ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বিজন দ্বীপের স্বরলিপি: ২য় পর্ব

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:০৬, ২ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৭:৩৮, ২ ডিসেম্বর ২০২০
বিজন দ্বীপের স্বরলিপি: ২য় পর্ব

রাস্তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আলোকসজ্জা। দু’পাশে আধুনিক রেস্টুরেন্ট

লম্বা এক ঘুমের পর এলার্ম বেজে ওঠার আগেই ঘুম ভেঙে গেল। যথারীতি প্রস্তুতি পর্ব সেরে নিচে যেতেই অভিবাদন জানিয়ে অভ্যর্থনা ডেস্ক থেকে বাসের টিকিটের সঙ্গে জামানতস্বরূপ জমা নেওয়া পাঁচ ডলার ফিরিয়ে দেওয়া হলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর আমাকে নেওয়ার জন্য একটা অদ্ভুত বাহন এসে হাজির! সামনে একটা মোটরসাইকেল এবং তার পেছনে জুড়ে দেওয়া স্কুটারের মতো অংশ- দারুণ উড়ালপঙ্খী!

স্থানীয়ভাবে বাহনটি ‘টুকটুক’ বলে পরিচিত। এই সেবা আমার ভীষণ পছন্দ হলো। যাত্রীদের যার যার ঠিকানা থেকে তুলে আনা হয় বাস ছাড়বার জায়গায়। এমন সেবার পরিপ্রেক্ষিতে নিজে খানিকটা সম্মানিত বোধ করলাম। আমি প্রথম ধাপের যাত্রী। অন্যান্যদের এখনও আনা চলছে। বাস ছাড়বে সাড়ে সাতটায়। এই ফাঁকে আমি নাস্তা সেরে নেওয়ার সুযোগ পেলাম। যাত্রা পথে আকর্ষণীয় কোনো সৌন্দর্যের সন্ধান পেলাম না। মাঠ আর হঠাৎ জনপদের মাঝ দিয়ে দীর্ঘ পথ। পথের আনেকটুকুর উভয়পাশ জলমগ্ন। পথে মধ্য বিরতির সময় দেখা হয় মাইক্রোবাস ভর্তি একদল বালাদেশি পর্যটকের সাথে। আমাকে নিয়ে তাদের অনেক কৌতূহল। একা বেরিয়েছি নাকি সাথে অন্য কেউ আছে; খাওয়াদাওয়ার কি অবস্থা; এখানে তো হালাল খাবার নেই; থাকার জায়াগা ঠিক করা আছে কিনা ইত্যাদি। তারা সিয়াম রেপ থেকে ফিরছে আর আমি যাচ্ছি।

সাপ, বিচ্ছু এবং মাকড়সা ভাজা বিক্রি চলছে

সিয়াম রেপ পৌঁছে যে ভুলটা করলাম তার মাশুল দিতে গিয়ে শরীর থেকে বোধহয় দুই লিটার ঘাম ঝরাতে হলো। ভ্রমণের আগে প্রাক-অধ্যায়ন করতে জেনেছিলাম বাসস্ট্যান্ড থেকে দশ থেকে পনেরো মিনিটের মধ্যে হেঁটেই শহরের প্রাণ কেন্দ্রে যাওয়া যায়। বিলকুল একটা ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে হাঁটা শুরু করলাম। আধাঘণ্টা পরও কূল-কিনারা না করতে পেরে একটু হতাশ হয়ে পড়লাম। তীব্র রোদে সড়ল রেখার মতো রাস্তার বুকে জ্বলজ্বল করে কাঁপছে মরীচিকা। কোনো যানবাহনের অস্তিত্ব নেই। পথের ধারের মানুষগুলো নির্ভরযোগ্য তথ্য দিতে পারে না। রাস্তার অপর পাশ থেকে এগিয়ে এলো একটা মোটরসাইকেল। গন্তব্যের কথা জেনে নিয়ে ভাড়া দাবি করল এক ডলার। উপায় না দেখে চেপে বসলাম। নামিয়ে দিলো সকসন রোড হ্যাংওভার হোস্টেলের প্রবেশ দ্বারে। আমি ভেবেই পেলাম না মোটরসাইকেলটা না পেলে আড়াই-তিন কিলোমিটারের এই উত্তপ্ত পথ কিভাবে পাড়ি দিতাম!

এখানকার ডরমেটরি উন্নত। জায়গা হলো দুইতলা বিছানার উপর তলায়। কনকনে ঠান্ডা ঘরটাতে ঢোকার সাথে সাথে শিরায় শিরায় কি যে শান্তি ছড়িয়ে পড়ল তা বর্ণনার অতীত! খানিক বাদে বেরিয়ে পড়লাম খাবারের সন্ধানে। সামান্য হেঁটে পেছনের দিকটাতে গিয়ে পেয়ে গেলাম আমার জন্য উপযুক্ত জায়গা। উপযুক্ত জায়গা বলতে- ভাতের দেখা পেলে লাঞ্চে আমি সাধারণত অন্য কিছু খেতে চাই না। ভাতের সঙ্গে মুরগির মাংসের ঝোল। অন্যান্য যে খাবারগুলো সাজানো তা থেকে দুই একটা পদ পরীক্ষা করার জন্য নিলাম কিন্তু পোষাল না। খাবার শেষে দেখি একটা পাত্রে কালোজাম মিষ্টির মতো কিছু একটা সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা। পেট পুরে ভাত খাওয়ার পর একটা মিষ্টি হলে মন্দ হয় না। এক কামড় দেওয়ার পর কি বলবো ভাষা খুঁজে পেলাম না, তবে মনোস্থির করলাম, অন্তত এই জিনিসটি দ্বিতীয়বার আর নয়। এক থালি ভাত আর এক বাটি মুরগির মাংস মাত্র দেড় ডলার। প্রতি ডলার সমান চার হাজার রিয়াল। এখানে একটা বিশেষ সুবিধা হলো, যে কোনো ধরনের লেনদেনে স্থানীয় মূদ্রা রিয়ালের পাশাপাশি ইউএস ডলার সমানভাবে কার্যকর। সুতরাং মানি এক্সচেঞ্জে যেতে হয় না।

রাতে এই রাস্তায় জমে ওঠে পর্যটন নগরীর আসল রূপ

হোস্টেলে ফিরে আবারও কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম। তারপর বেরিয়ে পড়লাম রাতের সিয়াম রেপ দেখার জন্য। হোস্টেল থেকে ডান দিকে কিছুদূর এগিয়ে গেলে রাস্তার অপর পাশে অতি সাধারণ অথচ সুদৃশ্য এক রেস্টুরেন্ট। ইচ্ছা হলো কফি পান করি। উন্মুক্ত জায়গা, কোণার টেবিলটাতে বসে পড়লাম। গাছের আস্ত একটা গুঁড়ি দিয়ে বানানো টেবিল। টবে বেড়ে ওঠা পাম গাছের কয়েকটা কঁচি পাতা টেবিলের উপর ঝুকে পড়েছে। চেয়ার তিনটি থাকলেও মানুষ শুধু আমি একা। মনে হলো কোনো অরণ্যে বসে আছি। সামান্য নাস্তার সাথে পানীয়, সময় খুব সুন্দর কাটতে লাগল। মনে হলো আরও একবার পান করা যেতে পারে। খাবার পরিবেশনকারী নারীকে ইশারা করতেই এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন আর একটা দেব? সে যেন আমার মনের কথা অগে থেকেই জেনে রেখেছে। পরের দিনের গন্তব্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সমৃদ্ধ ‘আঙ্কোর আর্কিওলজিক্যাল পার্ক’। সে জন্য চাই বাইসাইকেল। তার কাছ থেকেই তথ্য পেলাম কোথায় গেলে ভাড়ায় সাইকেল পাওয়া যেতে পারে।

হ্যাঁ, সাইকেল একটা সইসারা হলো, প্রতিদিন দুই ডলার। শর্ত, পাসপোর্ট জমা রাখতে হবে। তা তো হবে না! কারণ আর যাই হোক, আমি এই জিনিস দিয়ে কোনো প্রকার সওদা না করতে বদ্ধপরিকর। হুট করে শর্তটা ছুরে দিলেও আমার মুখোচ্ছবি দেখে সে বোধহয় কিছু আন্দাজ করতে পারল। পরোক্ষণেই নিজ থেকে বললো, ঠিক আছে পাসপোর্ট লাগবে না, জাতীয় পরিচয়পত্র ধরনের কিছু থাকলে তাতেই চলবে। সংশোধিত প্রস্তাবটি আমার পছন্দ হলো। এবার একমত না হয়ে পারলাম না। সকসন রোডের মুখে জটলা লেগেই থাকে। সেখান থেকে একজন ইশারা দিয়ে জানতে চাইলো কোথাও যাব কি না? ‘না’ বলার পরও তার পুনরায় আহ্বান- চলুন না ঘুরিয়ে নিয়ে আসি! এ ঠিক সেই লোক যে লাঞ্চে যাওয়ার সময়ও এগিয়ে এসেছিল কোথাও নিয়ে যাবে বলে।

স্থানীয়ভাবে বাহনটি ‘টুকটুক’ বলে পরিচিত

রাতের সিয়াম রেপ বলতে পাব স্ট্রীট। এই রাস্তায় জমে ওঠে পর্যটন নগরীর আসল রূপ। রাস্তার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মৃদু আলোকসজ্জা। তার মাঝে উভয় পাশে আধুনিক রেস্টুরেন্ট। কোনো কোনো রেস্টুরেন্টের চেয়ার-টেবিলের বহর চলে এসেছে ফুটপাথ ছাপিয়ে খোদ রাস্তায়। সমস্ত এলাকা লোকে লোকারণ্য। সারা পৃথিবীর পর্যটকে কানায় কানায় পূর্ণ। টেবিলে টেবিলে খদ্দেরের সম্মুখে বিয়ার ভর্তি নানা রঙের কাচের গ্লাস। কারোটা থেকে ফেনা উবে পড়ছে তো কারোটাতে চলছে ছোট ছোট চুমুক। এরই মধ্যে মুখের সামনে হঠাৎ আবিষ্কার হলো এক বালক। সে সাপ, বিচ্ছু এবং মাকড়সা ভাজা বিক্রি করছে। গলায় ঝুলানো টিনের ট্রের উপর জিনিসগুলো সুন্দর করে সাজানো। ট্রের সামনে একটা সাদা কাগজ ঝুলছে। তাতে লেখা প্রতি পিস এক ডলার এবং ছবি তুলতে প্রতি ক্লিকের জন্য পঞ্চাশ সেন্ট। ক্যামেরা আমার হাতে চালু করাই আছে। অতএব, টপাটপ কয়েকটা ছবি তুলতে এতটুকুও দেরি করলাম না। খেয়াল করলাম কেনার চেয়ে তার কাছে ফটোগ্রাফারদের ভিড়ই অধিক। (চলবে)

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়