ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

সমুদ্রের বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য পাহাড়

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২৬, ৫ নভেম্বর ২০২১   আপডেট: ১৫:৪৬, ৫ নভেম্বর ২০২১
সমুদ্রের বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য পাহাড়

(বিজন দ্বীপের স্বরলিপি: ১৫তম পর্ব)

কাউন্টার খোলার সঙ্গে সঙ্গে টিকিট কেটে নিলাম। এক-দু’জন করে যাত্রীর আগমনে ধীরে ধীরে জায়গাটাতে প্রাণের সঞ্চার হলো। আমার দুই সহযাত্রীও হাজির। কিছুক্ষণ পর ফেরিতে ওঠার ঘোষণা এলো। উপরতলার উন্মুক্ত ছাদজুড়ে রেলিং দেওয়া ব্যালকনি, সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় গিয়ে নিজের জন্য জায়গা করে নিলাম। ফেরি ছেড়ে দিলো।

সমুদ্রের বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য পাহাড়, যেন পানির উপর ভাসমান একেকটা পাথরের টুকরো। তার শরীরে গজে উঠেছে গুল্ম উদ্ভিদ। ফেরি ঢুকে পড়ল পাহাড়ের জগতে। প্রকৃতি এত সুন্দর হতে পারে জানা ছিল না! ঘুরতে ঘুরতে কোথায় এসে হাজির হলাম ঠিক নেই। সহযাত্রীদের প্রাপ্য ধন্যবাদটা জানানোর পর শুধু বললাম, এত সুন্দর একটা জায়গার খোঁজ দিয়ে তোমরা আমার ভ্রমণকে সমৃদ্ধ করে তুললে!

মনে পড়ল ম্যারিলিয়ার কথা। তার কথা মতো আমি সত্যিই কিছু একটা আবিষ্কার করতে পেরেছি। খানিক পর পাহাড়ের পাদদেশে দেখা দিল একগুচ্ছ রঙিন ঘরবাড়ি। ফেরি ক্রমেই তার নিকট দিয়ে এগিয়ে চললো। চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল একটা ভাসমান বসতি। ছোট একেকটা ঘরবাড়ি। প্রতিটা বাড়ির সামনে একটা কিংবা দুইটা করে নৌকা বাঁধা। মানুষজনের আনাগোনা নিতান্তই কম। চারপাশে সমুদ্রের সবুজ পানি, পিছনের সামান্য ব্যবধানে পাহাড়। এমন অদ্ভূত সুন্দর দৃশ্যের জন্য উপযুক্ত শিরোনাম কী হতে পারে আমি খুঁজে পেলাম না। 

শেষ হলো আমাদের সমুদ্র যাত্রা। পা স্পর্শ করল ক্যাট বা আইল্যান্ড। বাস আগে থেকেই অপেক্ষমান ছিল। ফেরির যত যাত্রী তার প্রায় সবই এক বাসে ধরে গেল। অনেকে মোটর সাইকেলে রওনা হলো। পাহাড়ি দ্বীপ ক্যাট বা। পথ এগিয়েছে পাহাড়ের মাঝ দিয়ে। প্রায় এক ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম দ্বীপের মূল কেন্দ্রে। সামান্য এগিয়েই পছন্দ মত একটা হোটেল মিলে গেল। উন্নত ঘর। দুটি আলাদা সেমি ডাবল বিছানা। ছোট্ট একটা ফ্রিজ, টেলিভিশন, টেবিল-চেয়ার, আলমারি সবই আছে। অতিথি শুধু আমি একা, তবে যে কোন সময় দ্বিতীয় কেউ এসে উঠে পড়তে পারে।

টানা কাচ সরিয়ে দিতেই সমস্ত ঘর যেন পাহাড়ের কোলের মধ্যে ঢুকে গেল। সবুজের স্পর্শে স্বতেজ বাতাস এসে প্রাণ জুড়িয়ে দিলো। হোটেল থেকে দুই মিনিট হেঁটে গেলে শহরের প্রধান রাস্তা এবং বিনোদন কেন্দ্র। তার পরেই সমুদ্র। ছোট্ট শহর; এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত এক ঘণ্টার মধ্যেই হেঁটে শেষ করা যায়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা আসন্ন। রেস্টুরেন্টগুলো পর্যটকদের আনাগোনায় ভরে উঠতে শুরু করল। তাদের কাছে ভেতরের তুলনায় বাইরে ফুটপাথে বিছানো চেয়ার-টেবিলের কদর বেশি। ওদিকে রাস্তার অপর পাড়ে সমুদ্রের পানিতে ভেসে উঠল বর্ণিল আলোর ঝলক। নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর বেশ কয়েকটা ভাসমান রেস্টুরেন্ট। 

ক্যাট বা’র প্রথম সকাল। নাস্তা হোটেলের পক্ষ থেকে সরবরাহ করা হলো। আমি নিলাম একটা প্যান কেক এবং কফি। পাশের টেবিলে ছোট ছোট বিস্কুটের প্যাকেট রাখা, কেউ চাইলে বিনা পয়সাতেই খেতে পারে। কেক বলতে গোলানো আটা ও ডিমের মিশ্রণে একটা রুটি। অতিরিক্ত উপকরণ হিসেবে তাতে পাতলা কয়েক চাকা কলা যোগ করা হয়েছে। পাশে রাখা হলো কফির আয়োজন। আয়োজন বলতে সরাসরি মগে বা পেয়ালায় করে পরিবেশন নয়। ব্যাপারটা আমার কাছে চিত্তাকর্ষক মনে হলো। কাঁচের পেয়ালার উপর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফুটা করা ঢাকনি আঁটানো। তার উপর টিনের আর একটা পেয়ালা। এটারও মুখ ঢাকনি দিয়ে বন্ধ তবে তলানী ছাকনির মত ফুটা করা। অর্থাৎ উপরের পেয়ালার ফুটা করা তলা দিয়ে ফোটা ফোটা কফি পড়ছে নিচের পেয়ালার ভিতর। কেক খেতে খেতে উপরের কফি নিচে পড়ে প্রস্তুত হতে লাগল। এবার শুধু পছন্দ মত চিনি ও দুধ মিশিয়ে পান করা। চুমুক দেয়ার পর স্বাদের তেমন কোনো তারতম্য খুঁজে পেলাম না। অতি কৌতূহলে জিজ্ঞেস করলাম। বলল-  ফিল্টারাইজড কফি। তাতে আসলেই কি বুঝানো হলো বুঝতে পারলাম না।

ক্যাট বা’য় আমার সুনির্দিষ্ট কোনো ভ্রমণ পরিকল্পনা নেই। শুধু পথে পথে ঘুরে বেড়াব, যেখানে মন চাইবে সেখানেই থেমে যাব। তার পেছনে অন্যতম কারণ আগের দিনের ফেরি ভ্রমণ। ফেরি ভ্রমণে এতটাই মুগ্ধ যে নতুন করে কিছু না দেখলেও মনের মধ্যে কোনো খেদ থাকবে না। ফুরফুরে একটা মেজাজ নিয়ে সকাল বেলার ক্যাট বা দেখতে বের হলাম। এক মিনিটও অতিক্রান্ত হয়নি চোখ আটকে গেল একটা সাইনবোর্ডে। তাতে দৃষ্টিনন্দন কয়েকটা ছবিসহ নৌ-ভ্রমণ সংক্রান্ত অফার- গন্তব্য লান হা বে। দরজা ঠেলে কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করতেই ব্যতিব্যস্ত লোকটি দাঁড়িয়ে স্বাগতম জানালেন। জানতে চাইলে একটা কাগজ সামনে দিয়ে বললেন, এই নিন আমাদের সমস্ত প্যাকেজ অফারের বিস্তারিত। এক দিনের অফারটা আমার পছন্দ হলো, মূল্যও হাতের নাগালে। ভদ্রলোক কথা না বাড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে বুকিং নিশ্চিত করে দিলেন। অফারটা যখন কিনেই ফেললাম, এবার হোটেলে গিয়ে একটা প্রস্তুতি নিয়ে আসি। সোজাসাপ্টা বলে দিলেন- সময় নেই। বললাম, এই যাব এই চলে আসবো। বড়জোর পাঁচ মিনিট লাগবে। তিনি তাতেও রাজি নন। কথা বলতে বলতেই একটা কার চলে এলো। যেন সা পা থেকে হা লং বে যাত্রার সেই ট্যাক্সিক্যাবের অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি।

আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না, বোকার মত বসে থাকলাম। শহরের এ পথ সে পথ দিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে পৌঁছে দিলো একটা নৌ-ঘাটে। আগে থেকেই সমবেতরা নৌ-যানে আরোহণ শুরু করেছে। গলায় একটা পাস পড়িয়ে আমাকেও উঠতে বলা হলো। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা সৌখিন প্রমোদ তরীর পরিপাটি চেয়ারে। 

নৌকা ছেড়ে দিলো। একজন গাইড সামনে দাঁড়িয়ে সমবেত সকলের উদ্দেশ্যে স্বাগত বক্তৃতা শেষে বুঝিয়ে দিলেন দিনের কর্মসূচি। তারপরই পরিবেশিত হলো হালকা নাস্তার সঙ্গে কফি। পর্যটকের সংখ্যা সর্বসাকুল্যে পঁচিশ থেকে ত্রিশজন। মোটামুটি একটা পরিচিতি পর্বের পর একে একে সকলেই উঠে গেলাম উপরে। উপর তলায় উন্মুক্ত ছাদজুড়ে আরাম করে বসা এবং শুয়ে থাকার চমৎকার ব্যবস্থা। চেয়ারের পাশাপাশি রয়েছে বেশ কয়েকটা ডেক। কেউ একা নয়, প্রত্যেকেই জোড়া বেঁধে ভ্রমণে বেরিয়েছে। আমার মত একমাত্র একক পর্যটক ম্যারিনা টেটেলিন। ফরাসি নাগরিক ম্যারিনা নামের শেষাংশ ধরে ডাকালে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। কলেজ শিক্ষক টেটেলিন বিশেষ কোর্সে দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। সেই সুবাদে ভিয়েতনাম ঘুরতে আসা। 

পরস্পরের সঙ্গে আলাপ পরিচিতি উভয়ের জন্যই স্বস্তিদায়ক। আলো ঝলমলে সকাল বেলা, লান হা উপসাগরের শান্ত বুকে জেগে উঠল অসংখ্য পাহাড়। দূর থেকে দেখা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাহাড়গুলো ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই স্পষ্ট দৃশ্যমান হলো। এঁকেবেঁকে প্রবেশ করলাম পাহাড়মালার মাঝে। কত আকার আকৃতি আর ভঙ্গিমার পাহাড় তার ঠিক নেই। কোনোটা দেখে মনে হয় হেলে পড়ছে, কোনোটা মোমবাতির মত তো কোনোটা কচ্ছপের মত। আবার জোড়ায় জোড়ায় কিছু পাহাড় দেখে মনে হয় ভালোবাসার টানে পরস্পরের দিকে এগিয়ে চলছে। সুদীর্ঘ কালের পরিক্রমা আর নোনা পানির ঘর্ষণে প্রতিটি পাহাড়ের গোড়া ক্ষয়ে গিয়ে কয়েক ফুট করে ভেতরে ঢুকে গেছে, যেন খুঁটির উপর দণ্ডায়মান। এমনও আছে নিচ দিয়ে এপাড় ওপাড় সুরঙ্গ তৈরি হয়ে গেছে। 

বেলা বারোটা নাগাদ নামলাম একটা ভাসমান স্টেশনে। এখানে দিনের প্রথম কর্মসূচি কায়াকিং। প্রতিটি কায়াকে দুইজন করে আরোহণের ব্যবস্থা। এই ক্ষেত্রে আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা যৎসামান্য। টেটেলিনের অবস্থাও সুবিধার নয়। পূর্ণ প্রস্তুতি সহকারে নেমে পড়লাম। দশ মিনিটের মধ্যে হাত-পা এবং শরীরের কার্যক্রম আয়ত্বের মধ্যে চলে এলো। প্রায় দেড় ঘণ্টার কায়াকিং পর্ব সম্পূর্ণ এক নতুন অবিজ্ঞতা। কয়েক বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে পাড়ার ঘেরা তিনটি আলাদা অংশ। মাঝের  অংশ থেকে উভয় দিকে যাওয়ার জন্য সুরঙ্গ পার হতে হয়। হালকা অন্ধকার এবং গা ছমছমে সুরঙ্গ পেরিয়ে প্রবেশ করলাম সম্পূর্ণ আবদ্ধ একটা এলাকায়। কিছুক্ষণ পর আগের জায়গায় ফিরে অপর সুরঙ্গ ভেদ করে ঢুকে গেলাম আরেক অংশে। শেষ প্রান্তের পাহাড় দেয়ালে একটা ফাটল। তার মাঝ দিয়ে দেখা দিল একটা নোঙর করা জাহাজ। টেটেলিনের দুর্দান্ত সাহস আর উৎসাহে ফাটলের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম। সম্মুখে গগণ বিস্তৃত সমুদ্র। বিশাল জলরাশির বুকে এক টুকরে প্লাস্টিকের উপর নিজেদের অস্তিত্বের কথা কল্পনা করে প্রাণ পাখি উড়ে যাওয়ার উপক্রম। এক মুহূর্ত দেরি না করে দ্রুত কেটে পড়লাম। 

টেবিলে লাঞ্চ পরিবেশন করা হয়েছে। অনেকগুলো বাটি। একেকটাতে একেক পদের খাবার। স্প্রিং রোল, ঝিনুক সিদ্ধ, ফালি করা আলু ও গাজরের পদ, সামান্য পরিমাণ ভাত, ডিমের বেশ কয়েকটা পদসহ রোস্ট করা বাদাম এবং পানীয়। কায়াকিং-এর পর শরীর মনে প্রাণে কিছু খাদ্য আশা করছিল কিন্তু তা যে এত বর্ণাঢ্য হবে, সেটা জানা ছিল না। নৌকায় ফিরে এই লোভনীয় খাবারের পসরা দেখে আমার মন খুশিতে ভরে উঠল। উপসাগর লান হার বুকে ভাসতে ভাসতে আর গল্পে গল্পে দীর্ঘ সময় ধরে চললো আমাদের খাবার খাওয়ার পর্ব। 

পাহাড়ের ভীড় অতিক্রম করে নৌকা গিয়ে নোঙর করল একটা সৈকতের কাছে। নিল জলরাশির মাঝে খাঁড়া পাহাড়, ঠিক তার সামনে বাদামী রঙের ছোট্ট একটা বালুকাবেলা। হাতে গোনা একেবারেই দুই-একজন ব্যতিরেকে সকলেই নেমে পড়ল। এই হাতে গোনা দুই-একজনের মধ্যে আমি একজন। কারণ আমার সঙ্গে সমুদ্র স্নানের মত অতিরিক্ত কাপড় নেই। এই জিনিসগুলো নিতেই মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য হোটেলে যেতে চেয়েছিলাম। সকলেই মনের আনন্দে সাঁতার কাটতে নেমে পড়ল। আমি উপর তলার ডেকে বোকার মত বসে থাকলাম। নিরুপায় পর্যটক এবার কবি অথবা দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো। মনে মনে ভাবলাম সবাই সাঁতার কাটলে দেখবে কে? এই দেখার বিষয়টা আরও বেশি উপভোগ্য হয়ে উঠল যখন টেটেলিন তার ব্যাগ পাহাড়া দেয়ার দায়িত্ব আমার উপর সমর্পণ করে গেল। (চলবে)

পড়ুন ১৪তম পর্ব: ভিয়েতনামে অসহায় পর্যটকের রাত্রিযাপন  

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়