নজরুল মানবধর্মের মহান আদর্শ
হাবিবুর রহমান স্বপন || রাইজিংবিডি.কম
কাজী নজরুল ইসলাম
হাবিবুর রহমান স্বপন : বাঙালির অফুরন্ত আবেগ, ‘বাঁধন হারা’ উচ্ছ্বাস আর প্রবল প্রাণশক্তিকে আপন আত্মায় ধারণ করে যিনি সারাজীবন দ্রোহ, প্রেম, সাম্য ও মানবতার বাণী শুনিয়েছেন তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদে প্রবলভাবে আস্থাশীল এই মহৎ কবির আরাধ্য ছিল সত্য-শিবম-সুন্দরম। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও নজরুল সত্য-সুন্দর ও মানবতার জয়গান গেয়েছেন।
প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে তিনি বলেছেন, ‘সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে কূলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।’ তিনি সাম্যবাদি কবিতায় আরও লিখেছেন :
‘গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই নহে কিছু মহিয়ান।
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি,
সব দেশে,সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।
... ... ... ...
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম খ্রীস্টান।’
‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’-তে নজরুল লিখেছেন, ‘আমি কবি। আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন। আমার বাণী-সত্যের প্রকাশিকা। ভগবানের বাণী।’
সুনির্দিষ্ট কোন ধর্ম, দর্শন কিংবা জীবনচর্যায় তিনি দীর্ঘকাল থাকতে পারেননি; তবুও সকল ধর্মের সার্বজনীন মূল্যের প্রতি ছিল তাঁর প্রগাঢ় আস্থা। আর এই আস্থা তাঁকে হিন্দু কিংবা মুসলমানের কবি না করে, করেছে বাঙলা ও বাঙালির কবি। তাইতো মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রামে এবং পরমত সহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠা ও ধর্মীয় সম্প্রীতি সাধনায় তাঁর কবিতা ও গান বাঙালিকে যোগায় অনিঃশেষ প্রেরণা।
নজরুল ইসলাম ছিলেন মূলত সকল ধরনের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে এক অমর প্রতিদ্বন্দ্বী। ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করার প্রবল বাসনা তিনি সব সময়েই অনুভব করেছেন। ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’ শুনে তিনি তাঁর দু-যুগের কাব্য পরিক্রমায় মাঝে মাঝেই হয়তো পথ দর্শন এমনকি ধর্মাদর্শ বদলিয়েছেন। কিন্তু ভেদবুদ্ধিহীন, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে কখনও নিজেকে বদলাননি। ব্যক্তিগত ও সাহিত্যিক জীবনে তিনি ছিলেন, সম্পূর্ণ সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ মানুষ। বিবাহ করেছেন মুসলমান নার্গিস আক্তার খানম ও হিন্দু প্রমীলা দেবীকে। তবে ‘আহলুল কিতাব’-এর মতানুসারেই কাজী নজরুল ইসলাম ও কুমারী প্রমীলা সেনগুপ্তের বিয়ে হয়েছিল কলকাতার ৬ নং হাজী লেনের বাড়িতে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৪ এপ্রিল। প্রমীলাকে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করার কথা নজরুল চিন্তাও করেননি। এমনকি স্ত্রীর নামটিও পরিবর্তন করে মুসলিম নাম রাখেননি।
নজরুল তাঁর চারটি সন্তানের নাম রেখেছিলেন হিন্দু-মুসলমানের মিলিত ঐতিহ্য ও পুরাণের আলোকে। তাঁর প্রথম সন্তানের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ মোহাম্মদ। চার বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। এর পর তিন সন্তানের নাম রাখেন যথাক্রমে অরিন্দম খালিদ, কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ। নজরুল সন্তানদের নাম নিজেই রেখেছিলেন। যেসব পৌরণিক ও ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের নামের সাথে মিলিয়ে তিনি ছেলেদের নাম ঠিক করেছিলেন, তা থেকে কোন ধরণের ব্যক্তির প্রতি নজরুলের অনুরাগ ছিল তা বোঝা যায়। যেমন কৃষ্ণ-মোহম্মদ : কৃষ্ণ হিন্দু ধর্মের প্রবর্তক। দ্বিতীয় ছেলের নাম : অরিন্দম-খালিদ। অরিন্দম শব্দের অর্থ শত্রু দমনকারী। রামায়ণে রাবণপুত্র মেঘনাদকে অরিন্দম বলা হয়েছে। মাইকেল মধুসুদন দত্তও মেঘনাদবধ মহাকাব্যে ‘অরিন্দম ইন্দ্রজিৎ’ (মেঘনাদের আরেকটি নাম ইন্দ্রজিৎ) শব্দদ্বয় ব্যবহার করেছেন। আর খালিদ হলেন ইসলামের ইতিহাসের বিখ্যাত বীর খালিদ বিন ওয়ালিদ; খলিফা হযরত আবু বকর (রা:)-এর সেনাপতি হিসেবে তিনি কিংবদন্তি বীরের মর্যাদা পেয়েছেন। একইভাবে অনিরুদ্ধ হলো শ্রীকৃষ্ণের পৌত্রের নাম এবং সব্যসাচী হলেন মহাভারতের অর্জুন। কাজী অনিরুদ্ধের ডাক নাম ছিল লেনিন (রাশিয়ার কমিউনিস্ট বিপ্লবের প্রাণপুরুষ) এবং সব্যসাচীর ডাক নাম ছিল সান-ইয়াৎ সেন (চীনের জিংহাই বিপ্লবের অন্যতম নেতা)। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, নজরুল ইসলাম তাঁর সন্তানদের নামের মধ্যে সচেতনভাবে হিন্দু ও মুসলিম ঐতিহ্য এবং তৎকালীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বিপ্লবীদের নামের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। বস্তুত এই হিন্দু মুসলিমের মিলনই তিনি আজীবন চেয়েছিলেন।
নজরুলের সখ্য ও বন্ধুত্ব ছিল হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে অনেকের সঙ্গেই। শৈলজানন্দ মজুমদার, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, মুজাফ্ফর আহমদ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, শরৎচন্দ্র চট্ট্যোপাধ্যায়, কাজী মোতাহার হোসেন, দিলীপ কুমার রায় প্রমুখ ছিলেন তাঁর অকৃত্তিম বন্ধু এবং অনেক শুভ কর্মের সহযাত্রী।
নজরুল তাঁর ‘বিষের বাঁশী’ (১৯২৪ খ্রি.) ‘জগজ্জননীস্বরূপা মা মিসেস এম রহমানকে’, ‘চিত্তনামা’ (১৯২৫ খ্রি.) ‘মাতা বাসন্তী দেবীকে’ এবং ‘সর্বহারা’ (১৯২৬ খ্রি.) ‘মা বিরজা দেবীকে’ উৎসর্গ করেন। লক্ষ্যণীয় এঁরা সকলেই ছিলেন নজরুলের কাছে মায়ের মত।
হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সূত্রপাত হলে যে অসহনীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয় তখন নজরুল রচনা করেন উদ্দীপ্ত সংগীত। ১৯২৬-এর ২২ মে কৃষ্ণনগরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির বার্ষিক সম্মেলনে কবি নজরুল সবাইকে চমকে দিয়ে ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ উদ্বোধনী সংগীত গেয়ে শোনান। তিনি যখন উচ্চারণ করেন, হিন্দু না ঐ মুসলিম জিজ্ঞাসে কোন জন/ কাণ্ডারী বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র- তখন হিন্দু-মুসলিম প্রত্যেকে একাত্ম হয়ে ওঠেন। এর পর তিনি ‘হিন্দু মুসলিম যুদ্ধ’, ‘পথের দিশা’ প্রভৃতি কবিতা এবং ‘মন্দির-মসজিদ’ প্রবন্ধ লিখে দেশবাসীকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেন।
নজরুলের কবিতায় একদিকে যেমন ঠাঁই পেয়েছে মুসলিম আদর্শ অন্যদিকে হিন্দু আদর্শ। সর্বোপরি এ সব কিছুর মূল সুতো হচ্ছে তাঁর সাম্যবাদী মনোভাব, তাঁর মানবতাবোধ। নজরুল মানস হিন্দু-মুসলিম বৈপরীত্যের দ্যোতক না হয়ে পরিপূরক হতে পেরেছে তাঁর সাম্যবাদী চিন্তার ফলে। তিনি বলেছেন,- ‘নদীর পাশ দিয়ে চলতে চলতে যখন দেখি একটা লোক ডুবে মরছে, মনের চিরন্তন মানুষটি তখন এ প্রশ্ন ভাবার অবসর দেয় না যে, লোকটা হিন্দু না মুসলমান, একজন মানুষ ডুবছে এইটেই...সবচেয়ে বড়, সে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে...মন বলে আমি একজনকে বাঁচিয়েছি।’ নজরুল তাঁর লেখনীতে যে সাম্যের ইঙ্গিত দিয়েছেন তা স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবতা এবং সুবিচারের এষণায় তীক্ষ্ণ, তীর্য, উজ্জ্বল। তাঁর কল্পনা কখনো ধর্মীয় উদারতা, কখনো সাম্যবাদ, স্বাধীনতা, কখনো মানবতা আবার কখনো নৈরাজ্যকে স্পর্শ করেছে। সমাজ-বিধানের অসঙ্গতি, স্ববিরোধিতা, জাতি-বৈষম্য, শ্রেণি-বৈষম্যের প্রতি তাঁর কণ্ঠ সর্বদাই সোচ্চার ছিল। আর এ সকল কিছুর মূল ছিল মানবমুক্তি ও মানবকল্যাণ। ‘কুলি-মজুর’ কবিতায় তাঁর মানবতার পরিচয় ফুটে উঠেছে এভাবে- দেখিনু সেদিন রেলে/কুলি বলে এক বাবুসাব তারে টেনে দিল নিচে ফেলে/চোখ ফেটে এল জল/ এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল।’ নজরুল মানুষকে জাতির ঊর্ধে স্থান দিয়েছেন। তিনি জাতির স্বাধীনতার সঙ্গে একাত্ম করে নির্যাতিত শ্রেণির মুক্তির কথা ভেবেছেন।
মানবতার আবেগেই তিনি সাম্যের গান গেয়েছেন। বুর্জোয়া সামন্ততন্ত্রের পরিবর্তে তিনি চেয়েছেন সাম্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়তে। তাই তাঁর কাব্য, গানে-গল্পে মানবতাবোধ থেকেই এসেছে বিদ্রোহ, অসম্প্রদায়িক ও সাম্যবাদের চেতনা। তিনি মনে করতেন যা কিছু মানুষের জন্য সুন্দর মহত্তর ও কল্যাণকর তাই ধর্ম। নজরুল-মানষ পরিমণ্ডল সার্বজনীন মানবতাবোধ দিয়ে বেষ্টিত। তিনি মানবতাকে প্রতিষ্ঠা করেন কল্পনার উচ্চমার্গ থেকে প্রত্যক্ষ জীবনে-জনসাধারণের স্তরে। সমাজে যারা নির্যাতিত, অপমানিত, অবহেলিত তারাই কবিচিত্ততে আকৃষ্ট করেছে। এ সকল মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে লাঘব করতে তাঁর লেখনী নিসৃত হয়েছে। নজরুল যা লিখেছেন তা তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন বলে তা জীবনে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন দ্বিধাহীনভাবে। তাঁর জীবনসাধনাকে কোনভাবেই শিল্পসাধনা থেকে আলাদা করা যায় না। প্রেম ও দ্রোহের এই সাধক মানবতার সুউচ্চ মিনারে বসে সারাজীবন সাম্য-সম্প্রীতি ও মিলনের গান শুনিয়েছেন। কবিতা ও গানে তিনি ব্যবহার করেছেন হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের ঐতিহ্য থেকে শব্দ ও ভাষা। কিন্তু মননে-মগজে ছিলেন সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক। হিন্দু-মুসলমানের মিলিত ঐতিহ্য স্পর্শ করে তিনি চলে গেছেন অসাম্প্রদায়িকতা ও উদার মানবিকতার দিকে।
নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তিনি বলেছেন-আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন/আমি স্রষ্টাসূদন শোক তাপহীন খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন।’ তাঁর এই বিদ্রোহের মূলেই ছিল মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রীতি ও সাম্যবাদী মনোভাব।
নজরুল যখন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা করেন তখন তাঁর বয়স ২৩ বছর। কবিতাটির ভাষা, ছন্দ, উপস্থাপন ভঙ্গি এবং মিথ-এর ব্যবহার ছিল এককথায় অনন্য; চর্যাপদ থেকে শুরু করে প্রায় হাজার বছরের বাংলা কবিতার ইতিহাসে এমন তেজদ্দীপ্ত কবিতা আর একটিও লেখা হয়নি। এই কবিতার আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক ছিল এর অসাম্প্রদায়িক চরিত্র। ভারতীয় ও গ্রিক পুরাণের পাশাপাশি কবিতাটিতে ইসলামী ঐতিহ্যের সমান্তরাল ব্যবহার হয়েছে। কবিতায় যেভাবে ভগবানের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেওয়া কিংবা খোদার আসন আরশ ছেদিয়া উঠবার ঘোষণা এসেছে, তাতে তাঁকে ধর্মনিরোপেক্ষ বা ছিদ্রান্বেষীদের ভাষায় বলতে গেলে ধর্মদ্রোহী হিসোবে শনাক্ত করা চলে। বিশ শতকের শুরুর সেই সময়ে বাংলাদেশের কোনো ঘোষিত নাস্তিকও এতটা বলার সাহস দেখায়নি। নজরুলকে নাস্তিক হিসাবে শনাক্ত করা চলে না। তাঁর অসংখ্য লেখা থেকে এবং ব্যক্তিগত আচরণ থেকে প্রমাণ দেওয়া যায় যে, সৃষ্টিকর্তায় তাঁর বিশ্বাস ছিল। তবে সে বিশ্বাস যে আর দশজন মুসলমানের মতো ছিলা না, তা এক প্রকার নিশ্চিত করে বলা যায়। নইলে বিশ শতকের ভারতবর্ষে তিনি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো মুসলমান ছিল কি না সন্দেহ, যিনি নিঃসংকোচে ঘোষণা দিতে পারেন, তাঁর মনের দোতারায় একটি তার শ্যামের এবং আরেকটি শ্যামার! তাঁর এই ঘোষণা নিছক কথার কথা ছিল না, বস্তুত তিনি একই হাতে এতো উৎকৃষ্ট শ্যামা সংগীত এবং শ্রীকৃষ্ণের ভজন লিখেছেন যে, শ্যামা কিংবা শ্যামের আজন্ম কোনো বাঙালি ভক্তও তা পারেননি। একটি গানে তিনি লিখেছেন, ‘শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে জপি আমি শ্যামের নাম/ মা হলেন মোর মন্ত্রগুরু ঠাকুর হলেন রাধেশ্যাম।’
নজরুল ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি, তিনি বিদ্রোহ করেছেন ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। একালে যেমন, সেকালেও তেমনি ধর্মকে শোষণের প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তাই ভণ্ড মোল্লা-মৌলভী আর পুরোহিতের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তিনি ছিলেন সোচ্চার।‘রুদ্র-মঙ্গল গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, - ‘হিন্দুত্ব মুসলমানত্ব দুই সওয়া যায়, কিন্তু তাদের টিকিত্ব দাড়িত্ব অসহ্য, কেননা ঐ দুটোই মারামারি বাধায়। টিকিত্ব হিন্দুত্ব নয়, ওটা হয়তো পণ্ডিত্ব। তেমনি দাড়িত্ব ইসলামত্ব নয়, ওটা মোল্লাত্ব। এই দুই ‘ত্ব’ মার্কা চুলের গোছা নিয়েই আজ এত চুলাচুলি! আজ যে মারামারি বেধেছে, সেটাও এই পণ্ডিত-মোল্লায় মারামারি, হিন্দু-মুসলমানের মারামারি নয়।...অবতার-পয়গম্বর কেউ বলেননি, আমি হিন্দুর জন্য এসেছি, আমি মুসলমানের জন্য এসেছি, আমি খ্রিস্টানের জন্য এসেছি। তাঁরা বলেছেন, আমরা মানুষের জন্য এসেছি -আলোর মতো সকলের জন্য। কিন্তু কৃষ্ণের ভক্তরা বললে, কৃষ্ণ হিন্দুর; মুহম্মদের ভক্তরা বললে, মুহম্মদ মুসলমানদের; খ্রিস্টের শিষ্যরা বললে, খ্রিস্ট খ্রিস্টানদের। কৃষ্ণ-মুহম্মদ-খ্রিস্ট হয়ে উঠলেন, জাতীয় সম্পত্তি। আর এই সম্পত্তি নিয়েই যত বিপত্তি। আলো নিয়ে কখনো ঝগড়া করে না মানুষে, কিন্তু গরু-ছাগল নিয়ে করে।’
তাঁর গান-গল্প-নাটক-চিঠিপত্র এককথায় সমগ্র নজরুল সাহিত্যে দুটি ভাবকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায়। প্রথমটি সমাজের নানাবিধ বৈষম্যের প্রতি তাঁর তীব্র ক্ষোভ আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের প্রতি তাঁর অপার ভালবাসা। প্রথমটি থেকে তাঁর জন্ম নেয় সাম্যবাদী চেতনা আর দ্বিতীয়টি তাঁর মধ্যে জন্ম দেয় বিশ্ব মানবধর্ম।
নজরুলের জীবন নিয়ে চিন্তা করলে অবাক হতে হয়। বিষ্ময়কর এই প্রতিভাবান মানুষটি জন্ম গ্রহণ করেছিলেন অতিসাধারণ একটি মুসলিম পরিবারে। তাঁর পিতার নাম ছিল কাজী ফকির আহমেদ। আমরা সাধারণত যে ধরনের আর্থিক অবস্থার মানুষকে ফকির বলে উল্লেখ করি, নজরুলের বাবা ছিলেন প্রায় সেই ধরণেরই একজন দরিদ্র মানুষ; তার উপর তিনি কোনো লেখাপড়াও জানতেন না। দুঃখের সংসারে নজরুল ছিলেন ষষ্ঠ সন্তান। তাই তার নাম রাখা হয়েছিল দুখু মিয়া। সত্যিই নজরুল ওরফে দুখু মিয়ার জীবনে আর যা কিছুরই অভাব হোক দুঃখের অভাব কোন দিন হয়নি। ৮ বছর বয়সে পিতাকে হারিয়ে গ্রামের মাজারের খাদেম এর পর মসজিদের মোয়াজ্জিন। স্কুল ছেড়ে কবি দলে যোগদান, পরে খ্রিস্টানদের রেলওয়ে গার্ডের খানসামা পদে এবং শেষে আসানসোলে চা-রুটির দোকানের কর্মচারি। যৌবনের প্রারম্ভেই সৈনিকের চাকরি। তার পর ফিরে এসে সাংবাদিকতায় বা পত্রিকার সম্পাদনায়। কত অসাধারণ সাহিত্য কর্ম সৃষ্টি করেন মাত্র ৪৩ বছরে। এর পর ৩৪ বছর নির্বাক-নিশ্চল থেকে মহান মানবতার কবি নজরুল চলে গেলেন পরোলোকে। রেখে গেছেন মানবধর্মের মহান আদর্শ।
লেখক ; সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক
[email protected]
রাইজিংবিডি.কম