ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা

আবু সাঈদ মো. মোসাদ্দেক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৭, ২৬ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা

আবু সাঈদ মো. মোসাদ্দেক: সৃষ্টির প্রথম থেকেই অনুজীবের দ্বারা সৃষ্ট সংক্রমণ মানব জীবনের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে আসছে। এন্টিবায়োটিক আবিস্কারের পূর্বে রোগজীবানু সংক্রমণ অসুস্থতা ও মৃত্যুর জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয় ছিল। এন্টিবায়োটিক আবিস্কারের পরে এ সংক্রান্ত অসুস্থতা ও মৃত্যুর হার দ্রুত হ্রাস পায়।

বর্তমানে ঔষধ প্রতিরোধী (এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স) জীবানুর ফলে আবারও এর চিকিৎসা কঠিন হচ্ছে এবং মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঔষধ প্রতিরোধী জীবানুর সংক্রমণ এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে দ্রুত ছড়িয়ে গেলে বিশ্বব্যপী মহামারি বা রোগের প্রাদুর্ভাব সৃষ্টি হতে পারে। প্রকৃতিতে স্বত:স্ফুর্তভাবে ধীর গতিতে এদের বিস্তার ঘটছে কিন্তু ঔষধের অযৌক্তিক ব্যবহার এই জীবাণুর বিস্তারকে ত্বরান্তিত করবে।

এন্টিবায়োটিক যুগের সূচনা হয় ১৯২৮ সালে স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের পেনিসিলিন আবিস্কারের মাধ্যমে। এটাকে সে সময় ম্যাজিক বুলেট নাম দেওয়া হয়েছিল কারণ অনেক জীবণ সংহারী সংক্রমণ নিরাময়ে সাফল্যজনকভাবে এর ব্যবহার হয়েছিল এবং এখনও হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে ১৯৫০, ১৯৭৬, ১৯৮০ সালে সেফালোসপরিন, কার্বাপেনাম, ফ্লুরোকুইনোলন গ্রুপের এন্টিবায়োটিক আবিস্কার হয় যা জীবাণু সংক্রমনের ক্ষেত্রে  চিকিৎসায় যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। যদিও আজাকাল এদের কার্যকারিতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের রিপোর্ট অনুসারে গত ৩০ বছর কোন উল্লেখযোগ্য এন্টিবায়োটিক আবিস্কার হয়নি। স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং ১৯৪৫ সালে নোবেল পুরস্কার গ্রহণের পর ঔষধ প্রতিরোধী জীবানুুর সংক্রমণ সম্পর্কে সতর্ক ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন। এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু এখন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তিবর্গ ও রোগীর জন্য একটি বড় সমস্যা।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু দ্রুত বিস্তার লাভ করছে সারা বিশ্বে। এর ফলে সাধারণ রোগ সংক্রমণের চিকিৎসাও দিন দিন জটিল হচ্ছে। এটা বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি ক্রমবর্ধমান গুরুতর হুমকি যা মোকাবেলার জন্য সরকারের দায়িত্বশীল বিভাগ ও সমাজের সমন্বিত কর্ম পরিকল্পনা প্রয়োজন।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুসারে পৃথিবীতে বর্তমানে ঔষধ প্রতিরোধী জীবাণুর সংক্রমণে সাত লাখ মানুষ প্রতিবছর মারা যাচ্ছে। ২০৫০ সালে এটা ১ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এর মধ্যে শুধু এশিয়াতে প্রতি বছর মারা যাবে ৪৭ লাখ ৩০ হাজার।

এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্সের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বাংলাদেশে কোন সামগ্রিক তথ্য নেই। এর ফলে কত মানুষ প্রতিবছর মারা যাচ্ছে তার তথ্য নেই। এখনই এটা প্রতিরোধের ব্যবস্থা না নিলে পূর্বে যে রোগের সহজে চিকিৎসা করা সম্ভব হয়েছে তার নিরাময় অসম্ভব হয়ে দাড়াবে এবং রোগী মারা যাবে। এ অবস্থার সম্মুখীন যাতে না হতে হয় তার জন্য এন্টিবায়োটিকের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তার জন্য আমাদের জাতীয় ও হাসপাতাল ভিত্তিক এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের নীতিমালা তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

এ সংক্রান্ত নীতিমালার প্রাথমিক উদ্দেশ্য দুটি-

১। এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু দ্বারা রোগ সংক্রমণ ও এর কারণে মৃত্যুর হার কমানো।
২। এন্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা মানবদেহে যাতে অক্ষুন্ন থাকে তা নিশ্চিত করা।

এখানে থাকবে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রথম পছন্দের এন্টিবায়োটিকের নাম যা সকল শ্রেণির চিকিৎসক অথবা এ সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা দলের প্রতিনিধির পরামর্শেই শুধু ব্যবহার করা উচিত। নীতিমালায় ঔষধ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য যেমন কীভাবে কাজ করে, যে যে জীবাণুর বিরুদ্ধে কাজ করে তা, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, খরচ ইত্যাদি উল্লেখ থাকা উচিত। নীতিমালা সহজ, চিকিৎসাগতভাবে প্রাসঙ্গিক ও সহজে অনুসরণ করা যায় সে রকম হওয়া উচিত। এটি ছোট বই আকারে এবং ইন্টারনেটে থাকতে পারে।

একটি নীতিমালা তৈরির ধাপসমূহ নিম্নরুপ হওয়া উচিত -
১। হাসপাতালে রোগ সংক্রমণ ও এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণুদ্বারা রোগ সংক্রমণ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ।
২। এন্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা পরীক্ষার ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ।
৩। কার্যকর মানসম্পন্ন চিকিৎসা নীতিমালা।
৪। সমন্বিত এন্টিবায়োটিক ব্যবহার বিধি।

এটা তৈরির জন্য বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে ৬ থেকে ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা উচিত। এতে থাকবেন ফার্মাকোলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও সংক্রামক ব্যধি বিশেষজ্ঞ, শল্যচিকিৎসক ও ফার্মাসিস্ট। এ কমিটির কাজ হবে এন্টিবায়োটিক নীতিমালা তৈরি, বাস্তবায়ন নিরীক্ষা, ফলাফল নির্ধারণ, চিকিৎসকদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে সংশোধন ও চিকিৎসায় ব্যবহৃত ঔষধ তত্ত্বাবধান করা। এটি বর্তমান চিকিৎসা জ্ঞান, চর্চা ও এ সম্পর্কিত স্থানীয় অবস্থার ভিত্তিতে অভিজ্ঞ ব্যক্তি/বিশেষজ্ঞ দ্বারা পর্যালোচনা করে পরিবর্তিত হতে পারে। এ সংক্রান্ত নীতিমালা জাতীয় ও একটি নির্দিষ্ট হাসপাতাল ভিত্তিক হতে পারে।

আমাদের দেশে এ সম্পর্কিত কোন জাতীয় নীতিমালা নেই। তবে শুধু কিছু হাসপাতাল তাদের প্রতিষ্ঠানের জন্য নিজস্ব নীতিমালা তৈরি করেছে এবং তা বাস্তবায়ন করছে। 

এন্টিবায়োটিক নীতিমালা অনুসরণ করলে এন্টিবায়োটিকের যুক্তিসঙ্গত ব্যবহার বাড়বে এবং এর ফলে ঔষধ প্রতিরোধী জীবাণুর বিস্তার কমবে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে এন্টিবায়োটিকের যুক্তিযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সেটা এ বিষয়ে নীতিমালা তৈরি ও বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সম্ভব।

লেখক : চিকিৎসক এবং অধ্যাপক। বিভাগীয় প্রধান, ফার্মাকোলজি বিভাগ, উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল কলেজ।

 




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ জুলাই ২০১৭/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়