ক্রেতার স্বর্গ ।। শান্তা মারিয়া
শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম
(চকবাজার টু চায়না : পর্ব-১৫ )রবীন্দ্রনাথ কেজো লোকের আর অকেজো লোকের স্বর্গের কথা বলেছিলেন। কিনিয়ে লোকের স্বর্গের কথা বলেননি। চীন হচ্ছে ‘শপার’স হেভেন বা ক্রেতার স্বর্গ’ । বিশ্ববাজারে চীন হলো সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারী। হেন জিনিস নেই যা তারা উৎপাদন করে না। এক সময় একটা কথা প্রচলিত ছিল, কোনো একটি জিনিস যখন যুক্তরাষ্ট্র আবিষ্কার করে তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে দাবি তোলা হয় যে সেটি তারা দশ বছর আগেই আবিষ্কার করেছে। আর এই দাবি পাল্টা দাবি যতক্ষণ চলতে থাকে, ততোক্ষণে সেটির বাজার দখল করে চীন।
কয়েক বছর আগে একটা কার্টুন দেখেছিলাম। চাঁদকে জুম করলে দেখা যায় চাঁদের বুকে মার্কিন পতাকা। আর মার্কিন পতাকাকে আরও জুম করলে দেখা যায় তাতে লেখা রয়েছে মেড ইন চায়না। গত অলিম্পিকেও মার্কিন খেলোয়াড়দের গায়ে ছিল চীনের তৈরি পোশাক। এ নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। আমেরিকায় শপিং করতে গিয়ে দেখেছি অধিকাংশ জিনিসের গায়েই লেখা মেড ইন চায়না। যাই হোক, চীন যে ক্রেতার স্বর্গ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বেইজিং শহরে অসংখ্য শপিং মল। চেইন শপও অসংখ্য। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড শপও প্রচুর। আবার টুরিস্টদের জন্য বিশেষভাবে সাজানো শপিং মলও রয়েছে। আর পাড়া মহল্লায় ছোট ছোট শপিং মলেরও অভাব নেই। আরও আছে ফুটপাথের পশরা এবং ওপেন মার্কেট বা খোলা আকাশের নিচে বাজার ।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় শপিং মলটি চীনে অবস্থিত হলেও বেইজিংয়ে নয়। বেইজিংয়ে রয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম শপিং মল যার নাম ‘গোল্ডেন রিসোর্সেস মল’। ‘গ্রেট মল অব চায়না’ নামেই সেটি বেশি পরিচিত। ১৪ তম বৃহৎ শপিং মলটিও বেইজিংয়ে। এর নাম ‘বেইজিং মল’। সিল্ক স্ট্রিট, সাংলিথুন, শিদান, কংজুফেন, ফুশিংমান, ওয়াংফুচিং, এসব এলাকা শপিংয়ের জন্য বিখ্যাত।
বিদেশে দর্শনীয় স্থানগুলো দেখা হয়ে গেলে একঘেয়ে লাগা শুরু হয়। একঘেয়েমী কাটানোর সেরা উপায় হলো শপিং। আমিও প্রচুর শপিং করতাম। আবার পকেটে পয়সা না থাকলে উইনডো শপিংও বেশ আনন্দদায়ক। শপিংয়ে আমি এমনই এক্সপার্ট ছিলাম (এখনও আছি) যে চীনা সহকর্মীরাও আমার কাছে জানতে চাইতো কোন জিনিস কোথায় পাওয়া যায়। তবে চীনে এখন ই-শপিংসবচেয়ে জনপ্রিয়। সে কথায় পরে আসছি।
বেইজিংয়ে ব্র্যান্ড শপ, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় চেইনশপ ও সুপারশপ রয়েছে। যেমন, ক্যারিফোর, ওয়ালমার্ট ইত্যাদি। এসব জায়গায় দর কষাকষি চলে না অবশ্যই। তবে এমনি সাধারণ শপিং মলে দর কষাকষি চলে এবং দারুণভাবে চলে। দরাদরি না করলে ডাহা ঠকে যাওয়ার আশংকা। ১৫ টাকার জিনিস বিদেশি দেখে হাজার টাকা চাইছে সিল্ক স্ট্রিটে এমন ঘটনাও অনেক ঘটে। চীনে কেনাকাটা করতে গেলে তাই দরাদরি জানতে হবে। আমি গাউছিয়া-চাঁদনি চকে কেনাকাটা করে দক্ষতা অর্জন করেছি, আমাকে তাই চীনা দোকানদারও ঠকাতে পারেনি।
বেইজিংয়ে শপিংয়ে আমার বেশ পছন্দের জায়গা ছিল জু মার্কেট। বেইজিং জু বা চিড়িয়াখানার ঠিক উল্টো দিকেই এই শপিং মল। আমাদের গাউছিয়া, চাঁদনী চকের মতো পর পর বেশ কয়েকটি মার্কেট এখানে। একটির সঙ্গে আরেকটি সংযুক্ত। এই মার্কেটের শেষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মূলত কাপড়চোপড়ের মার্কেট। ছয়-সাততলা মার্কেট। এসকেলেটর রয়েছে। কষ্ট করে সিঁড়ি ভাঙার দরকার নেই। কাপড়চোপড়ের মার্কেট হলেও অন্যান্য জিনিসেরও কমতি নেই। আমি এর নাম দিয়েছিলাম বেইজিংয়ের বঙ্গ বাজার। গার্মেন্টস সামগ্রী খুব সস্তায় বিক্রি হতো এখানে। জিনসের প্যান্ট, শার্ট, গেঞ্জি, স্যুট, কোট, জ্যাকেট, স্কার্ট, টপস কি নেই এখানে? ঢুকলে কিছু না কিনে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। ব্যাপক দরাদরি চলে এখানে।
সিল্ক স্ট্রিট আর সাংলিথুন হলো দূতাবাস পাড়ায়। সাংলিথুনের ইয়াশু মার্কেট বেশ বিখ্যাত। সিল্ক স্ট্রিটের মার্কেটও বিখ্যাত। এই দুটি শপিংমলকেই আমি অবশ্য বলতাম ‘গলা কাটা মার্কেট’। এসব জায়গায় পাওয়া যায় চীনের ঐতিহ্যবাহী পোশাক যেমন ছিপাও ইত্যাদি। ইলেকট্রনিকস সামগ্রী, মোবাইল ফোন এগুলোর জন্য এই মার্কেট বিখ্যাত। আর রয়েছে প্রচুর ও বিভিন্ন রকম শোপিস। মুক্তা আর ইমিটেশনের গয়নাও এখানে প্রচুর। মুক্তার মালা এখান থেকে অনেক কিনেছি। মুক্তার গয়নার জন্য অবশ্য বিশেষ প্রসিদ্ধি রয়েছে হোংচিয়াও মার্কেটের।
কেনাকাটা করতে করতে বিভিন্ন দোকানীর সঙ্গে বন্ধুত্বও হয়ে যায়। বন্ধুকে চীনা ভাষায় বলে ‘ফংইউ’। বিদেশী বন্ধুকে খাতির করে এরা। চীনের মানুষ প্রচুর কেনাকাটা করে। বেইজিংয়ের মানুষের হাতে এখন প্রচুর টাকা। তারা কিনতেও পারে তেমনি হাত খুলে। ই-শপিং বেশ জনপ্রিয় এখানে। চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনালে চীনা সহকর্মীদের দেখতাম সারাদিনই কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে চোখ। অনলাইনে কোন দোকানে কি পাওয়া যায় তা দেখছে। অর্ডার দিচ্ছে। মাল বাড়িতে বা অফিসে পৌঁছে গেলে বিল মিটিয়ে দিচ্ছে। অনলাইনে বেশ সস্তায় জিনিম পাওয়া যায়। আমি নিজেও অনলাইনে বেশ কিছু জিনিস কিনেছি। কিনে মনে হয়নি যে ঠকেছি। বরং জিতেছি বলেই মনে হয়েছে। অনলাইন শপিংয়ে সময় বাঁচে, যাতায়াত ভাড়াও বাঁচে। তবে শপিংয়ে যাওয়া, কেনাকাটা করা, বিভিন্ন জিনিস দেখা সেই সঙ্গে রেস্টুরেন্টে ঢুকে হালকা কিছু খাওয়ার মজা অবশ্যই বাড়তি পাওয়া। আমি শপিংয়ে যেতাম যত না প্রয়োজনে তার চেয়ে বেশি বিনোদন পেতে।
শিদান বেইজিংয়ের ব্যস্ত বাণিজ্যিক এলাকা। শিদানে শপিং কমপ্লেক্সও প্রচুর। এগুলোও একটার সঙ্গে একটা সংযুক্ত। ফলে শেষ খুঁজে পাওয়া যায় না। আমি মাঝে মাঝে আন্তজার্তিক ব্র্যান্ড শপগুলোতেও ঢুকতাম। নিনারিচি, গুচি, আনাসুই, কেলভিন ক্লেইন, ম্যাংগো, জর্জিও আরমানি। একটা জ্যাকেট বা একজোড়া জুতোর দাম হয়তো তিন হাজার বা দুই হাজার ইউয়ান (১ ইউয়ান ১৩ টাকা)। আমি যে পরিমাণ বেতন পেতাম, তাতে হয়তো ব্র্যান্ডের কাপড় কিনতে পারতাম। কিন্তু বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ হাজার টাকা খরচ করে কাপড় কেনার চিন্তাটাই কুৎসিত মনে হতো। বিশেষ করে আমি এমন এক দেশের নাগরিক যে দেশের বহু মানুষ হতদরিদ্র। দরিদ্র দেশের নাগরিক হয়ে এসব কাপড় পরে বেড়ালে ময়ূরপুচ্ছ দাঁড়কাক ছাড়া আমাকে আর কি বা মনে হবে? আমি বরং পছন্দ করতাম ‘শি খোয়াই’ দোকান। নিলামওয়ালা ছ আনার মতো ‘শি খোয়াই’ দোকান বেইজিংয়ের অনেক জায়গায়ই রয়েছে। এসব দোকানে প্রতিটি জিনিসের দাম ‘শি খোয়াই’ বা দশ ইউয়ান। যেমন, আমেরিকায় দেখেছি ‘ওয়ান ডলার শপ’ ।
এ ধরনের সব দোকানের চরিত্রই এক। এরা সস্তায় লটে মাল কিনে স্বল্প লাভে বিক্রি করে দেয়। এসব দোকানে পাওয়াও যায় অনেক কিছু। খেলনা, শোপিস, ইমিটেশন গয়না, ঘড়ি কি নেই? শিদানের এমনি একটি শি খোয়াই দোকান ছিল আমার বেশ প্রিয়। সুযোগ পেলেই সেই দোকানে যেতাম। লোভে পড়ে অনেক কিছু কেনা হয়ে যেত। পরে বাড়িতে এসে মনে হতো এসব জিনিসের প্রয়োজন ছিল না তো তেমন। শিদানে প্রথম গিয়েছিলাম আমার রুমমেট নিনার সঙ্গে। নিনা রুমানিয়ার মেয়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাহিত্য, সংগীত আর শিল্পকলার ভক্ত। দরাদরিতে তেমন দক্ষ নয়, তাই আমাকে ‘হায়ার’ করে নিয়ে যেত।
চীনে শপিং করতে গেলে সঙ্গে কোনো চীনাকে না নেওয়াই উত্তম। ওরা জাত ভাইদের সঙ্গে তেমন পেরে ওঠে না। অনেক বাংলাদেশী আছেন তাদের নাম বলতে চাই না, তারাও ঠকান। দোকানের সঙ্গে আগেই তাদের বখরা ঠিক করা থাকে। নতুন মোরগা পেলে দোকানির সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে জবাই দেন। এজন্য একা বা বিশ্বস্ত কাউকে নিয়ে যাওয়াই সুবিধাজনক। আর ক্যারিফোর, ওয়ালমার্ট, হুয়ালিয়ন, ইয়ানহুই, উমার্টের মতো সুপার শপে তো দরাদরির বালাই নেই। ঠকে যাওয়ারও আশংকা নেই। এরা মাঝে মধ্যে এমন সেল দেয় যা খুবই লোভনীয়।
গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসকে একবার তার শিষ্যরা বাজারে নিয়ে গিয়েছিলেন। বিলাসসামগ্রী দেখে তিনি দারুণ অবাক। অনেক জিনিস নেড়েচেড়ে শেষ পর্যন্ত তিনি নাকি বলেছিলেন, পৃথিবীতে এত জিনিসও আছে। কিন্তু হায় এসবের কোনটিই আমার প্রয়োজন নেই।
চীনের বাজার ঘুরে আমার মনে হয়েছে এর বিপরীত বাক্য। অর্থাৎ এর সবকিছুই তো আমার প্রয়োজন। বেইজিংয়ে প্রচুর কেনাকাটা করলেও এখন যখন সেই কিনে আনা জিনিসগুলো দেখি তখন মনে হয় সেখানে থেকে সবচেয়ে মূল্যবান যা আমি নিয়ে এসেছি তা হলো স্মৃতি।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬/তারা
রাইজিংবিডি.কম