ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ইউরেনিয়াম বন্ধু নাকি শুধুই শত্রু

স্বপ্নীল মাহফুজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩১, ২৫ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইউরেনিয়াম বন্ধু নাকি শুধুই শত্রু

স্বপ্নীল মাহফুজ : বলা যায় হঠাৎ করেই আমাদের দেশে ‘ইউরেনিয়াম’ শব্দটি বেশ উচ্চারিত হচ্ছে। যদিও এ কথা বলা যায় যে, এই মৌল সম্পর্কে সঠিক ধারণা অনেকেরই নেই। এটি মূলত তেজস্ক্রিয় এবং নীলাভ সাদা বর্ণের ধাতু এবং পর্যায় সারণীর ৯২তম মৌল। ১৭৮৯ সালে বিজ্ঞানী মার্টিন হাইনরিখ ক্ল্যাপরথ ইউরেনিয়াম আবিষ্কার করেন। তিনি ইউরেনাস গ্রহের নামানুসারে এর নামকরণ করেন। কেননা সে সময় ইউরেনাস গ্রহের আবিষ্কারের ঘটনা ছিল সবচেয়ে সাম্প্রতিক। কিন্তু প্রথম ইউরেনিয়াম সংশ্লেষ করা হয় ১৮৪১ সালে। সে বছর বিজ্ঞানী ইউজিন পেলিকট ইউরেনিয়াম টেট্রাক্লোরাইড (UCl4) থেকে প্রথম ইউরেনিয়াম (U) সংশ্লেষ করেন।

১৮৬৯ সালে যখন দিমিত্রি মেন্ডেলিভ পর্যায় সারণী আবিষ্কার করেন তখন ইউরেনিয়াম সবচেয়ে ভারী মৌল হিসেবে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৯৪০ সালে প্রথম ট্রান্সইউরেনিয়াম মৌল তথা নেপচুনিয়াম আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত এটিই ছিল সবচেয়ে ভারী। ১৮৯৬ সালে বিজ্ঞানী হেনরি বেকেরেল ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেন। তখন থেকেই মূলত বলা হয়ে থাকে এটি অত্যন্ত ভারী তেজস্ক্রিয় পদার্থ। ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগে এ পদার্থের পরিমাণ শতকরা ০.০০৪% ভাগ। আকরিক থেকে শোধন করে ইউরেনিয়াম আইসোটোপ পাওয়া যায়। যেমন-ইউরেনিয়াম-২৩৮, যার পারমাণবিক ওজন ২৩৮ অর্থাৎ এর নিউক্লিয়াসে আছে ৯২টি প্রোটন এবং ১৪৬টি নিউট্রন। প্রকৃতিতে এ ধরনের আইসোটোপ বেশিমাত্রায় পাওয়া যায়। এক হিসাবে দেখা গেছে শতকরা ৯৯.৩% ভাগই এ জাতীয় ইউরেনিয়াম। দ্বিতীয় আইসোটোপটির নাম ইউরেনিয়াম-২৩৫ অর্থাৎ এর নিউক্লিয়াসে আছে ৯২টি প্রোটন এবং ১৪৩টি নিউট্রন। প্রকৃতিতে এদের পরিমাণ শতকরা মাত্র ০.৭% ভাগ। তৃতীয় প্রকারের আইসোটোপের পরিমাণ একেবারেই নগণ্য, যা প্রায় হিসাবের মধ্যেই ধরা হয় না।

এবার দেখা যাক ইউরেনিয়াম এখন পর্যন্ত মানবজাতির কী কাজে এসেছে এবং কী কেড়ে নিয়েছে

ইউরেনিয়ামের সবচেয়ে উপকারী ব্যবহার হলো নিউক্লিয় চুল্লীতে এর ব্যবহার। নিউক্লিয় চুল্লী বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম মাধ্যম। সর্বপ্রথম পৃথিবীর মধ্যে পারমাণবিক চুল্লী তৈরি করেন ইতালীয় বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মি। তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক উভয় অংশে তার ছিল অসাধারণ দক্ষতা। তিনি দেখান কোনো পারমাণবিক চুল্লীতে আধ টন ইউরেনিয়াম শক্তিতে রূপান্তরিত হলে গড়পড়তা ৪ জন লোকের একটি পরিবারের ৭০ লাখ ৩০৭ হাজার ৬০২ বছর ৩ মাস পর্যন্ত সব রকমের বৈদ্যুতিক চাহিদা পূরণ সম্ভব।

এতো গেল ইউরেনিয়ামের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ। এবার চলুন মৌলটির শত্রুতাপূর্ণ আচরণ জেনে নেই। পারমাণবিক বোমা ও শক্তির উৎস হিসেবে ইউরেনিয়াম ব্যাবহার করা হয়। পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয় ইউরেনিয়াম-২৩৫। দেখা গেছে, এক পাউন্ড ইউরেনিয়াম-২৩৫ একসঙ্গে বিভাজিত হলে যে শক্তি সৃষ্টি হবে তার পরিমাণ ১০ মিলিয়ন শর্ট টন (৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন) টিএটি। পারমাণবিক বিস্ফোরণের কারণে যে শক্তি বের হয় তা তাপ শক্তি, যান্ত্রিক শক্তি এবং বিদ্যুৎ শক্তিতে আত্নপ্রকাশ করে বিপুল ধ্বংস সাধন করে। আগুন এবং প্রচণ্ড উত্তাপ সৃষ্টি করে বোমা নিক্ষিপ্ত স্থানে ছড়িয়ে পড়ে।

ইউরেনিয়ামের শক্তির তাণ্ডব বিশ্ব দেখেছিল প্রথম আণবিক বোমার প্রয়োগ হলে। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা শহরে বোমা নিক্ষিপ্ত হয়। হিরোশিমাতে যে পারমাণবিক বোমাটি নিক্ষেপ করা হয়েছিল তার ধ্বংস ক্ষমতা ছিল ১৩,০০০ শর্ট টন টিএনটি। বোমাটির ওজন ছিল ৯,০০০ পাউন্ড (৪,১০০ কেজি)। এতে এক মুহূর্তেই প্রাণহানি ঘটেছিল ৭৫ হাজার লোকের। এবং পরে মোট মৃতের সংখ্যা দাড়ায় প্রায় ১ লাখ ৬৬ হাজার। এর একটি শৌখিন নামও ছিল ‘ক্ষুদে বালক'’ (Little Boy)।

এরই মাত্র তিনদিন পরে নিক্ষেপ করা হয়েছিল দ্বিতীয় বোমাটি। ১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট জাপানের নাগাসাকি শহরে ফেলা হয়েছিল সেটি। সেদিন একটি আমেরিকান বি-২৯ বোমারু বিমান দক্ষিণ-পশ্চিম জাপানের কাইউসু দ্বীপের কোকুরা অভিমুখে উড়ে আসে। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে বিমান গতিপথ পরিবর্তন করে নাগাসাকি শহরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সে বহন করেছিল ‘ফ্যাট ম্যান’ সাংকেতিক নামের আণবিক বোমা।

হিরোশিমার বোমার চেয়ে শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও নাগাসাকির ভৌগোলিক কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে হতাহতের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম ছিল। কিন্তু তার পরেও সেখানে নিহত হয়েছিল ৪০,০০০ মানুষ। এবং গুরুতর আহত হয় আরো প্রায় ৭৫,০০০ মানুষ। বোমাটির ওজন ছিল ১০,০০০ পাউন্ড (৪,৫০০ কেজি)। হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত দুটি বোমার আঘাতে নিমেষেই প্রায় লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানী ঘটেছিল। আহত হয়েছিল আরও প্রায় দেড় লাখ মানুষ। যাদের অনেকেই পরবর্তিতে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিল। এবং অচিরেই এই মৃতের সংখ্যা গিয়ে দাড়ায় ২ লাখ ৩০ হাজার।

এখন যদি নির্ণয় করতে বলা হয় ইউরেনিয়াম আমাদের বন্ধু নাকি শত্রু তবে এর উত্তর দিতে অপারগ সকল বিশেষজ্ঞ কিংবা সাধারণ মানুষ। সম্প্রতি আমাদের হাওর অঞ্চলের জীববৈচিত্র ধ্বংসে ভারতের ইউরেনিয়াম খনি থেকে ভেসে আসা ইউরেনিয়ামকে দায়ী করা হলেও এই তথ্যের সত্যতা মেলেনি। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা মানবজীবন থেকে শুরু করে জীববৈচিত্র-সব কিছুর জন্য বিরাট হুমকি। হাওরের পানিতে ইউরেনিয়াম- এ প্রসঙ্গে আমরা এই হুমকি থেকে মুক্ত এতে কোনো ভুল নেই।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ এপ্রিল ২০১৭/তারা 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ