ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মুজাহিদ : আলবদর নেতা থেকে সমাজকল্যাণমন্ত্রী

মেহেদী হাসান ডালিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৮ নভেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুজাহিদ : আলবদর নেতা থেকে সমাজকল্যাণমন্ত্রী

মেহেদী হাসান ডালিম : আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ আলোচিত, সমালোচিত, নিন্দিত একটি নাম। ইতিহাসের পরিক্রমায় ৪৪ বছর পর একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার কারণে আইনি লড়াইয়ের শেষ ধাপ রিভিউ আবেদনের রায়েও মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তিনিই প্রথম যিনি একজন মন্ত্রী ছিলেন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে যাচ্ছেন।

 

জামায়াতে ইসলামী দলে মুজাহিদের প্রভাবশালী নেতা ও মন্ত্রী হয়ে ওঠা, একাত্তরের ভূমিকাসহ তার জীবনের অজানা নানা দিক রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

 

মুজাহিদের বেড়ে ওঠা : জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২ জানুয়ারি, ফরিদপুর জেলার পশ্চিম খাবাসপুরে। তার পিতা মাওলানা আব্দুল আলী জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হয়ে ১৯৬২-৬৪ সাল পর্যন্ত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য  ছিলেন।

 

আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ প্রথমে ফরিদপুর ময়জুদ্দিন স্কুলে ভর্তি হন এবং তারপর তিনি ফরিদপুর জিলা স্কুলে অধ্যয়ন করেন। মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা সম্পন্ন করার পর তিনি ফরিদপুরে রাজেন্দ্র কলেজে ভর্তি হন। রাজেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং স্নাতক ডিগ্রি শেষ করার পর তিনি ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় আসেন।

 

১৯৭১ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি- মাত্র দুই-আড়াই মাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়াশোনা করেন। স্বাধীনতার পর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।

 

ছাত্রসংঘে মুজাহিদ : উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র থাকাকালেই জামায়াতের তখনকার ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে তিনি ফরিদপুর জেলা শাখার সভাপতি হন।

 

১৯৭০-এর ডিসেম্বরে ফরিদপুর ছাড়ার সময় তিনি জেলা ছাত্রসংঘের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। ঢাকায় এসে তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা জেলার সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময়ে তিনি ১৯৭১ সালের জুলাইতে ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক সেক্রেটারি (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) মনোনীত হন এবং এর মাত্র দুই মাস পর অক্টোবরে তিনি ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক সভাপতি নির্বাচিত হন।

 

একাত্তরের ভূমিকা : ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সংগ্রাম যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, সেই বছর জানুয়ারিতে ইসলামী ছাত্রসংঘের ঢাকা জেলা শাখার সভাপতি হন মুজাহিদ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর জুলাই মাসে সংগঠনের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সেক্রেটারি এবং এরপর প্রাদেশিক সভাপতির দায়িত্ব পান।

 

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গঠিত হলে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তার নেতৃত্ব দেন ইসলামী ছাত্রসংঘের তখনকার সভাপতি ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী। অক্টোবরে ওই বাহিনীর প্রধান হন মুজাহিদ।

 

তদন্ত সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মুজাহিদের নেতৃত্বে আলবদর বাহিনী যুদ্ধের মধ্যে ফরিদপুর, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা, অপহরণ, লুটপাটের মতো ব্যাপক মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড চালায়। এমনকি ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রস্তুতির সময়ও বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ না করার সিদ্ধান্ত নেন মুজাহিদ।

 

জামায়াতের রাজনীতি : স্বাধীনতার পর মুজাহিদ জামায়াতের রাজনীতিতে যুক্ত হন । তিনি ১৯৮২-৮৯ পর্যন্ত ঢাকা মহানগর জামায়াতের আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৯ থেকে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালনের পর ২০০০ সালের ৮ ডিসেম্বর মুজাহিদ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মনোনীত হন এবং সেই থেকে তিনি এই দায়িত্বেই আছেন।

 

কর্মজীবন : আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ তার কর্মজীবন শুরু করেন নারায়ণগঞ্জ আদর্শ স্কুলের অধ্যক্ষ হিসেবে। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তিনি নারায়ণগঞ্জ আদর্শ স্কুলের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

 

মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার হওয়ার আগ পর্যন্ত মুজাহিদ বাংলাদেশ পাবলিকেশন্স- এর চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। এ ছাড়া তিনি জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম-এর চেয়ারম্যান এবং সাপ্তাহিক সোনারবাংলার পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

 

পরিবার : আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ১৯৭৩ সালের ১৮ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করা বেগম তামান্না-ই-জাহানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তার স্ত্রী তামান্না-ই-জাহান ঢাকা মহানগর মহিলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি এবং কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার সদস্য। মুজাহিদ তিন পুত্র এবং এক কন্যাসন্তানের জনক।

 

সমাজকল্যাণমন্ত্রী মুজাহিদ : ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার গঠনের পর জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়। নির্বাচনে না জিতলেও টেকনোক্র্যাট কোটায় তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। গাড়িতে উড়ান লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত লাল-সবুজ পতাকা।

 

এর আগে মুজাহিদ তিনবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু কোনোবার জয়লাভ করতে পারেননি।

 

বিচারের মুখোমুখি : বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর প্রথমে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদকে বিচারের আওতায় আনা হয়।

 

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগের একটি মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন মুজাহিদকে গ্রেফতার করার পর ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।

 

মামলার শুনানি শেষে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২০১২ সালের ২১ জুন ট্রাইব্যুনালে মুজাহিদের বিচার শুরু হয়। ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মুজাহিদের বিরুদ্ধে আনীত রাষ্ট্রপক্ষের সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ফাঁসির দণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল।

 

ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ১১ আগস্ট আপিল করেন মুজাহিদ।

 

গত ১৬ জুন চূড়ান্ত রায়ে মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আজ আইনি লড়াইয়ের শেষ ধাপ রিভিউ আবেদনের রায়েও মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ নভেম্বর ২০১৫/মেহেদী/শাহনেওয়াজ/এএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়