ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

‘বাংলা নিয়ে কাজ করব বাংলাদেশ থাকবে না, তা হয় না’

কবি স্বরলিপি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘বাংলা নিয়ে কাজ করব বাংলাদেশ থাকবে না, তা হয় না’

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন ঐহিক- এর সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক তমাল রায় বাংলাদেশে এসেছেন। এবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় চৈতন্য প্রকাশনী থেকে প্রকাশ হয়েছে তার গল্প সংকলন ‘হ্যালুসিনেটেড অক্ষরমালা’। সম্প্রতি রাইজিংবিডির সঙ্গে আলাপ হয় তার। উঠে আসে নানা প্রসঙ্গ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্বরলিপি।

রাইজিংবিডি : লিটল ম্যাগাজিন ঐহিক ‘গল্পের সংকলন’- এ বাংলাদেশ ও ভারতের লেখকদের যুক্ত করেছে। বাংলাদেশকে যুক্ত করার কথা ভাবলেন কেন?

তমাল রায় : ঐহিকের পথচলা শুরু ১৯৯০ সালে। শুরু থেকেই ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশকে যু্ক্ত করবো। ভাষা আমার কাছে মা। তাছাড়া সাহিত্য, শিল্প, স্বংস্কৃতি এগুলোর নির্দিষ্ট ভূখণ্ড হয় বলে আমি মনে করি না। ভাষার তো কাঁটাতার বা দেশ হয় না। ভারত, বাংলাদেশ, কানাডা, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, নেপাল, থাইল্যান্ড যেখানেই যেখানেই বাঙালি আছে, বাংলা ভাষা নিয়ে যখন কাজ করি সমস্ত মানুষকে স্বাগত। বাংলাদেশের প্রতি বিশেষভাবে আকর্ষণের কারণ এই যে, মাতৃভাষা নিয়ে এক সামগ্রিক আন্দোলন যা পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করবো আর বাংলাদেশ থাকবে না, এতো হতে পারে না। আমার দেশে যে সমস্যা সেটা হচ্ছে আটাশটি স্বীকৃত ভাষা। আর একটি দেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা, তাকে বাদ দিয়ে কোনো কাজই করা যায় না! অধিকাংশ মানুষ বাংলা ভাষাভাষী, কথাসাহিত্যের চূড়ান্ত বিকাশ, বাংলা কবিতার বিকাশ, যে দেশের সরকারি ভাষাও বাংলা; তাদেরকে নিয়ে কাজ করবো এ আমার অনেক আগের পরিকল্পনা।

রাইজিংবিডি : লেখক নির্বাচনের বিষয়টি কীভাবে করা হয়?

তমাল রায় : বাংলাদেশ থেকে দু-চার জনকে নিয়ে আর ভারত থেকে অধিকাংশ কবি, কথাসাহিত্যিককে নিয়ে কাজটি করবো এরকম অনেকেইভাবে আমরা ভাবিনি এরকম করি না। যে লিখবে তার লেখার যোগ্যতা বড় কথা। সে কোন দেশের এটা বড় কথা নয়। আমাদের সর্বশেষ সংখ্যার নাম ‘অর্যমা’। এই সংখ্যায় মোট সাতচল্লিশ জন লেখক অংশগ্রহণ করেছেন। যাদের মধ্যে বাংলাদেশের সাতাশ জন। ভারতের কুড়ি জন। আশা করছি গুরুত্বের বিষয়টি বুঝতে আর কষ্ট হবে না।

রাইজিংবিডি : ঐহিক পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির শ্রেষ্ঠ লিটল ম্যাগাজিন পুরষ্কার- ২০১৫ পায়। এদিকে আমরা জানি, প্রতিটি সংখ্যায় বিষয় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে লেখকের জন্য কী কোনো সীমাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে না?

তমাল রায় : যে সংখ্যাটি বাংলা আকাদেমি পুরস্কার পায় ওই সংখ্যার নাম ছিল ‘পাগল’। ঘটনাচক্রে সংখ্যাটি বাংলা আকাদেমি পুরস্কার পেয়ে যায়। এর আগের বা পরের সংখ্যাগুলো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ এবং পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু এটিই পুরস্কার পেল। এই সংখ্যার বিষয় নির্ধারণ করার উৎস আমি আমার ঘরেই পেয়েছিলাম। আমার মা ছিলেন মানসিকভাবে অসুস্থ। তা বলে তার সব অনুভূতিই যে লুপ্ত তা ছিল না। এই উপমহাদেশে মানসিক রোগ একটি সমাজিক সিগমা। এর ফলে সমাজ আমাদের পরিবারটিকে একটু হীন চোখে দেখতো। বৈজ্ঞানিকভাবে চিন্তা করলে একজন মানুষের শরীরের সমস্ত অঙ্গ একইভাবে সক্রিয় নাও হতো পারে। যে রোগ চোখে দেখা যায়, তার প্রতি মানুষের ভাবনা-চিন্তা অন্যরকম। কিন্তু একইভাবে মস্তিষ্কের সবগুলো কোষ সমানভাবে সক্রিয় নাও হতে পারে। তাই বলে কি সে সম্পূর্ণ বোধহীন? আমার মনে হয়েছিল, আমাদের, সমাজের কাছে একটা বার্তা পৌঁছানো দরকার। ‘পাগল’কে হেয় নয়। তারা হয়তো সমান সুস্থ্য নয়। এবার আসা যাক, বিষয় নির্ধারণ বিষয়ে। যেটা আমরা শুরুর দিকে নির্দিষ্ট করে দিতাম না। পরবর্তী সময়ে লক্ষ্য করেছি আনন্দবাজার গ্রুপের সাহিত্য পত্রিকা, দেশ পত্রিকা, পশ্চিমবঙ্গের প্রধান সাহিত্যিদের লেখা নিয়েই প্রকাশিত হয়। নির্দিষ্ট লেখক, তাদের একপেশে-একঘেঁয়ে লেখা পাঠক বিরক্ত হযে যাচ্ছিল। আমাদের মনে হয়েছিল, এমন এক নতুন গদ্যকাগজ হবে, তার উদ্দেশ্যও থাকবে, বিষয়ও থাকবে; কিন্তু আমরা লেখকের লেখায় কোন সীমা নির্ধারণ করে দিচ্ছি না। লেখক নিজের মতো করেই লিখছেন। ‘বিষয়’ নির্ধারণ করার একটা কারণ হচ্ছে, একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান-গবেষণা ঋদ্ধ লেখাগুলিকে এক জায়গায় আনার ফলে যেটি ঘটে, পাঠক একটি বই থেকেই এই বিষয় সম্পর্কে সর্বোচ্চ জ্ঞান আহরণ করতে পারে। যে পরবর্তী সময়ে ওই বিষয়ের ওপর কেউ যদি গবেষণা করতে চায় তিনি সহায়তা নিতে পারবেন।

রাইজিংবিডি : ভারতের অনেক লেখক বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়। আমরা হাতের নাগালে তাদের বই পেয়ে যায়। এদিকে আপনি বলছেন, বাংলাদেশে উচ্চমানের সাহিত্যচর্চা হচ্ছে। এখন বই বিনিময়টা কি সমান হারে হচ্ছে?

তমাল রায় : না একেবারেই তা হচ্ছে না। বাংলাদেশের খুব বেশি বই আমরা পশ্চিমবঙ্গে পাই না। তবে ঐহিকের পক্ষ থেকে আমরা বাংলাদেশের লেখকদের, যারা ভালো লিখছেন তাদের বই প্রকাশ করবো। আমি চাই, এদেশের লেখকরাও ওদেশে সমান পরিচিতি পাক। বিনিময়টা ঠিকঠাক হোক। ঐহিক কলকাতা থেকে প্রকাশ হয়ে আসছে। এখন অংশগ্রহণটা যেহেতু সমানে সমান হয়ে গেছে, এরপর ঐহিক বাংলাদেশ থেকেও প্রকাশ করা হবে।

রাইজিংবিডি : বাংলাদেশ থেকে বই প্রকাশের আগ্রহ কেন হলো, আর নিজে গল্পের বিষয় নির্ধারণ করেন কীভাবে?

তমাল রায় : আগেই বলেছি, ভাষার কোনো সীমানা আছে বলে আমি মনে করি না। ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ আমার কাছে শ্রদ্ধার এবং ভালোবাসার। আমার অনেক ভালোবাসার শেকড় এখানে প্রোথিত। সময়-রাজনীতির কারণে আমরা আজ পৃথক। কিন্তু বাঙালি জাতিসত্ত্বা এক, অভিন্ন। সেই জন্যই বাংলাদেশ থেকে বই প্রকাশ করা। আর লেখার বিষয় আমি আমার চারপাশ থেকেই পাই। বিজ্ঞান আমাকে টানে। সত্যতা প্রকাশের জন্য-পরিবর্তনের জন্য, চলতি আবহে মিলে যাওয়ার জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক নিরীক্ষা লেখায় থাকে। আমি নিজে অসুস্থ হয়ে দীর্ঘদিন বিছানায় পরে ছিলাম, আমার মা মানসিকভাবে অসু্স্থ ছিলেন সবমিলে জীবনের সবটুকু সময় সমাজের স্রোতে মিলে থাকতে পারিনি। কিছুটা আড়াল নিতে হয়েছে। সেই আড়ালও কখনো আমার শিক্ষক হয়ে উঠেছিল। বাধ্যও হয়েছি। এতে করে আমি বুঝেছি যে বা যা দূরে থাকে তার সবটুকু দেখা যায়। আর যা কাছের তার কিছু অংশ দেখা যায়। আমি দূরকে দেখেছি। দূরকে ভালোবেসেছি। ভালোবাসি বাংলাদেশকে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ