ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় হোক ‘মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়’

রাসেল পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৮, ১৯ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় হোক ‘মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়’

জনশক্তিকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে হবে

রাসেল পারভেজ : সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। দেশীয় শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণ, শ্রমিক অধিকারের সুরক্ষা ও তাদের দক্ষতা উন্নয়ন, মজুরি নির্ধারণ, যথাযথ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণ- মোটা দাগে বলতে গেলে এসব বিষয়ে কাজ করে এই মন্ত্রণালয়। এগুলো গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু গতানুগতিক কাজ। সময় এসেছে পরিবর্তনের। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে চলার তালের সঙ্গে মিল রেখে সময়োপযোগী করা দরকার শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নাম। কেন পরিবর্তন প্রয়োজন এই নিবন্ধে তা তুলে ধরার চেষ্টা করব।

সংগত কারণেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক ‘সময়োপযোগী করা’ বলতে কী বোঝাচ্ছে? এর উত্তর দেওয়া সম্ভব এই মন্ত্রণালয়ের ‘লক্ষ্য’ সম্পর্কে আলোকপাত করার মাধ্যমে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘শ্রমিক ও নিয়োগকর্তাদের মধ্যে ভালো শিল্প সম্পর্ক ও সম্পর্ক উন্নয়ন বজায় রাখার দ্বারা উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান ও মানবসম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য কমানো’ তাদের লক্ষ্য।

এখন এই লক্ষ্য নির্ধারণ করতে গিয়ে যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তার কিছু সংস্কার জরুরি। প্রথমেই আপত্তি ‘শ্রমিক’ শব্দটি নিয়ে। কারণ শব্দটি বৈষম্যমূলক। কাজের চেয়ে কায়িক শ্রমের ওপর বেশি গুরুত্বারোপ করায় ‘শ্রমিক’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যাকে শ্রমিক বলা হচ্ছে, ‘তিনি যে মানুষ, তার যে বুদ্ধিবিবেচনা আছে, কাজের মাধ্যমে তিনি যে দক্ষতা অর্জন করতে পারেন’- তার বেলায় এসব বিষয় অস্বীকার করা হয়। আর এর মাধ্যমে তাদের পরিচয় নির্ধারণ করা হয়, ঠেলে দেওয়া হয় সমাজ-সভ্যতার অন্ত্যজ শ্রেণিতে। কর্মঠ মানুষদের শ্রমিক বলে তাদের দক্ষতাকে অস্বীকার করা হয়।

শ্রমিক শব্দটির মধ্যে অতিমাত্রায় দাসত্বের গন্ধ আছে কি না, তা গবেষণার বিষয়। আশা করি, এ বিষয়ে কথা বলার মতো, সিদ্ধান্ত দেওয়ার মতো অনেক প্রাজ্ঞ ব্যক্তি রয়েছেন। তবে আপাতদৃষ্টিতে শ্রমিক শব্দটি দাসত্বের খোলসমুক্ত নয়। ফলে প্রথাগত এই শব্দটি পরিবর্তন করে মানুষকে সম্পদ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে পরিচয়সূচক নতুন শব্দ ব্যবহার করা যায়। শ্রমিক শব্দটির  বদলে ‘কর্মজীবী’ শব্দটি অথবা নতুন কোনো শব্দ প্রচলন করলে তাতে কর্মোপযোগী মানুষদের মানবসম্পদ বলে বিবেচনা করা সম্ভব।

লক্ষ্য নির্ধারণ করতে গিয়ে একটি শব্দ হয়তো সচেতনভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। শব্দটি হলো ‘মালিক’। এর পরিবর্তে ‘নিয়োগকর্তা’ ব্যবহার করা হয়েছে। এটি ভালো। অন্তত মানসিকভাবে কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পরিচয় বহন করে। এই সময়ে ছোট-বড় যেকোনো বিনিয়োগকারী তাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মজীবীদের কাছ থেকে ‘মালিক’ ডাক শুনতে চান বলে মনে হয় না। কারণ, প্রতিষ্ঠান দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর চলে না। এ জন্য দরকার প্রশিক্ষিত, দক্ষ মানবসম্পদ। শ্রমিক-মুনিব নয়, বরং এই দুই পক্ষের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ কর্মপরিবেশই পারে উৎপাদন বাড়াতে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্য একটু খেয়াল করলে আরেকটি বিষয় সহজেই ধরা পড়ে। শ্রমিকদের মানবসম্পদ বলে বিবেচনা করা হয়নি। কিন্তু মানবসম্পদের উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে। এটি পরস্পরবিরোধী ধারণা। মনে হচ্ছে, শ্রমিকরা শ্রমিকই থাকবেন, সমাজের অন্য কোনো স্তরের মানুষদের মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা হবে। গলদটা এখানেই। সরকারি-বেসরকারি মিল-কলকারখানা ও শিল্পপার্কের সর্বস্তরে যারা কাজ করেন, তারা কর্মজীবী, তারা মানবসম্পদ। ব্যক্তিকে মানবসম্পদ হিসেবে তৈরি করতে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন আছে। তাই বলে তা একমাত্র শর্ত নয়। বাস্তব জ্ঞান, কাজের মধ্যে দিয়ে দক্ষতা অর্জনই দক্ষ কর্মজীবী হয়ে ওঠার প্রধান শর্ত। কর্মজীবীদের এই শর্তের মধ্যে এনে সময়োপযোগী মানবদম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাজ হওয়া উচিত।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কাজ বিদ্যমান পরিস্থিতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। মন্ত্রণালয়ের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে চারটি প্রধান কার্যাবলির কথা বলা হয়েছে : শ্রমিক অধিকার সুরক্ষা, শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন, আইন, বিধি ও নীতি প্রণয়ন এবং আইএলও-সংক্রান্ত কার্যক্রম। সরকারের নীতি-নির্ধারণী এসব কাজ খুবই প্রয়োজন। কার্যাবলির বাইরে কিছু সেবার কথা বলা হয়েছে। প্রধান চারটি সেবা হলো : ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন, কারখানা লাইসেন্স প্রদান, দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম ও শ্রম-সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি। কার্যাবলি ও সেবার মাধ্যমে এই মন্ত্রণালয়কে বিচার করা সম্ভব।

মন্ত্রণালয়ের চারটি সেবার মধ্যে তৃতীয়টি ‘দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম’- এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে। দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয় ‘জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন পরিষদ’-এর মাধ্যমে। পরিষদের চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রী। এই পরিষদের কার্যাবলিতে সময়োপযোগী মানবসম্পদ গড়ে তোলার কথা হয়েছে। এর ভিশনে ‘দক্ষতা উন্নয়নের মান ও প্রাসঙ্গিকতার উন্নয়ন সাধন’-এর কথা বলা হয়েছে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রাসঙ্গিকতার উন্নয়ন সাধন না হলে সময়োপযোগী বিনিয়োগের জন্য দক্ষ জনশক্তি পাওয়া কঠিন। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী বিনিয়োগকারীরা প্রতিষ্ঠান গড়তে এগিয়ে আসেন। আর প্রতিষ্ঠান চালাতে প্রয়োজন সেই চাহিদা অনুযায়ী জনশক্তি। দেশে জনশক্তির অভাব নেই। অভাব আছে দক্ষ জনশক্তির। এর প্রধান কারণ, জনশক্তিকে মানবসম্পদে পরিণত করার প্রক্রিয়া খুবই মন্থর।

দেশের বিপুল কর্মক্ষম ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে সময়োপযোগী মানবসম্পদে পরিণত করার দায়িত্ব পড়ে এই মন্ত্রণালয়ের ওপর। খাতওয়ারি মানবসম্পদ প্রয়োজন। বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কারিগরি ক্ষেত্রে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে পারলে ‘সময় এখন বাংলাদেশের’ স্লোগান বাস্তবতার মুখ দেখবে। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন পরিষদের কার্যক্রমের আওতায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে দেশের সব কর্মজীবীকে আনতে হবে। এই প্রয়োজন মেটাতে এবং সময়োপযোগী মানবসম্পদ গড়ে তুলতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করে ‘মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়’ করা যেতে পারে। নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশ এবং উন্নত দেশ গড়তে জনশক্তিকে মানবসম্পদ হিসেবে তৈরি করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।

সময়ের চাহিদা অনুযায়ী মালয়েশিয়া সৃষ্টি করেছে ‘মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়’। তাদের শ্রম মন্ত্রণালয় নেই। শ্রমিক নিয়ে নয়, তারা মাথা ঘামাচ্ছে মানবসম্পদ তৈরিতে। বহু বিদেশির কর্মসংস্থান হয়েছে মালয়েশিয়ায়। কিন্তু মালয়েশিয়া কর্মী নেওয়ার আগে শর্ত দেয়, তারা খাতওয়ারি দক্ষ জনশক্তি চায়। ঢালাও শ্রমের ভিত্তিতে নয়, বরং দক্ষতার ভিত্তিতে জনশক্তিকে রাষ্ট্রীয় সম্পদে পরিণত করেছে তারা।

উন্নত দেশের আরেক রোল মডেল সিঙ্গাপুর। শ্রম মন্ত্রণালয় বলে কোনো মন্ত্রণালয় নেই সে দেশে। এ জাতীয় সব কাজ করে থাকে ‘জনশক্তি মন্ত্রণালয়’। তারা কি তাদের মন্ত্রণালয়ের নাম শ্রম মন্ত্রণালয় রাখতে পারত না? হয়তো। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মজ্জাগত একটি পরিবর্তন এসেছে তাদের মধ্যে। কর্মক্ষম মানুষকে তারা দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলেছে, শ্রমিক নয়। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি প্রতীয়মান হয়, তা হলো- কর্মজীবীদের জন্য যে অভিধাই ব্যবহার করা হোক না কেন, সিঙ্গাপুর চায় দক্ষ মানবসম্পদ।

জনশক্তিতে বিশ্বের বৃহত্তম দেশ প্রজাতান্ত্রিক চীনের দিকে তাকালেও সময়োপযোগী মন্ত্রণালয়ের ধারণা পাওয়া যায়। চীনেও শ্রম মন্ত্রণালয় বলে কোনো মন্ত্রণালয় নেই। কিন্তু একই ধারণার আধুনিকোত্তর রূপ নিয়ে কাজ করে দেশটির ‘মানবসম্পদ ও সামাজিক নিরাপত্তা মন্ত্রণালয়’। জাতীয় শ্রমনীতি থেকে শুরু করে প্রয়োজন অনুযায়ী মানবসম্পদ তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে তাদের মন্ত্রণালয়। প্রতিবেশী ভারতে এই কাজে নিয়োজিত মন্ত্রণালয়ের নাম বাংলাদেশের মতোই- শ্রম ও কর্মসংস্থান। তবে শিক্ষার সঙ্গে মানবসম্পদকে যুক্ত করে একটি মন্ত্রণালয় করেছে তারা। জাপানে ‘স্বাস্থ্য, শ্রম ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়’ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ‘শ্রম মন্ত্রণালয়’ দক্ষ জনবল তৈরিতে কাজ করছে। রাশিয়া ও ফ্রান্সে এই মন্ত্রণালয়কে বলা হচ্ছে, ‘শ্রম ও সামাজিক বিষয়াবলি-সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়’। তবে সার্কভুক্ত ভুটানে এর নাম ‘শ্রম ও মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়’। জনশক্তিকে মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার একটি প্রয়াস রয়েছে তাদের মধ্যে।

বিশ্বে একসময় জনসংখ্যাকে বোঝা মনে করা হতো। এখন ধারণা বদলেছে। উন্নত দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশ থেকে মানবসম্পদ নিচ্ছে। অর্থাৎ জনশক্তি মানবসম্পদে পরিণত হলে তাদের হাতেই ঘুরতে থাকে দেশের উন্নয়নের চাকা। এই চাকা সচল রাখতে প্রয়োজনীয় মানবসম্পদ তৈরি করতে প্রয়োজন মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়।

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ জানুয়ারি ২০১৭/রাসেল পারভেজ/তারা/ এএন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়