প্রতি তিন ছাত্রের একজন মাদ্রাসার
নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশে প্রতি তিনজন ছাত্রের মধ্যে একজন মাদ্রাসার। ২০০৮ সালে সারা দেশে মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ছিল ১ কোটি। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ৫২ লাখ শিক্ষার্থী কওমি মাদ্রাসার।
শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার রাজনৈতিক অর্থনীতি’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান ও ‘বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা বনাম শিক্ষা বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব তথ্য জানানো হয়। অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত।
আবুল বারকাত বলেন, মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন, এমন আলোচনা শুরু হয় ২০০৪ সালে। কী ধরনের গবেষণা হবে তার প্রাথমিক ধারণাপত্র তৈরির সিদ্ধান্ত হয় ২০০৬ সালে। ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালে সারা দেশ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। পাশাপাশি বিচার-বিশ্লেষণ ও রাজনৈতিক ব্যাখ্যা বোঝার চেষ্টা করা হয়। ২০১১ সালে বইটি ইংরেজিতে প্রকাশ করা হয়। বাংলায় অনুবাদ করা হলো এ বছর।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, মাদ্রাসা শিক্ষা পরিচালনা পর্ষদে যারা আছেন, তাদের ৯২ শতাংশের ছেলে-মেয়েদের মাদ্রাসায় পড়ান না। ৯২ ভাগ নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা মাদ্রাসায় পড়েন। কিছু নিম্ন-মধ্যবিত্ত আছেন যারা তাদের সবচেয়ে কম মেধারী সন্তানকে মাদ্রাসায় পড়ান। মাদ্রাসায় শিক্ষিতদের ৭৫ শতাংশ বেকার।
আবুল বারকাত বলেন, এই বেকারদের হাতে যদি কোনো কিছু তুলে দিয়ে বলা হয়- ইসলামী রাজ কায়েমের লক্ষ্যে, তাহলে তাদের নামানো সহজ। মাদ্রাসা শিক্ষা পশ্চাৎপদ, এতে কোনো সংশয় ও দ্বিধার কারণ নেই। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িক মানসকাঠামো বিনির্মাণে এই শিক্ষা ব্যর্থ। অনেক ক্ষেত্রে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, জঙ্গি উৎপাদন এবং পুনঃউৎপাদকের ক্ষেত্রে এই শিক্ষার বেশ উর্বর ভূমিকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৮ সালে দেখো গেছে, মাদ্রাসা শিক্ষায় বছরে ব্যয় ৮ হাজার কোটি। বর্তমান সময়ে তা বেড়ে অন্তত ১২ হাজার কোটি তো হবে।
মাদ্রাসার পরিচালনা পর্ষদের যারা আছেন তাদের রাজনৈতির সম্পৃক্ততা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ৭ শতাংশের কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। সরাসরি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ও খেলাফতে মজলিশ মিলে ৫০ শতাংশ, বিএনপি ২৯ শতাংশ আর আওয়ামী লীগ ২০ শতাংশ।
১৯৭০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর চেয়ে মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর হার বেড়েছে। বছরে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বৃদ্ধির হার ৩ শতাংশ। আর মাদ্রাসা বেড়েছে ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। মাদ্রাসার মধ্যে আলিয়ার চেয়ে কওমির বৃদ্ধির হার বেশি। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ, আর মাদ্রাসায় ৩ দশমিক ৯ শতাংশ।
আবুল বারকাত বলেন, ২০৫০ সাল নাগাদ দেশে মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা এবং সাধারণ শিক্ষায় কী হতে পারে, তার একটি ধারণা তুলে ধরেছি। এতে দুই রকমের পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। তাতে বেশ ভীতি সঞ্চার হওয়ার কারণ আছে।
অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক ছিলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিক উজ জামান, প্রাক্তন প্রধান তথ্য কমিশনার অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ। সূচনা বক্তব্য দেন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। সভাপতিত্ব করেন মানবাধিকারকর্মী ও নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশী কবির।
ড. শফিক উজ জামান বলেন, মাদ্রাসা শিক্ষা নিষিদ্ধ নয়। যারা মাদ্রাসায় গেছেন তারা বাধ্য হয়ে গেছেন। এজন্য দায়ী আমাদের সমাজব্যবস্থা। আমরা দেশটাকে বিভক্ত করে রাখতে চাই। তাই বলব, নিষিদ্ধ না করে এ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে।
ড. গোলাম রহমান বলেন, এ ধরনের গবেষণার প্রযোজনীয়তা আমাদের সমাজে অনেক বেশি। আমার মনে হয়, আমরা কখনো মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে মূল স্রোতধারায় আনার চিন্তা করিনি। আমরা যদি মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসতে পারতাম তাহলে নিশ্চয়ই সেই শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত হতো। যদি আমরা সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার কথাও বলি, সেখানে কিন্তু প্রশ্নের শেষ নেই। যেভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে, প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে, বলতে হবে আদর্শিক দিক দিয়েও এখন আর কার্যকর নেই। আমার লক্ষ করছি, সাধারণ শিক্ষায় মান থাকছে না। সাধারণ শিক্ষার যে অবস্থা তাতে মাদ্রাসার বিষয় তো সূদূর পরাহত।
‘বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার রাজনৈতিক অর্থনীতি’ বইটি লিখেছেন আবুল বারকাত, রওশন আরা, তাহের উদ্দিন, ফরিদ এম জাহিদ ও মোহাম্মদ বদিউজ্জামান। ভাষান্তর করেছেন সেলিম রেজা ও সাজেদা রেহানা।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জানুয়ারি ২০১৮/সাওন/রফিক
রাইজিংবিডি.কম