ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

বাংলা চলচ্চিত্রের এক প্রবাদ পুরুষ

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:০১, ১৪ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাংলা চলচ্চিত্রের এক প্রবাদ পুরুষ

মৃণাল সেন

শাহ মতিন টিপু : মৃণাল সেন অত্যন্ত বড় মাপের একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা। লাতিন আমেরিকার গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এর মতো বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিকও চেয়েছিলেন তার লেখা ‘দ্য অটাম অব দ্য পেট্রিয়ার্ক’ নিয়ে ছবি করুন এই নির্মাতা।

অথচ তার লেখা নিয়ে কেউ ছবি করবে- এটার ঘোর বিরোধী গার্সিয়া মার্কেজ । সেই বিরোধিতা ছেড়ে  মৃণাল সেনকে তিনি তার লেখা নিয়ে ছবি বানানোর অনুরোধ করেছিলেন। আবার এজন্য তিনি কোন অর্থও নেবেন না বলেও জানিয়েছিলেন।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকে সরাসরিই ফিরিয়ে দিয়েছিলেন মৃণাল সেন । মৃণাল সেনের বক্তব্য ছিল- ‘আসলে তিনি (মার্কেজ) একটা ভারতীয় কানেকশন খুঁজছিলেন। কিন্তু আমার পক্ষে ঐ গল্প নিয়ে ছবি বানানো সম্ভব ছিল না। ভারতীয় বাড়ির ছবি থেকে গল্পটি ওঁর মাথায় এলেও পুরোটাই ভীষণ রকম লাতিন।’

মার্কেজ জানিয়েছিলেন, ছোটদের কোন একটা বইতে তিনি একটা ভারতীয় বাড়ির ছবি দেখেছিলেন। গল্পটি লিখেছিলেন  সেই ছবিটিকে মাথায় রেখেই ।

মৃণাল সেন মার্কেজকে বলেছিলেন, গল্পে সমাজ থেকে শুরু করে আদব-কায়দা সবই লাতিন আমেরিকার আদলে। ফলে সেটিকে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। মার্কেজ কথাটা মেনে নিয়েছিলেন। মার্কেজ নিজেও চাইতেন না তার লেখা নিয়ে কোন সিনেমা তৈরি হোক। কথাটা তিনি হাভানায় বসে মৃণাল সেনের সঙ্গে এক আড্ডায় বলেছিলেন। মার্কেজ মনে করতেন, ওর গল্পের যা গঠন তা থেকে ছবি করা মুশকিল। গল্পের মূল চরিত্রটাই নষ্ট হয়ে যাবে।

মার্কেজের মৃত্যুর পর তার সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা বলতে গিয়ে মৃণাল সেন জানান, ১৯৮২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে জুরি হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে মার্কেজও ছিলেন জুরি হিসেবে। সেখানে প্রথম দেখা হলেও সেই আলাপ দ্রুত বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছিল। এর দু’তিন বছর পরে হাভানাতেই মার্কেজের সঙ্গে অনেক আড্ডা হয়েছে। সাহিত্য থেকে কিভাবে ছবি বানানো যায় তা নিয়েও অনেক আলোচনা করেছিলেন তিনি মার্কেজের সঙ্গে। ওপরের এই আলোচনা থেকেই অনুমান সম্ভব মৃণাল সেন কোন মাপের চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন।

আসলে মৃণাল সেন হচ্ছেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এ চলচ্চিত্রকার পাল্টে দিয়েছেন বাংলা সিনেমার ধারা। আজ তার ৯৪তম জন্মবার্ষিকী। মৃণাল সেন ১৯২৩ সালে বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মদিনে বরেণ্য এই চলচ্চিত্রকারকে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

দেশ বিভাগের সময় তারা সপরিবারে কলকাতায় চলে যান। তিনি কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিষয়ে পড়াশোনা করেন। ছাত্রাবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালে তিনি একজন সাংবাদিক, একজন ওষুধ বিপণনকারী এবং চলচ্চিত্রের শব্দ কলাকুশলী হিসেবে কাজ করেন। মূলত, চল্লিশের দশকে তিনি সমাজবাদী সংস্থা ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণেই তিনি সমভাবাপন্ন মানুষদের কাছাকাছি আসতে সক্ষম হন।

মৃণাল সেন পরিচালিত প্রথম ছবি 'রাতভোর' মুক্তি পায় ১৯৫৫ সালে। ছবিটি ব্যবসায়িক সাফল্য পায়নি। দ্বিতীয় ছবি 'নীল আকাশের নিচে' তাকে স্থানীয় পরিচিতি এনে দেয়। তৃতীয় ছবি 'বাইশে শ্রাবণ' দিয়ে শুরু হয় তার জয়যাত্রা। এ ছবিটি এনে দেয় আন্তর্জাতিক খ্যাতি। ১৯৬৯ সালে মুক্তি পায় 'ভুবন সোম'। এ ছবিটির মাধ্যমেই বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন ধারার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন মৃণাল সেন। 'ইন্টারভিউ' [১৯৭১], 'ক্যালকাটা ৭১' [১৯৭২] এবং 'পদাতিক' [১৯৭৩] এই তিনটি ছবি ছিল তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার প্রতিচিত্র।

তার বহুল প্রশংসিত দুটি ছবি 'একদিন প্রতিদিন' [১৯৭৯] এবং 'খারিজ'-এর [১৯৮২] মাধ্যমে মধ্যবিত্ত সমাজের নীতিবোধকে তুলে ধরেন মৃণাল সেন। ১৯৮০ সালে তার 'আকালের সন্ধানে' রাতারাতি হইচই ফেলে দেয়। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ ছিল ছবিটির মূল আলোচ্য বিষয়। মৃণাল সেনের পরবর্তী উল্লেখযোগ্য ছবি 'মহাপৃথিবী' [১৯৯২] এবং 'অন্তরীণ' [১৯৯৪]। তার নির্মিত এখন পর্যন্ত শেষ চলচ্চিত্র 'আমার ভুবন' মুক্তি পায় ২০০২ সালে।

মৃণাল সেন পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলি প্রায় সবকটি বড় চলচ্চিত্র উৎসব থেকে পুরস্কার জয় করেছে। পাশাপাশি পেয়েছে প্রশংসাও। ভারত এবং ভারতের বাইরের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে। তিনি ইন্টারন্যাশন্যাল ফেডারেশন অফ দি ফিল্ম সোসাইটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯৮১ সালে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে 'আকালের সন্ধানে' চলচ্চিত্রটি বিশেষ জুরি পুরস্কার রৌপ্যভল্লুক জয় করে। ১৯৮৩ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে 'খারিজ' বিশেষ জুরি পুরস্কার পায়। ১৯৮১ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার 'পদ্মভূষণ' লাভ করেন। ২০০৫ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার 'দাদাসাহেব ফালকে' পান। ১৯৯৮-২০০৩ সালে তিনি ভারতীয় সংসদের সদস্যপদ লাভ করেন। ২০০০ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাকে ‘অর্ডার অব ফ্রেন্ডশিপ’ সম্মানে ভূষিত করেন। মৃণাল সেনকে ফরাসি সরকার তাদের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান 'কমান্ডার অব দি আর্টস অ্যান্ড লেটারস'-এ ভূষিত করেন।

মৃণাল সেনের আত্মজীবনী বেরিয়েছে ২০০৪ সালের শেষভাগে। দিল্লির স্টেলার পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত ৩১০ পৃষ্ঠার এ বইটির নাম 'অলওয়েজ বিয়িং বর্ন'। পৃথিবীতে যে ক’জন চলচ্চিত্র পরিচালক তাদের ছবিতে রাজনীতিকে সাহসের সঙ্গে সরাসরিভাবে আনতে পেরেছেন বা এনেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম মৃণাল সেন ।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ মে ২০১৭/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ