আরব জোট ও হুজুগে বাঙালি
রহমান সিদ্দিক || রাইজিংবিডি.কম
রহমান সিদ্দিক : বাঙালির অনেকগুলো জাতধর্মের মধ্যে হুজুগ একটি। হুজুগে বাঙালি প্রবাদটি তো আর এমনি এমনি তৈরি হয়নি। কোনো একটি ঘটনা ঘটেছে কিনা, তা নিশ্চিত না হয়ে একটু আভাস পেলেই তুলকালাম ঘটিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বাঙালির জুরি নেই। এই হুজুগে কারণেই প্রাচীনকালের অনেক বিদেশি পরিব্রাজক পলিমাটির উর্বর এই ভূখ-টিকে দারুল হরব বা অশান্তির দেশ বলেছেন। নিরক্ষর আম-জনতা হুজুগে মাতবে এতে দোষের কিছু নেই, কিন্তু রাষ্ট্র যখন একই পথে পা বাড়ায় তখন চিন্তার বিষয় বইকি। রাষ্ট্রের সম্প্রতি হুজুগে কর্মকাণ্ড নিয়ে আলাপ করার আগে হুজুগ কী জিনিস তার একটি পরিচয় জানা থাকলে ভালো হয়।
আরবি হুজম বা হজ্জৎ থেকে আসা হুজুক বা হুজ্জুক বা হুজুগ শব্দের আক্ষরিক অর্থ গোলমাল বা বাকবিতণ্ডা। অন্য অর্থ জনরব বা রটনা। এমন অর্থ করেছেন জ্ঞানেন্দ্র মোহন তার বাংলা ভাষার অভিধানে। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এসব সংজ্ঞা খুব একটা মনে ধরেনি। ঠাকুর মশাইয়ের কিছু শব্দ নিয়ে খুতখুতানি ছিল। এসব শব্দের অর্থ বা সংজ্ঞা মনের মতো না হলে তিনি সুস্থির বোধ করেন না। এরকই তিনটি শব্দ- হুজুগ, ন্যাকামি ও আহ্লাদির জুতসই অর্থ জানার জন্য ১২৯২ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যার বালক পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দেন রবীন্দ্রনাথ। যিনি এসব শব্দের ভালো অর্থ বা সংজ্ঞা দিতে পারবেন, তাকে পুরস্কৃত করা হবে। হুজুগ নিয়ে যে সংজ্ঞাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করেছেন, তা হলো, ‘মাথা নাই মাথাব্যথা গোছের কতগুলো নাচুনে জিনিস লইয়া যে নাচন আরম্ভ হয়, সেই নাচনের অবস্থাকে হুজুগ বলে; বিশেষ কিছু হয় নাই অথবা অতি সামান্য একটা কিছু হইয়াছে আর সেইটা লইয়া সকলে নাচিয়া উঠিয়াছে, এই অবস্থার নাম হুজুগ।’
এবার আসি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুরস্কারের নির্বাচিত হুজুগের সংজ্ঞার সঙ্গে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির হুজুগে কর্মকা-ের মিল কোথায়। সম্প্রতি সৌদি নেতৃত্বাধীন কয়েকটি ইসলামি দেশের সামরিক জোটে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ। কোনো আগপিছ না ভেবেই এই যোগদানকে বিদ্যাসাগরের ভাষায় বলতে হয়- সৌদির আরবের প্রস্তাব পাইয়া সরকার যাৎপরনাস্তি আহ্লালাদি হইয়া উঠিল। সৌদি জোটে যোগ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের এ হুজুগে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ কী? এই হুজুগ কি কেবল আহ্লাদির জায়গা থেকে? লম্বা-চওড়া শেখেরা ডেকে পিঠ চাপড়ে অনুরোধ করাতে কি আহ্লাদি হয়ে উঠতে হবে? তা হোক, কিন্তু দেশে জাতীয় সংসদ বলে একটা জিনিসের অস্তিত্ব আছে। সেখানে কোনো ধরনের আলোচনা বা সংসদের অনুমোদন না নিয়ে গোপনে গোপনে এ ধরনের চুক্তি আসলে কিসের ইঙ্গিত বহন করে। আর এ জোটের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য বা কৌশলগত দিক নিয়ে সরকারের তরফ থেকে জনগণকে কোনো কিছু জানানো হয়েছে বলেও শোনা যায়নি।
গত ১৫ ডিসেম্বর সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে ৩৪টি সুন্নিপ্রধান মুসলিম দেশ নিয়ে এই সামরিক জোট গঠিত হয়। অথচ এত বড় একটি জোটের কর্মপরিকল্পনা ও তার কৌশলগত দিক নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনাই হয়নি। বাংলাদেশকে দাওয়াত দেওয়া হলো- আর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ‘ধর তকতা মার পেরেক’ গোছের একটি চুক্তিতে সই করে এলেন। যেখানে ইন্দোনেশিয়ার মতো সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ, কিংবা মালয়েশিয়ার মতো সমৃদ্ধ একটি দেশ যোগ দিতে রাজি হয়নি, সেখানে বাংলাদেশ তড়িঘড়ি করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার অর্থটা কী। এ ধরনের দৃষ্টান্ত থেকে একটি জাতির হীনমন্যতাই প্রকট হয়ে ওঠে। অথচ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের মাথাটা আরো উঁচুতে রাখার কথা ছিল।
সৌদি আরবের নেতৃত্বে এই জোট নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে এই জোট গঠিত হওয়ার কথা বলা হলেও শুধু সুন্নি রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে কেন। শিয়াপ্রধান রাষ্ট্রগুলো কি সন্ত্রাসী হুমকির বাইরে? ইসলামিক স্টেট (আইএস) নামক ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের দাপটে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সিরিয়া ও ইরাকের। এ দুটি দেশসহ ইরানকে বাইরে রেখে এ ধরনের জোটের উদ্দেশ্য নিয়ে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগবে। তাহলে কি সৌদি আরব নিজেকে রক্ষার জন্য অন্যকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে? প্রশ্নটা কেবল এখানেই সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না; যেহেতু পশ্চিমা মদদে এই জোট গঠিত হয়েছে, এর উদ্দেশ্যও সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। আর পশ্চিমারা যখন কোনো বিষয়ের মদদ দেয়, সেখানে একটি গভীর ষড়যন্ত্র লুকিয়ে থাকে। কোনো আলাপ-আলোচনা না করে বাংলাদেশ কেন তাদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিতে গেল।
তাত্ত্বিকভাবে সৌদি জোটে বাংলাদেশের যোগ দেওয়া নিয়ে যেমন প্রশ্ন থেকে যায়; নৈতিকভাবেই বড় ধরনের অবিবেচক কা- বলেই প্রতীয়মান হয়। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে থেকেই রাজকার্য পরিচালনা করতে হয়, সেটা অভ্যন্তরীণ হোক; হোক বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে। এর ব্যত্যয় হলে রাষ্ট্র চলে সত্যি, কিন্তু তার নৈতিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়। সৌদি জোটে যোগ দিয়ে এ সরকার কেবল সংবিধানকেই কটাক্ষ করেনি, স্বাধীনতার মৌল ভিত্তিতেও আঘাত হেনেছে। সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদটি পর্যালোচনা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
কী আছে ২৫ অনুচ্ছেদে? ‘জাতীয় সার্বভৌম ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইনের ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা- এই সকল নীতি হইবে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি এবং এই সকল নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র-
(ক) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করিবেন; (খ) প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করিবেন; এবং (গ) সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ, বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন।’
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে ২৫ অনুচ্ছেদে বিষফোঁড়ার মতো একটি অতিরিক্ত দ্বিতীয় ধারা সন্নিবেশিত ছিল। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান সামরিক আইন দ্বিতীয় প্রজ্ঞাপন দ্বারা ‘(২) রাষ্ট্র ইসলামি সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবে।’- এই দফাটি সংযোজিত করে। এই সরকারের বড় কতিত্ব পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই উদ্ভট ধারাটি বিলুপ্ত করে সংবিধানকে বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ অবস্থানে প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সম্প্রতি আরব জোটে যোগদান করার মধ্য দিয়ে প্রচ্ছন্নভাবে যেন ২৫ অনুচ্ছেদের বিলুপ্ত দ্বিতীয় ধারাটি আবারও ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল একটি ন্যায়সঙ্গত দাবি, যা উনিশ একাত্তরে এর চূড়ান্ত পরিণতি পায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রত্যেকটি জাতির ন্যায়সঙ্গত দাবি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি সংহতি জানিয়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি সংরক্ষিত, যা সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদে সন্নিবেশিত হয়েছে। সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় চরিত্রের সঙ্গে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চরিত্রের মিলই নেই। এ ছাড়া বর্তমানে সৌদি জোটের ইয়েমেনে শিয়া সম্প্রদায়ের হুতি বিদ্রোহীদের লক্ষ্য করে বিমান হামলা তাদের আগ্রাসী নীতিরই বহিপ্রকাশ। অথচ সৌদি জোটের সে হামলাকেও বাংলাদেশ সমর্থন জানিয়েছে, যা অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর সামিল।
প্রশ্ন হলো শিয়া ক্ষমতাসীন দেশগুলোকে বাইরে রেখে এমন সামরিক জোট কেন? এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, ইরানসহ শিয়া দেশগুলোই ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য দাবির প্রতি সোচ্চার থেকেছে। বরং সৌদি আরব ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে ফিলিস্তিনের একের পর এক ভূমি দখলে এবং বিভিন্ন সময় দেশটির নাগরিকদের হত্যায় সহায়তা করছে। আর বিশ্বব্যাপী মুসলিম জঙ্গিবাদের উত্থান, তার গোড়াপত্তন সৌদি আরব থেকেই। সৌদি বিশ্বব্যাপী ওয়াহাবি মতবাদ ফেরি করে সন্ত্রাসের বীজ বপন করেছে; এই বীজ থেকে চারা গজিয়ে তাদেরই পরিচর্যায় হৃষ্টপুষ্ট হয়ে আল কায়েদা বা ইসলামিক স্টেট নামক মহিরুহের জন্ম হয়েছে।
প্রশ্ন রয়েছে ন্যাটোর সদস্য তুরস্কের সৌদি যোগ দেওয়া নিয়েও। কুর্দিরা দীর্ঘদিন থেকে তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবিতে লড়াই করে আসছে। আর বন্দুক কামান নিয়ে কুর্দিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে তুর্কি বাহিনী। একে একে হত্যা করা হচ্ছে কুর্দি বিদ্রোহীদের। অথচ আমাদের সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কুর্দিদের দাবির প্রতি সংহতি জানানোটা জরুরি ছিল। অথচ আমরা করছি তার উল্টোটা। এসব প্রান্তিক ও নিপীড়িত জাতির দাবিকে যারা গলা টিপে হত্যা করছে, আমরাও তাদের কাতারে সামিল হচ্ছি। এ সবই করছি সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে।
আমাদের কর্তাব্যক্তিরা অনেক সময় তাদের সাড়ে তিন ইঞ্চি গলাটিকে তেত্রিশ ইঞ্চি লম্বা করে সংবিধান নিয়ে কথা বলে থাকেন। অথচ নানা সময়ে সংবিধান লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটলেও তারা টু শব্দটিও পর্যন্ত করেন না। সংবিধান কেবল পাঁচ বছর পরপর জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের মাধ্যম নয়; এর সঙ্গে জড়িত জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, কিন্তু যারা সাংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতায় এসেও সংবিধান লঙ্ঘন করছেন, তাদের বেলায় কী হবে? আশার কথা হলো আরব সামরিক জোটে বাংলাদেশের যোগ দেওয়া নিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদ নিয়ে কথা বলেছেন। আশা করছি সংসদের বাইরেই কেবল নয়, ভেতরেও এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হবে। সংসদে গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমেই সৌদি জোটে যোগ দেওয়া না দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। শুধু হুজুগের বসবতী হয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিলে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত এই রাষ্ট্রটিকে ভবিষ্যতে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ ডিসেম্বর ২০১৫/বকুল
রাইজিংবিডি.কম