ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

সেই দিনটি আর এলো না অলকের জীবনে

ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৫১, ৩১ আগস্ট ২০২২   আপডেট: ১৪:৩৭, ৩১ আগস্ট ২০২২
সেই দিনটি আর এলো না অলকের জীবনে

দেশে বইছে টি-টোয়েন্টি ঝড়, সাদা পোশাকের ক‌্যারিয়ারে দাঁড়ি টানলেন অলক কাপালি। ২১ বছরের প্রথম শ্রেণির ও ২২ বছরের জাতীয় লিগের ক‌্যারিয়ারের ইতি ঘটালেন হুট করে। তরুণ ক্রিকেটারদের সুযোগ করে দিতে ও পরিবারকে সময় দেবেন বলে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ছাড়ার সিদ্ধান্ত। অবশ্য সীমিত পরিসরের ক্রিকেট চালিয়ে যাবেন। 

সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিল তার স্ট্রোক ব‌্যাটিং। শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মতো সুন্দর ছিল তার ব‌্যাটিং। নানা কারণে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তার আগায়নি। তবে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলে গেছেন শতভাগ নিবেদন দিয়ে। তাই তো নামের পাশে রয়েছে দশ হাজারের কাছাকাছি রান। তিনটি ডাবল সেঞ্চুরির দুটি করেছিলেন ২০১৪-১৫ মৌসুমে, ওইবার জাতীয় দলে ফেরার আশা দিয়েছিলেন এক নির্বাচক। কিন্তু সেই দিনটির অপেক্ষা ফুরোয়নি তার।

অলকের দীর্ঘ ক‌্যারিয়ারের অলিগলিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এমন নানা স্মৃতি, রাইজিংবিডির সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় ফিরে এলো সেসব গল্প- 

শেষ পর্যন্ত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটটা ছেড়েই দিলেন?

অলক কাপালি: অবসরের এই ভাবনাটা অনেক দিন ধরেই মাথায় ঘুরছিল। স্বাভাবিকভাবে আমাদের যেটা হয়, সিলেটে প্রচুর পেস বোলার বের হচ্ছে, কিন্তু আমরা ব্যাটসম্যান পাচ্ছিলাম না। জুনিয়র দুজন ব্যাটসম্যান রিয়াদ ও রাহাতুলকে খেলাতে পারছিলাম না। এই মুহূর্তে আমি খেলার মানে শুধু আমার রান বাড়ানো। আমার সিলেট বিভাগের কোনও কাজে আসছে না। তরুণ কেউ উঠে আসছে না। গত বছর আমাদের জাকি, অমিত, গালিব রান করেছে। এবার যদি নতুন কেউ এসে রান করে তাহলে অবশ্যই ভালো। আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট প্রতিযোগিতা শুরুর আগে অবসরের ঘোষণা দিয়ে দেব। দিনটাও বড় ছিল। এই দিনেই তো আমি হ্যাটট্রিক করেছিলাম। 

তাহলে কী হ্যাটট্রিকের দিনটিই আপনার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় দিন বলে বিবেচিত হচ্ছে?

অলক কাপালি: তা তো অবশ্যই। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে টেস্টে হ্যাটট্রিক করার আনন্দ তো বিশাল কিছুই। 

মাঠ থেকে বিদায় নেওয়ার ইচ্ছা কি ছিল না?

অলক কাপালি: মাঠ থেকে বিদায় নিলে ভালো হতো। কিন্তু মাঠে নামতে হলে আবার আমাকে খেলতে হতো। আমি খেলা মানেই আবার সেই সব তরুণদের সুযোগ কম আসতো। দেখা যেত, ১৫ জনেও আসতে পারছে না। কিন্তু আমি সরে গেলে হয়তো নেওয়া হবে। সব কিছু চিন্তা করেই আসলেই সিদ্ধান্ত নেওয়া। এখন কোচ, নির্বাচকরাও একটা সুযোগ পাবে কাউকে নিয়ে চিন্তা করার। 

বলেছেন তরুণদের সুযোগ করে দিতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত। সিলেট বিভাগে এই মুহূর্তে আপনার জায়গা নেওয়ার মতো ক্রিকেটার কি আছে?

অলক কাপালি: হ্যাঁ, হ্যাঁ আছে। আমি যখন সিলেট বিভাগের হয়ে প্রথম খেলি… প্রথম বিভাগে ভালো করার পর আমাকে নিয়ে আসা হয়। এখন সিলেটের প্রথম বিভাগে অনেক প্রতিশ্রুতিশীল ব্যাটসম্যান আছে যারা সুযোগের অপেক্ষায় আছে। আমি তাদেরকে লম্বা সময়ের জন্য সুযোগ দেওয়ার পক্ষে। এক-দুই ম্যাচ খেলে যেন কেউ বাদ না পড়ে।  

শেষ কয়েক মৌসুম ভালো যাচ্ছিল না। সবশেষ দুই মৌসুমে স্রেফ ৫টি ম্যাচ খেলতে পেরেছেন। অবসরের ভাবনা কি এগুলো থেকে এসেছে? 

অলক কাপালি: নাহ। তবে বিসিএলে যখন রান পাইনি, তখন একটু ভেবেছি। বিসিএলে কিন্তু আমি নিয়মিত পারফর্মার। বিসিএলে এক বছর ছাড়া আমি প্রতি বছর অনেক রান করেছি। একবার আমি সর্বোচ্চ রান করেছিলাম। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ করেছিল এনামুল। বিসিএলে আমার ডাবল সেঞ্চুরিও আছে। যখন আমি বিসিএল থেকে বাদ পড়ে যাই তখন আমার মাথায় একটু কাজ করছিল, হয়তো প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট আমাকে দিয়ে আর হচ্ছে না। তখন থেকেই আমার ভাবনায় এসেছিল, সুযোগ পেলে ছেড়ে দেবো। গত বছরও চেয়েছিলাম। ইনজুরির কারণে বাইরে ছিলাম। আমার চিড় ধরা পড়েছিল। শেষ ম্যাচটা আমাদের জন্য কঠিন ছিল। সবাই জোরাজুরি করেছিল খেলার জন্য। ম্যাচটা হারলে আমরা দ্বিতীয় স্তরে নেমে যেতাম। সবার কথা চিন্তা করেই তখন খেলে ফেলি। মূলত বিসিএলে দল না পাওয়াতেই আমার অবসরের ভাবনা আসে।

১০ হাজার রান করে অবসরে গেলে একটা পূর্ণতা থাকতো না?

অলক কাপালি: আমার টার্গেট ছিল ১০ হাজার রান করা। কিন্তু নিজের টার্গেট পূরণ করতে গেলে অন্যের ক্ষতি করা লাগতো। যেটা কখনোই চাইনি। বিসিএল না খেলার কারণে ম্যাচ কমে আসছিল। আগে বিসিএল খেলার কারণে প্রতি বছর ১০-১১টা ম্যাচ খেলতাম। রাত হতো অনেক। এছাড়া যদি শুধু জাতীয় লিগ খেলি, বৃষ্টির জন্য একটা পুরো ইনিংস বাদ পড়ে যায়। দেখা যেতো, পুরো মৌসুমে চার-ছয় ইনিংস খেলছি। এভাবে যদি খেলতাম তাহলে এক-দেড় বছর নষ্ট হয়ে যেত যে কারও। আমি খেললে অন্য খেলোয়াড়কে সুযোগ দেওয়া হতো না। জিনিসটা একটু অন্য রকম হতো। 

একটু ক‌্যারিয়ারের দিকে তাকাই। ২০১৪-১৫ মৌসুমে ১১৫৬ রান, ২০১৫-১৬ মৌসুমে ৭৯২ রান, ২০১৬-১৭ মৌসুমে ৮২৫ রান। কী অসাধারণ সব মৌসুম! তখন কী জাতীয় দলে একবারও আপনাকে ডাকা যেত না?

অলক কাপালি: ২০১৪-১৫ মৌসুমে আমি দুটি ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলাম। প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি যেটা করি, এরপর একজন নির্বাচক মাঠে ডেকে বলেছিলেন, ‘তুই ভালো খেলছিস। ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলতে থাক। সামনে ভালো দিন আসছে।’ স্বাভাবিকভাবেই আমার ভেতরে একটু কাজ করেছে যদি সামনে ভালো করতে পারি এবং নির্বাচকরাও যখন নজরে রেখেছেন হয়তো টেস্টে একটা সুযোগ আসতে পারে। 

কিন্তু কিছুদিন পর ঘটে আরেক ঘটনা। ওই আলোচনার এক ম‌্যাচ পরও কিন্তু আমি আবার ডাবল সেঞ্চুরি করি। পত্রিকার এক সংবাদিক ওই নির্বাচককেই আমাকে নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন যে, অলক রান করছে। তিন ম‌্যাচে দুই ডাবল সেঞ্চুরি। কোনও পরিকল্পনায় আছেন কি না? উনি তখন উত্তর দিয়েছিলেন এভাবে, ‘ও আমাদের প্ল‌্যান বি-তেও নেই।’ তখন একটু খারাপ লেগেছিল। কথাটা চাইলে তিনি অন‌্যভাবেও বলতে পারতেন। কিন্তু আমি তো সব সময় বলি, ২০১১ সালের পর আমাদের জাতীয় দলে ফেরা কঠিন হয়ে গেছে। আমি যেসব জায়গায় ব‌্যাটিং করি সেখানে অনেক প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড় আছে। কিন্তু কখনোই শুনবেন না আমি বলেছি, ওর থেকে আমি ভালো করছি বলে আমাকে ওই জায়গায় নিতে হবে।

কথার তো একটা ধরন থাকে, সৌন্দর্য থাকে। উনি বলতে পারতেন, ‘ও রান করছেন করুক। আমরা নজরে রেখেছি। সিনিয়রদের নিয়ে কীভাবে পরিকল্পনা করা যায় দেখছি।’ এটা কেমন দেখায় না! উনি আমাকে বলে গেছেন একটা, অথচ গণমাধ‌্যমে বলছেন আরেকটা।

আপনার কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে খুব মন খারাপ হয়েছিল, কষ্টটা কি এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন?

অলক কাপালি: এটাই তো স্বাভাবিক। দেখুন রান করা সহজ না। ভাগ‌্য লাগে, ভালো খেলতে হয়। আমি তখন ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলাম দুইটা। প্রচুর রানও করেছি ওই মৌসুমে। শুধু তাই না ২০১১ সালে জাতীয় দল থেকে বাদ পড়ার পর থেকে আমার পরিকল্পনা ছিল প্রতি বছর যেন আমার রান একটু একটু করে বাড়ে। আমি যেন রান করি, প্রিমিয়ার লিগে ভালো দল পাই, বিপিএলে ভালো দল পাই, এসব টার্গেট নিয়ে খেলেছি। ওভাবে খেলে খেলে ১০ বছর কাটিয়ে দিলাম। নিজে আরও পরিণত হয়েছি বলেই এখন ছেড়ে দিয়েছি। ওই কথা শোনার পর আসলে প্রেরণা কিছুটা কমে গেছে। নিজে থেকে ভাবতাম, এখন তো শুধু খেলার জন‌্য খেলা। এটাই আর কী!

২০০০ সাল থেকে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছেন। প্রথম ম্যাচের কথা কি মনে আছে কিছু? প্রথম সিলেট দলে ডাক পাওয়া, প্রথম জার্সি পাওয়া… তখন তো বিভাগীয় দলে খেলাও বিরাট কিছু?

অলক কাপালি: হ্যাঁ, আমার সব মনে আছে। আমার সিলেট বিভাগে আসার ঘটনাটা খুব মজার। শান্ত ভাই (হাসিবুল হোসেন শান্ত) যখন বিভাগীয় দলে খেলতেন। আমি তখন শুধু প্রিমিয়ার লিগে। শান্ত ভাইয়ের তখন কোকাকোলার ট্র‌্যাকশুট ছিল একটা। ওইটা বাংলাদেশ দলের সবারই ছিল। কালো রঙের সেই ট্র‌্যাকশুট পরে শান্ত ভাই সিলেটে খেলতে আসতেন। তখন মনে মনে ভেবেছি, ইশ! এটা যদি একদিন পরতে পারতাম। আমার খুব ভালো লেগেছিল দেখেই। তারপর আমার নিজে নিজে নিজেই চিন্তা করেছি.. এটা তো আর উনার থেকে নেওয়া যাবে না। দেখি একটা টার্গেট করি, আমি যদি কোনও দিন বাংলাদেশ দলে খেলতে পারি তাহলে আমারও এরকম একটা ট্র্যাকশুট থাকবে। মূলত তখন থেকেই আমার জাতীয় লিগে খেলার টার্গেট করি। আবার আমার জাতীয় লিগে প্রথম ঘটনাও অনেকটা হুটহাট। তখন সিনিয়র ক্রিকেটাররা বিদ্রোহ করেছিল বোর্ডের বিরুদ্ধে। খেলোয়াড়রা খেলবেন না বলে সরে আসে। তখন আমি দ্বিতীয় বিভাগ লিগে। সেখান থেকে আমাকে নিয়ে জাতীয় লিগে খেলানো হয়। 

সেই ট্র্যাকশুট কি পরে আর পেয়েছিলেন?

অলক কাপালি: সেটাই পাইনি। জাতীয় দলে ঢোকার পর অন‌্যগুলো তো পেয়েছি (হাসি)। 

জাতীয় দল থেকে তো বাদ পড়েছিলেন অনেক আগে। বয়সও এখন অনেক বেড়েছে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট চালিয়ে যাওয়ার প্রেরণা কীভাবে পেয়েছেন? 

অলক কাপালি: আমাদের যারা টিমমেট ছিল তাদের কথা সবার আগে বলবো। ওরা আমাদের এতটা প্রেরণা দিয়েছে যেটা বলার ভাষা নেই। সিলেট টিমটাকে এগিয়ে নেওয়ার জন‌্য আমাদের রীতিমতো একটা মিশন ছিল। আমাদের ফিটনেসের একটা লেভেল দেওয়া ছিল। ওইটাকে আমরা চ‌্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম। আমি ব‌্যক্তিগতভাবে জুনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে টক্কর দিতাম। যেমন, আমাদের বিপ টেস্ট দেওয়া হয়েছিল ১০.৫। আমি সেটা ১২ এর উপরে নিয়ে গিয়েছিলাম। গত বছর ইয়ো ইয়ো টেস্টে ১৬.৫ দেওয়া হয়েছিল, আমি ১৮.৫ করেছিলাম। আমার কথা হলো, আমি ফিটনেস নিয়ে সচেতন। কেউ যেন বলতে না পারে আমার ফিটনেস খারাপ। এজন‌্য ওকে নেওয়া হয়নি বা এরকম কিছু। এজন‌্য সব সময় নিজেকে ফিট রেখেছি। আর পারফরম‌্যান্সের কথা বললে, কোচদের সরাসরি বলতাম, আমাকে নিয়ে যদি আপনার চিন্তা না থাকে আমাকে অফ করে দেন সঙ্গে সঙ্গে। অনেক সময় এটা হয়েছে। সেটা থেকে আমি আবার বেরিয়েও এসেছি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটটা আামি উপভোগ করতাম। আমি খেললে রাহী, তান্না, ইবাদত, রাজু, জাকির এরা খুশি হতো। খুব ভরসা করতো। এই ভরসা, আস্থা থেকেই আমার খেলা, পারফর্ম করা। 

বাংলাদেশ ক্রিকেটের বাঁক বদলের বিভিন্ন সময়ের স্বাক্ষী আপনি। কোন সময়টাকে মনে হয় বাংলাদেশ খুব ভালো সময় কাটিয়েছে? 

অলক কাপালি: প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট নিয়ে আমরা শুরুতে না দেখেই মন্তব‌্য করতাম। পিকনিক ক্রিকেট, এই ক্রিকেট, সেই ক্রিকেট এসব বলে মন্তব‌্য হতো। এটার পেছনে কারণও ছিল। ওই সময়ে আমাদের যে সুযোগ-সুবিধা ছিল তা বলা মতো ছিল না। এখন সেটা পরিবর্তন হয়েছে। সুযোগ সুবিধার উন্নতি হওয়ায় মাঠে খেলার মানও বেড়েছে। আগে তিনদিন বা দুইদিনে খেলা শেষ হতো। এখন তো হাড্ডাহাড্ডি খেলা হয়। ম‌্যাচের শেষ সেশনে গিয়ে ম‌্যাচের ফল হয়। আবার শেষ রাউন্ডে গিয়ে নির্ধারণ হয় কে চ‌্যাম্পিয়ন হবে, কে হবে না! এই পরিবর্তনটা আমি মনে করি ২০০৭ সালের পর থেকে শুরু হয়। প্রথমত, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে সেই জয় এবং দ্বিতীয়ত, ভারতকে বিশ্বকাপের ম‌্যাচে হারানো। আমার মনে হয় ওই সময়ে বাংলাদেশের সব ক্রিকেটাররা ভাবতে শুরু করেছে যে নিজেদের উন্নতির জন‌্য ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো খেলা জরুরি। ওই সময়ের পর কখনও মনে হয়নি যে আমরা পিকনিক টুর্নামেন্ট খেলতে এসেছি। আমরা নিজেদের মধ‌্যে আলোচনা করতাম, এই প্রথম শ্রেণির রেকর্ড কেউ কারও থেকে নিতে পারে না। নিজের রেকর্ড নিজের থাকে। তাই উন্নতিটা নিজের করতে হবে। 

দীর্ঘ সময় আপনার খেলা কঠিন বোলার কে? যাকে খেলতে সত্যিই আপনি ভুগেছেন?

অলক কাপালি: সবার সঙ্গেই তো খেলা হয়েছে। তবে বলা মুশকিল কে কঠিন ছিল। সবার বিপক্ষেই তো খেলেছি। তবে বিসিএলে একবার শফিউল ইসলাম আমাকে খুব ভুগিয়েছিল। ওকে দেখলে মনে হয় ছিমছাম। কিন্তু বোলিং দেখলে তা বোঝার উপায় নেই। সুইং বোলার সে। গতিও ছিল। ওকে খেলতে আমার একটু সমস‌্যা হতো।   

২০টি সেঞ্চুরি আছে। প্রথম সেঞ্চুরির কথা কি মনে আছে? 

অলক কাপালি: একদম মনে নেই। শেষটাও মনে হয় ভুলে গেছি। 

তিনটা ডাবল সেঞ্চুরি আছে আপনার- ২২৮, ২১১ ও ২০০। কোনটা আপনার খুব পছন্দের? 

অলক কাপালি: আমার প্রথমটা খুব পছন্দের। ডাবল সেঞ্চুরির ইচ্ছা ছিল দীর্ঘদিনের। তাই প্রথমটাই আমার খুব কাছের। ওইটা থেকে পাওয়া আত্মবিশ্বাস থেকেই আমার বাকি দুইটা ডাবল সেঞ্চুরি হয়েছে।  

আপনার ব্যাটিং নিয়ে বরাবরই মানুষের খুব আগ্রহ ছিল। বিশেষ করে আপনার ব্যাটিং স্টাইল। যেভাবে ব্যাটিং করতেন চোখ জুড়িয়ে যেতো। কভার ড্রাইভ, স্ট্রেইট ড্রাইভ, গ্লান্স, পুল সব কিছুই তখন বাংলাদেশের ক্রিকেটে সময়ের চেয়ে আগানো ছিল। এতটা স্টাইলিশ ব্যাটসম্যানের পেছনের রহস্য কী ছিল। কীভাবে রপ্ত করেছিলেন?

অলক কাপালি:  আমি সব সময় অনুসরণ করতাম শচীন টেন্ডুলকারকে। উনি আমার আইডল ছিলেন। তার মতো করে খেলার চেষ্টা করেছি শুরু থেকেই। আমার স্ট্রেইট ড্রাইভ ভালো হওয়ার কারণ আছে। বাগবাড়িতে যে মাঠে আমরা খেলেছি ওখানে লেগ সাইডে অফ সাইডে উড়িয়ে মারলেই আউট বা মাইনাস রান। এলাকার খেলার নিয়ম যে রকম থাকে। ওখানে রান করতে হলে খালি স্ট্রেইটে খেলতেই হতো। স্ট্রেইটেই চার আর ছয়। তাই সব সময় আমাকে সোজা ব‌্যাটে খেলতেই হতো। ওই অভ‌্যাস পরেও টিকে থাকে।   

নিজের ব্যাটিং নিয়ে আপনার নিজের মূল্যায়ন কী? দশে কত দেবেন?

অলক কাপালি: সর্বোচ্চ ৫। যদি বেশি দেই তাহলে ভুল হবে। আমাকে নিয়ে মানুষের যে প্রত‌্যাশা ছিল সেটা তো আমি পূরণ করতে পারিনি। এজন‌্য দুঃখ প্রকাশ করছি। 

একবার সাকিব আল হাসান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এমন একজন ব্যাটসম্যানের নাম, যার যেখানে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু যেতে পারেনি। এজন্য নিজেরই আক্ষেপ লাগে। সাকিব উত্তরে আপনার নাম বলেছিলেন। আপনি কি নিজে সেটা বিশ্বাস করেন? 

অলক কাপালি: সাকিব নিজেও আমাকে এটা বলেছে। খুব আফসোসও করেছে। বলেছিল একবার, আমার মধ‌্যে ব‌্যাটিংয়ের যে সামর্থ‌্য ছিল সেই অনুযায়ী আমার ক‌্যারিয়ার বড় হয়নি। আসলে আমার নিজেরও আফসোস হয়। যেভাবে আমি শুরু করেছিলাম সেভাবে আমি কিছুই করতে পারিনি। 

ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে আপনি ফিল্ডার হিসেবে তো তুখোড় ছিলেন। আপনার ও রাজিনের আশপাশে বল যাওয়া মানে নিশ্চিত রান বাঁচানো। দৌড়াতেন ক্ষিপ্রতায়। কাকে অনুসরণ করতেন ফিল্ডিংয়ে? 

অলক কাপালি: জন্টি রোডসকে। তাকে দেখেই আমি শিখেছি। পরে হার্শাল গিবসকেও পছন্দ হয়েছিল। ২০০৪ সালে মিনি বিশ্বকাপে ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ও তখন আমার ফিল্ডিংয়ের প্রশংসা করেছিল। চেষ্টা করতাম সব সময়। কঠিন জায়গায় ফিল্ডিং করে রান বাঁচানোর চেষ্টা করতাম। 

যদি পেছনে ফিরে তাকান, এমন কোনও ভুল কি করেছেন যেটা এখন তরুণদের করতে মানা করবেন?

অলক কাপালি: না, এরকম কোনও ভুল করিনি। আমি শেষ ম‌্যাচ যেটা খেলেছি, সেটায় ২৫ বলে ৩০ রান করেছিলাম। ওই ইনিংস নিয়ে আমার আফসোস আছে। তখন আমি স্ট্রোক খেলতাম। ওই ম‌্যাচেই ম‌্যাথু হোগার্ডকে ৬ বলে ৫টা চার মেরেছিলাম। পরের ওভারে বেটিকেও একটা চার। তখন হঠাৎ আমার মনে হলো বেশি স্ট্রোক খেলছিল। এখন ধরে খেলা উচিৎ। ওই ভাবনা থেকে ব‌্যাটিং করতে গিয়ে অফস্টাম্পের বাইরের বলে আউট হই। ওইদিন যদি নিজের ওই নেতিবাচক ভাবনা না আনতাম তাহলে ওই ইনিংসটা ৩০ রান না হয়ে ৭০-৮০ রান হতে পারতো। এরকম ভাবনা যেন তরুণরা না করে সেজন‌্য ওদেরকে এগুলো বুঝাই। স্রেফ নিজের মন কী বলে সেভাবেই খেলতে বলি।  

সিলেটের ক্রিকেটের উন্নয়নে কীভাবে কাজ করার ইচ্ছা আছে? 

অলক কাপালি: সিলেটের ক্রিকেট উন্নয়নে কাজ করছি আগে থেকেই। আমাকে যখন যে ডাকে, তার ডাকেই সাড়া দেই। এখন বড় পরিসরে কাজ করার ইচ্ছা আছে। সিলেট বিভাগ আমাকে ডাক দিলে অবশ‌্যই পাশে থাকবো। 

এখন কি ঢাকা লিগ, বিপিএল খেলবেন? কতদিন চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে?

অলক কাপালি: ঢাকা লিগে আগামী মৌসুমে দল নিশ্চিত হয়েছে। প্রাইম ব‌্যাংকেই খেলবো। বিপিএল খেলা তো দল পাওয়ার ওপর নির্ভর করে। ফিট থাকলে এক দুই বছর খেলার ইচ্ছা আছে। যখন মনে হবে আর শরীর সাড়া দিচ্ছে না, তখন সরে দাঁড়াবো। 

ঢাকা/ফাহিম

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়