ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

জননেতা আতাউর রহমান : তার জীবন ও সময়

রিশিত খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫১, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জননেতা আতাউর রহমান : তার জীবন ও সময়

আতাউর রহমান

রিশিত খান : আতাউর রহমান বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। তার স্বল্পায়ু জীবনের (পঞ্চান্ন বছর) চার দশকই কেটেছে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। ১৯৩৯ সালে যখন তার বয়স মাত্র ১৪ বছর এবং নবম শ্রেণির ছাত্র সেসময় বাংলার গভর্নর ছোট লাটবাহাদুর রাজশাহীতে আসেন। সেসময় কিশোর আতাউর রহমান প্রতিবাদস্বরূপ গভর্নরকে কালো পতাকা প্রদর্শন করেন। ব্রিটিশদের কবল থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করার সাহসী সংগ্রামের অংশ হিসেবে ওই বয়সে তিনি এ কাজটি করেছিলেন। ফলত যা হবার তাই হলো। ব্রিটিশ সরকার তাকে গ্রেফতার করে। রাজনৈতিক কারণে জীবনে প্রথম কারাবরণ করেন আতাউর রহমান। তার কিছু দিন পর বাংলার মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী রাজশাহী সফরে এসে বিষয়টি জানতে পারেন এবং আতাউর রহমানকে বেকসুর খালাসের নির্দেশ দেন কর্তৃপক্ষকে।


আতাউর রহমান ৯ দিন কারান্তরিত থাকার পর মুক্ত হন। তিনি সেসময়ে মুসলিম ছাত্রলীগে অন্যতম কর্মী ছিলেন। আতাউর রহমানের সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ ছিল অত্যন্ত নিবিড়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পূর্ব থেকেই তিনি কলকাতায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে কলকাতায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের স্নেহাশীষ পাবার  সুযোগ লাভ করেন ওই বয়সেই। এ ছাড়া ভারতবর্ষে বামপন্থি আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ কমরেড মোজাফফর আহমেদরও অত্যন্ত স্নেহভাজন ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। এসবের প্রমাণ মেলে মোজাফফর আহমেদের এক লেখায়। সেখানে তিনি বলেছেন :


চল্লিশের দশকের গোড়ায় কলকাতায় ছাত্র-যুব আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আতাউর রহমান মুক্তির পথ হিসেবে সমাজতন্ত্রকেই জীবনাদর্শ বলে গ্রহণ করেন। ১৯৮৭ সালে ১৪ আগস্ট দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার মাত্র চব্বিশ দিনের মধ্যে পূর্ববঙ্গে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক যুবলীগ পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক ভিন্ন মাত্রার সংযোজন ঘটায়। আর এই দুঃসাহসিক এবং দূরদর্শী উদ্যোগের অন্যতম কারিগর ছিলেন আতাউর রহমান, সেসময় তার বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর। এরই ধারাবাহিকতায় ভাষার লড়াই, তেভাগা আন্দোলন, রাজবন্দিদের দাবি আদায়ে ১৯৪৯ সালের ঐতিহাসিক অনশন প্রভৃতি গণতান্ত্রিক সংগ্রামে সামনের কাতারে থেকে খুব অল্প বয়সেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে আতাউর রহমানের অবস্থান ছিল পরিষ্কার। অভিজ্ঞতার এই বিস্তর ব্যবধান  আমাদের মধ্যে কোনো দূরত্ব সৃষ্টি করতে পারেনি। বরং বিচক্ষণ আতাউর রহমান ছিলেন আমাদের নিকটতম বন্ধু। তার মৃত্যুর ২৪ বছর পরও আমরা এখনও আতাউর রহমান নৈকট্য অনুভব করি।’
[আতাউর রহমান, মধ্য গগনের সাথী : মোজাফফর আহমেদ, দৈনিক সংবাদ ১২/১/০৪]


১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের একদম শুরুতে রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলে আতাউর রহমান খুবই সক্রিয় ছিলেন। ভাষা আন্দোলন জনমত গঠনের লক্ষ্যে তিনি ব্যাপক কাজ করেন। ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে রাজশাহীতে ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী আবুল কাশেম চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকাতেও এ সময় ব্যাপক ছাত্র নির্যাতন করা হয়। এর প্রতিবাদ হিসেবে ৮ জানুয়ারি ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ পালন করা হয়। ১৯৪৯-এর মার্চ-এপ্রিল মাসের দিকে ওই ছাত্র আন্দোলনের সময় অনেককেই গণগ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে আতাউর রহমানও ছিলেন, তাকে ডেকে পাঠানো হয়। প্রায় আট মাস কারাভোগ শেষে তিনি ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তি পান। এভাবে ১৯৩৯ সাল থেকে আমৃত্য ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ৪১ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ২৩ বার কারাবরণ করেছেন,  রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে ১০ বার অনশন ধর্মঘটও করেছেন। ঢাকা জেলে তিনি ১৯৪৯ সালের মে মাসে  একটানা ২৯ দিন পর্যন্ত অনশন ধর্মঘট করেছিলেন।


১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে আতাউর রহমানের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ছাত্র-জনতার ওপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো রাজশাহীতেও ব্যাপক প্রভাব পড়ে। প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে রাজশাহী। রাজশাহীতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এই পরিষদ গঠনের পেছনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন আতাউর রহমান। ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর ভুবন মোহন পার্কে শহীদ মিনার নির্মাণের অন্যতম স্থপতি ছিলে বরেণ্য এই রাজনীতিক।

১৯৫৪ সালে আতাউর রহমান জেলখানায় অন্তরীণ থেকেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে চারঘাট-লালপুর নির্বাচনী এলাকায় বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছিলেন। সেই নির্বাচনে শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের মনোনীত যুক্তফ্রন্টের শক্তিশালী প্রার্থী এবং ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের প্রার্থীকে তিনি পরাজিত করেছিলেন। এ বিষয়ে প্রবীণ রাজনীতিক রণেশ মৈত্র বলেছেন, ‘১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের সাধারণ নির্বাচন। আতাউর ভাই রাজশাহী জেলার চারঘাট থানা এলাকা থেকে গণতন্ত্রী দলের কোঠায় যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন পান শেষ মুহূর্তে। তখন আর তিনি ফ্রন্টের প্রতীক নৌকা নিয়ে নির্বাচন করার সুযোগ পাননি। তবুও তিনি বিজয়ী হন এবং পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য হন। পরে বাংলায় যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ার মাত্র ৫৮ দিনের মাথায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ওই মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেয়। এরপর গভর্নরী শাসন প্রবর্তন করলে যুক্তফ্রন্টের বহু মন্ত্রী, এমএনএ এবং আমরা হাজার হাজার কর্মী সারাদেশে গ্রেফতার হই। রাজশাহীর জেলে উপলব্ধি করেছি জেল কর্তৃপক্ষও আতাউর ভাইকে কতটাই না শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন।’
[আতাউর রহমান : নন্দিত জননেতা : রণেশ মৈত্র, দৈনিক জনকণ্ঠ, ১২ জানুয়ারি ০৪]


আতাউর রহমান প্রগতিশীল রাজনীতির মাধ্যমে সমগ্র উত্তর জনপদে অসংখ্য কর্মী-সমর্থক তৈরি করেছিলেন। ১৯৫৩ সালে গণতন্ত্রী দল গঠন হলে তিনি ওই দলের রাজশাহীর জেলা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠনে আতাউর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি ন্যাপের প্রাদেশিক সহ-সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্যও নির্বাচিত হন। আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানসহ প্রভৃতি গণতান্ত্রিক আন্দোলন আতাউর রহমান সামনের সারিতে থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ সময়ে তিনি পাকিস্তানিদের হাতে নানাভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ন্যাপ পুনর্গঠনে আতাউর রহমানের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাকশাল গঠিত হলে তিনি বাকশালে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং রাজশাহী জেলা গভর্নর মনোনীত হন। কিন্তু ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে ওই দায়িত্ব পালন করতে পারেননি।


আতাউর রহমান জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ন্যাপের পক্ষেই সংশ্লিষ্ট ছিলেন। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি নানাবিধ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। তিনি রাজশাহী প্রেসক্লাবে অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং ১৯৭২ সালে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘নতুনকাল’ এর প্রকাশক ও সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন।  পেশায় আইনজীবী আতাউর রহমান রাজশাহী অ্যাডভোকেট বার অ্যাসোসিয়েশনের আজীবন সভাপতি ছিলেন। পাকিস্তানের প্রগতিশীল অসম্প্রদায়িক রাজনীতির মহান স্রষ্টা আতাউর রহমান আমাদের মাঝে নেই সে অনেক দিন- তিন যুগেরও অধিক সময়। ১৯৮০ সালে ১২ জানুয়ারি ঢাকার তৎকালীন পিজি হাসপাতালে তিনি (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) পরলোকগমন করেন। রণেশ মৈত্রের কথাই সত্য। সাম্যবাদী আদর্শে অবিচল আতাউর ভাই যে সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছিলেন এবং যেভাবে গণমানুষের আপনত্ব অর্জন করেছিলেন তা অতুলনীয়। সহকর্মী মোজাফফর আহমেদের ভাষায়-আতাউর রহমানের মতো মানুষের জন্ম অহরহ হয় না।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী  

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫/রিশিত/তাপস রায়   

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়