ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

হিসাব ছাড়াই চলছে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ!

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৯, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হিসাব ছাড়াই চলছে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ!

হাসান মাহামুদ : এই তো গত মাসেই যুক্তরাজ্যভিত্তিক গণমাধ্যম সংস্থা ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি) জানিয়েছিল এক বিস্ফোরক তথ্য। আর তা হলো, গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের হিসাব নিয়ে লুকোচুরি করছে বিভিন্ন দেশ। উন্নত বিশ্বের কাতারের অধিকাংশ দেশও ভুল হিসাব দিচ্ছে গ্যাস নিঃসরণের। এই অবস্থায় ওজোন স্তরের ক্ষয় কমানো কিংবা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার হুমকিতে পড়তে যাচ্ছে বললে হয়তো খুব বেশি ভুল বলা হবে না।

জাতিসংঘের নিয়মানুযায়ী, কোন দেশে কী পরিমাণ গাড়ি কত পথ চলছে এবং ঘর ও অফিস গরম রাখতে কী পরিমাণ জ্বালানি ব্যবহার করা হচ্ছে, তার ভিত্তিতে হিসাব জমা দেয় দেশগুলো। ২০১৫ সালে ১৯৫টি দেশের স্বাক্ষরিত প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি দুই বছর অন্তর ধনী বা গরিব সব দেশই তাদের দেশে কী পরিমাণ গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হচ্ছে, তার একটি স্বচ্ছ হিসাব জমা দেবে। কিন্তু এতে প্রকৃত হিসাব সামনে আসছে না। দেশগুলোর পক্ষ থেকে সঠিক তথ্য প্রদাণ না করায় ভুল থেকেই যাচ্ছে গ্যাস নিঃসরণের হিসাবে।

বায়ু-নমুনা ব্যবহার করে বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসের প্রকৃত মাত্রা নির্ণয় করা যায়। যুক্তরাজ্য ও সুইজারল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা এই পদ্ধতিতে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ নির্ণয় করে থাকেন। তারাই বলছেন, জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো সঠিক গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের হিসাব জমা দিচ্ছে না।

বিভিন্ন দেশে ফ্রিজ ও শীততাপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র থেকে যে পরিমাণ সিএফসি গ্যাস নিঃসরণ হয়, তা বায়ুমণ্ডলের উষ্ণায়নের জন্য কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে ১৪ হাজার ৮০০ গুণ বেশি দায়ী। কথা হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করতে হলে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের প্রকৃত হিসাব রাখা জরুরি। তা না হলে প্রতিকারমূলক সঠিক ব্যবস্থাও নেওয়া যাবে না।

একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে, আমাদের চারপাশের পরিবেশের আচরণ ক্রমেই পাল্টে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ ওজোন স্তর ক্ষয়ে যাওয়া। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগে এই ওজোন স্তর অবস্থিত। এটি এতদিন সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি আটকে রেখে জীবজগতকে রক্ষা করে আসছিল। কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট কিছু ক্ষতিকর গ্যাস নিঃসরণের কারণে ক্রমাগত ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে এই স্তর। পাল্টে যাচ্ছে পরিবেশের আচরণ। হুমকিতে পড়ছে গোটা মানবজাতি। যার বাইরে নয় বাংলাদেশও। এই ঝুঁকির প্রেক্ষাপটে আজ শনিবার বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর রক্ষা দিবস। গত ২২ বছর ধরে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।

১৯৭৪ সালে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রথম জানা যায়, বায়ুমণ্ডলে ক্রমবর্ধমান ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন বা সিএফসি গ্যাসের উপস্থিতির কারণে ওজোন স্তর ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। ফলে বায়ুমণ্ডল উষ্ণ হয়ে উঠছে। পৃথিবীব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনে তা ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। একই সঙ্গে ওজোন স্তর ক্ষয়ের কারণে পৃথিবীতে অতিবেগুনি রশ্মির বর্ধিত আপতন হচ্ছে এবং এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের ওপর।

ওজোন স্তর ক্ষয়রোধে তাই বিশ্ববাসী আজ সোচ্চার। আশির দশকের শেষ দিকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বসহকারে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়। প্রথমে ১৯৮৫ সালে ভিয়েনায় ওজোন স্তর রক্ষা সংক্রান্ত প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তী সময়ে আজ থেকে ৩০ বছর আগে আজকের দিনে ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ওজোন স্তরকে রক্ষা করার জন্য কানাডার মন্ট্রিল শহরে ওজোন স্তর রক্ষা সংক্রান্ত মন্ট্রিল প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। ওজোন স্তর সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে এই দিনটিকেই সে কারণে ওজোন স্তর রক্ষা দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়।

ওজোন স্তরের ক্ষয়ের জন্য শুধু কার্বন-ডাই অক্সাইডের কথা বলা হলেও এর জন্য অন্য কিছু গ্যাসও দায়ী। এগুলো হচ্ছে মিথেন (১৯%), ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন (১৭%), ওজোন (৮%), নাইট্রাস অক্সাইড (৪%), জলীয় বাষ্প (২%)। যদিও কার্বন-ডাইঅক্সাইড একা ৫০% দায়ী।

মিথেন : আমরা রান্না-বান্নার কাজে কিংবা সিনজি হিসেবে যে গ্যাস ব্যবহার করি সেটাই মিথেন গ্যাস। মাটির নিচে পোট্রোলিয়াম থেকে মিথেন গ্যাস সৃষ্টি হয় আবার জলাভূমির তলদেশ থেকেও অনেক সময় মিথেন গ্যাস নির্গত হয়। গবাদি পশুর গোবর মিথেন গ্যাসের একটি উৎকৃষ্ট উৎস। এই গোবর থেকেই বায়োগ্যাস উৎপাদন করা হয়। প্রতিবছর গরুর গোবর থেকে বিপুল পরিমান মিথেন গ্যাস বায়ুমণ্ডলে নিঃসৃত হয়ে গ্রিন হাউজ ইফেক্টের পরিমান বাড়িয়ে দিচ্ছে।

ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন : এটা সিএফসি বা ফ্রেয়ন নামেও পরিচিত। এটা ওজন স্তর ধ্বংস করে সে ব্যাপারে অনেকেই অবগত। কিন্তু গ্রিন হাউজ ইফেক্টেও এর ভূমিকা কম নয়। একসময় এরোসল তৈরিতে এবং রেফ্রিজারেটরে শীতলকারক হিসেবে সিএফসি ব্যবহার করা হত। তবে বর্তমানে এর ক্ষতিকর প্রভাব অনুধাবন করায় এবং বিকল্প আবিষ্কৃত হওয়া নিঃসরনের পরিমান কমেছে।

ওজোন : এটা অক্সিজেনের একটি রূপভেদ। সাধারন অক্সিজেন গ্যাসের অনুতে দুটি অক্সিজেন পরমানু থাকে, কিন্তু ওজোন অনুতে তিনটি অক্সিজেন পরমানু থাকে। বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর গঠিত হয় ওজোন দ্বারা। এটা সূর্য থেকে ক্ষতিকর আলট্রাভায়োলেট রশ্মি শোষণ করে আমাদেরকে রক্ষা করে। তবে গ্রিন হাউজ ইফেক্টের জন্য কিছুটা অভিযুক্ত।

নাইট্রাস অক্সাইড : নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের একটি যৌগ। বজ্রপাতের সময় বাতাসের অক্সিজেন ও নাইট্রোজেনের সমন্বয়ে তৈরি হয়।

জলীয় বাস্প : পানির গ্যাসীয় রূপ। মেঘ সৃষ্টি করে ও বৃষ্টিপাত ঘটায়।

মন্ট্রিল প্রটোকল অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালের ১ জুলাই থেকে ওজোন স্তর ক্ষয়কারী সিএফসি-১১ ও সিএফসি-১২ এর আমদানি ও ব্যবহারের ওপর নিয়ন্ত্রণ শুরু হয়েছে। ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে সিএফসি গ্যাসের ৫০ শতাংশ, ২০০৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৮৫ শতাংশ এবং ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে প্রধান প্রধান ওজোন স্তর ক্ষয়কারী দ্রব্য, যেমন সিএফসি-১১, সিএফসি-১২, কার্বনটেট্রাক্লোরাইডের ব্যবহার শতভাগ হ্রাস করার বাধ্যবাধকতা ছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশ মন্ট্রিল প্রটোকল বাস্তবায়নের সবগুলো ধাপ পালন করেছে। ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি শুধু ওষুধ শিল্প ছাড়া ওডিএস ক্ষয়কারী দ্রব্যের ব্যবহার শতভাগ হ্রাস করতে সক্ষম হয়েছে।

সবচেয়ে বড় কথা, বাসযোগ্য পৃথিবীর লক্ষ্যে আমাদের অবশ্যই আরো বেশি সতর্ক হতে হবে। মনে রাখতে হবে, মানবসৃষ্ট দূষণ ও বনাঞ্চল ধ্বংসের ফলে প্রকৃতি প্রদত্ত নিরাপত্তা বেষ্টনি ওজোন স্তর দিন দিন ক্ষয় হচ্ছে। গৃহস্থালি পণ্য যেমন ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশনার, বিভিন্ন ধরনের স্প্রে ইত্যাদিতে ব্যবহৃত ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন (সিএফসি) গ্যাস প্রভৃতির ব্যবহার দিনদিন বেড়েই চলেছে। সিএফসি গ্যাস মহাশূন্যের ওজোন স্তর ক্ষয়ের অন্যতম কারণ।

গাড়ির ধোঁয়া, কলকারখানার বর্জ্য, মারাত্মক পরিবেশ দূষণের ফলে ক্রমবধর্মান হারে নির্গত হচ্ছে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও মিথেন গ্যাস। আবার নির্বিচারে বনভূমি উজাড় করার ফলে অতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষিত হচ্ছে না। ফলে ওজোন স্তরের ক্ষয়জনিত কারণে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি মাত্রাতিরিক্ত পৃথিবীতে পৌঁছাচ্ছে। এভাবে পৃথিবী হয়ে উঠছে উত্তপ্ত। সামগ্রিকভাবে পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার ফলে এই পৃথিবী সমুদ্রপৃষ্ঠে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি, নিম্নভূমিতে প্লাবন, পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, আকস্মিক বন্যা, নদীভাঙন, খরা, সামুদ্রিক ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সম্মুখীন হচ্ছে। আসুন, আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর রক্ষা দিবসে উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে ধরিত্রীকে বাঁচাই। যাতে আমরা বলতে পারি, নিরাপদ সূর্যালোকে যতনে থাকিবে প্রাণ।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ