের মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বেশি নেওয়া হয়। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে কঠোর বাজার মনিটরিং করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে যেসব ব্যবসায়ী ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ানোর সঙ্গে জড়িত থাকবে তাদের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল, ডিলারশিপ বাতিল ও আর্থিক জরিমানা করা হবে। এমনকি জেল, জরিমানার মতো শাস্তি দেওয়া হতে পারে। এছাড়া, যেসব বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেশি নেওয়া হবে সেসব বাজারে ব্যবসায়ী সংগঠনের কমিটি ভেঙে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে ভোক্তা অধিদপ্তর।
কোরবানিতে পেঁয়াজের সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা: সম্প্রতি পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। অথচ রোজার ঈদের পর দাম বাড়তে শুরু করলে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিতে কৃষি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এর পরও অনুমতি দেওয়া হচ্ছিল না। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিদ্ধান্তে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি পান ব্যবসায়ীরা। ইতিমধ্যে ৫ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হলেও দেশে এসেছে মাত্র ১৫ হাজার টন। যা দিয়ে সারা দেশে মাত্র দুই দিনের চাহিদা মেটানে সম্ভব। ফলে মসলা জাতীয় এ পণ্যটির দাম কমছে ধীরে ধীরে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোরবানির সময় সাড়ে তিন লাখ থেকে ৪ লাখ টন পেঁয়াজের বাড়তি চাহিদা তৈরি হবে। এই চাহিদা পূরণে আরও বেশি পেঁয়াজ আমদানি করতে হবে। এ খাতের আমদানিকারকরা বলছেন, দ্রুত আমদানি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হলে এলসি দ্রুত নিষ্পত্তি এবং বন্দরে পণ্য খালাস দ্রুত করতে হবে। অন্যথায় কোরবানির সময় সংকট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জানা গেছে, বিষয়টি মাথায় রেখে করণীয় নির্ধারণ করা হবে এই বৈঠকে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাত উদ্যোগ: দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাত উদ্যোগ হচ্ছে- নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদন, আমদানি ও মজুত পরিস্থিতি পর্যালোচনা, পণ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সরবরাহ চেনে বিভিন্ন পর্যায়ে পার্থক্য হ্রাসকরণ, পেঁয়াজ, আদা, রসুন ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য সংরক্ষণের উদ্যোগ, বাজারে স্থিতিশীলতা অর্জনে টিসিবির ভূমিকা বাড়ানো, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি এলসি খোলা ও নিষ্পত্তিতে অগ্রাধিকার প্রদান এবং প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, নিত্যপণ্যের আমদানিকৃত খাদ্যদ্রব্য দ্রুত খালাসের ব্যবস্থা এবং বাজারে শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, টাস্ক ফোর্সের সভায় এ বিষয়গুলোর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা এবং তা বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়া হবে। কৃষিপণ্য বিশেষ করে পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের দেশীয় উৎপাদন ও মজুত বাড়ানো হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। সম্প্রতি গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনে ১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এছাড়া, এসব পণ্য সারা বছর সংরক্ষণে কৃষক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ ও গুদামঘর নির্মাণে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।
বাড়তে পারে টিসিবির পণ্য: আগামীতে টিসিবির তালিকায় আরও কয়েকটি ভোগ্যপণ্য যুক্ত করা হতে পারে। ফ্যামিলি কার্ডের সংখ্যা বাড়ানোর ওপরও জোর দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া চাল, ডাল, গম (আটা), ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, পেঁয়াজ ও মসলাপাতিসহ ১৭ অত্যাবশ্যকীয় পণ্যসামগ্রী আমদানি বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হবে। এদিকে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আমদানির বিষয়টির নজরদারি রাখা হচ্ছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, যেসব ব্যবসায়ী পণ্যের মজুত বাড়িয়ে দাম বাড়াচ্ছেন তাদের নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। এছাড়া, পণ্যের দাম কমাতে সমুদ্র ও স্থলবন্দর এবং শুল্ক স্টেশন দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য খালাসে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাজারে স্থিতিশীলতা আনয়নে সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা টিসিবিকে আরও শক্তিশালী করা হবে।
১৭ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স: ২০২২ সালের ১৩ মার্চ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা’ বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের এই টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।
টাস্কফোর্সে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে উপদেষ্টা ও বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষকে সভাপতি করা হয়। ওদিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ১৭ সদস্যের টাস্কফোর্স কমিটি গঠনসংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি হয়।
গঠিত কমিটিতে বাকি সদস্যরা হলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব, কৃষিসচিব, খাদ্যসচিব, শিল্পসচিব, তথ্য ও সম্প্রচারবিষয়ক সচিব, ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান, প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক, এনএসআইয়ের মহাপরিচালক, টিসিবির চেয়ারম্যান, এফবিসিসিআই সভাপতি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্মসচিব।
গঠিত টাস্কফোর্সের দায়িত্ব: সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা প্রতিষ্ঠানকে দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পরবর্তী করণীয় বিষয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা এবং আন্তর্জাতিক বাজার দর ও আমদানিসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ; কোনো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বা সরবরাহ চেইনে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির উদ্ভব হলে ‘দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেল’ থেকে তথ্য সংগ্রহ এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
পণ্য উৎপাদন, পরিশোধন ও আমদানি থেকে স্থানীয় পর্যায়ে বিক্রয় পর্যন্ত সার্বিক কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া।
নিত্যপণ্যের সরবরাহ চেইন স্থিতিশীল রাখার বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার মনিটরিং কমিটির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া এবং উল্লেখিত কার্যাবলির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বা আনুষঙ্গিক অন্য সব প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পাদন করা।
এছাড়া, গঠিত কমিটি প্রতি মাসে অন্তত একবার সভা করবে। প্রয়োজনে উল্লেখিত কার্যাবলি সম্পাদনে অন্য সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবেন।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব খন্দকার নুরুল হক স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে দ্রব্যমূল্য ও বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা বিষয়ক গঠিত টাস্কফোর্স কমিটিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তরের একজন উপযুক্ত প্রতিনিধি জরুরি ভিত্তিতে মনোনয়ন দেওয়ার কথাও বলা হয়।
ঢাকা/হাসান/ইভা