ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

যুব গেমস : সম্পদ হয়ে উঠুক প্রতিভাবানরা

মামুন হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:০৬, ২৩ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যুব গেমস : সম্পদ হয়ে উঠুক প্রতিভাবানরা

মামুন হোসেন : প্রতি চার বছর অন্তর আয়োজন করা হবে ‘বাংলাদেশ গেমস’।

২০১৩ সালে গেমসের অষ্টম আসর আয়োজনের সময় এমন কথাই বলেছিলেন বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) কর্তারা। দীর্ঘ ১১ বছর বোতলবন্দি থাকা ‘বাংলাদেশ গেমস’ পুনরায় চালু করে সে সময় তৃপ্তির ঢেঁকুরও তুলতে দেখা গেছে। এখনো কথায় কথায় তোলেন!

২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল। সময়ের পার্থক্য পাঁচ বছর। ডেডলাইন চার বছর পেরিয়ে গেছে। ‘বাংলাদেশ গেমস’ কিন্তু আলোর মুখ দেখিনি। তার মানে স্পষ্ট; বলা কথা রক্ষা করতে ব্যর্থ বিওএ কর্তারা।  তবে যে কথা রেখেছেন তা একেবারে ফেলনা নয়।

বিওএ’র বর্তমান নির্বাচিত কমিটির সদস্যরা দায়িত্ব নেওয়ার আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ যুব গেমস আয়োজন করবেন তারা। যদিও এটি গত মেয়াদেই আয়োজন করার কথা ছিল। তবে গত মেয়াদে না পারলেও এবার তা আয়োজন করেছে। এবং বেশ বড় পরিসরে, জমকালো আয়োজনে।

 



যুব গেমস দেশে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশে এত বড় ক্রীড়াযজ্ঞ সুষ্ঠু, সুন্দর ও পরিচ্ছন্নভাবে খুব কমই আয়োজিত হয়েছে। এ জন্য বিভিন্ন মহলের প্রশংসাও কুঁড়িয়েছে বিওএ।

তৃণমূল থেকে প্রতিভাবান এবং দেশের ভবিষ্যৎ জাতীয় খেলোয়াড় তুলে আনার মহতী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে ৬৪ জেলার ক্রীড়াবিদদের অংশগ্রহণে আয়োজিত হয় যুব গেমস। এতে প্রায় ২৭ হাজার অনূর্ধ্ব-১৭ বছর বয়সি তরুণ-তরুণীরা ২১ ডিসিপ্লিনে নিজেদের ক্রীড়া নৈপুণ্যে তুলে ধরার সুযোগ পান।

তিনটি ধাপে প্রতিযোগিতাটি সম্পন্ন হয়। গত ১৮ ডিসেম্বর উপজেলা- জেলা পর্যায়ে, চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি বিভাগীয় পর্যায়ে এবং গত ১০ মার্চ  ঢাকায় শুরু হয় গেমসের চূড়ান্তপর্ব।

২১ ডিসিপ্লিনে তরুণ-তরুণী পদকের লড়াইয়ে মোকাবিলা করেন। ডিসিপ্লিনগুলো হল- ফুটবল, ভলিবল, বাস্কেটবল, হকি, কাবাডি, হ্যান্ডবল, অ্যাথলেটিকস, সাঁতার, ব্যাডমিন্টন, শুটিং, টেবিল টেনিস, স্কোয়াশ, কারাতে, তায়কোয়ান্ডো, কুস্তি, জুডো, উশু, ভারোত্তোলন, বক্সিং, আরচ্যারি এবং দাবা।

 



প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান পৃষ্ঠপোষক করে বাংলাদেশ যুব গেমসের ১৫১ সদস্যের একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয়। যেখানে কমিটির চেয়ারম্যান করা হয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে। গেমসটি সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালনার জন্য ১২টি উপকমিটিও গঠন করা হয়। উদ্বোধনী এবং সমাপনী অনুষ্ঠানের খরচ ব্যতিরেকে গেমসের বাজেট বরাদ্দ ধরা হয় ১৫ কোটি টাকা। যার পুরোটাই বিভিন্ন পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেয়া হয়।

আড়াই হাজারের কিছু বেশি প্রতিযোগীদের নিয়ে ঢাকায় চলে গেমসের ফাইনাল রাউন্ড। ২১ ফেডারেশনকে এই রাউন্ড পরিচালনার দায়িত্ব দেয় বিওএ।  গেমসে অংশ নেয়া ক্রীড়াবিদদের আবাসন সুবিধা, দৈনিক ভাতা বন্টণ, আসা-যাওয়ার খরচ, তাদের ট্র্যাকস্যুট, বিভাগীয় দলের জার্সি সব কিছু ফেডারেশনগুলোর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। এর বাইরে চূড়ান্তপর্বে অংশ নেওয়া প্রতিযোগিদের বয়স নির্ধারণী পরীক্ষার জন্য মেডিকেল কমিটিও গঠন করে অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন।

গত ১০ মার্চ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে গেমসের চূড়ান্তপর্বের উদ্বোধন করেন ক্রীড়াবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বর্ণিল সাজে সাজিয়ে তোলা হয় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। বর্ণিল আলোকচ্ছটা আর আঁতশবাজির ঝলকানিতে সেদিন আলোকময় হয়ে ওঠে স্টেডিয়াম পাড়া। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বিওএ। 

১০ মার্চ গেমসের উদ্বোধন হলেও তার আগেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ৭ মার্চ ফুটবল ইভেন্ট দিয়ে যুব গেমসের চূড়ান্তপর্বের পদকের লড়াইয়ে নামে প্রতিযোগিরা।  প্রতিযোগিতার পর্দা নামে ১৮ মার্চ।

 



প্রশ্ন হচ্ছে, যাদের জন্য এ বৃহৎ এবং মহতী ক্রীড়াযজ্ঞের আয়োজন তারা কতোটুকু কী পেল! কিংবা গেমসের লক্ষ্য, উদ্দেশ্যই বা কতোটুকু পূরণ হল? তৃণমূল থেকে যতজন প্রতিভাবান খেলোয়াড় ওঠে আসার কথা ছিল ঠিক ততজন কি ওঠে এসেছে?

হ্যাঁ, ওঠে এসেছে, তবে সেই সংখ্যা প্রত্যাশিত নয়। আবার একেবারে খারাপও বলা যাবে না। এটা অনেকটা মন্দের ভালোর মতো।  বিভিন্ন বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার হয়ে অংশ নিলেও যারা পদক জিতেছেন তাদের অধিকাংশই দেখা গেছে বিকেএসপির খেলোয়াড়। সাঁতার থেকে শুটিং, অ্যাথলেটিকস সব খানেই দাপট ছিল বিকেএসপির।

তবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে দাপট দেখিয়েছে অন্যরাও। এমন অনেক সাধারণ তরুণ-তরুণী যারা এই গেমসের মাধ্যমে প্রথমবার খেলাধুলায় অংশ নিয়েছে; এদের অনেককে পদক জিততেও দেখা গেছে। এজন্য  বড় একটা ধন্যবাদ পেতেই পারে বিওএ কর্তারা। গেমস আয়োজনের উদ্দেশ্য যে ছিল এটিই।

যুব গেমসের প্রথম স্বর্ণ পদকটি এসেছে শুটিং থেকে। পাবনার এক অটো রিকসা চালকের ছেলে মেহেদী হাসান লিমন সেটি জিতেছে। যার বিকেএসপির মতো ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানে পড়ার কিংবা উচ্চ পর্যায়ে অনুশীলনের জ্ঞান ছিল না বললেই চলে!

 



নূরজাহান আক্তার ময়নার কথাই ধরুন। বাগেরহাটের এ ভারোত্তোলকের বাবাও অটো চালক। মেয়েটি প্রথমবার কোনো গেমসে অংশ নিয়ে তাতেই করেছেন বাজিমাত। ৪৮ কেজি ওজন শ্রেণীতে জিতেছেন স্বর্ণ পদক। ময়নার এখন একটাই স্বপ্ন জাতীয় ভারোত্তোলক হয়ে মাবিয়া আক্তার সীমান্তের মতো আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে দেশের জন্য পদক বয়ে নিয়ে আসা।

খুলনার মেয়ে ফাতেমা আক্তার কেয়া ২০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে স্বর্ণ জিতে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। অথচ এই সাঁতারুর ছিল না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ।  বাড়ির পুকুরে সাঁতর কেটে যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছেন তা দিয়েই যুব গেমসে আলো কেড়ে নিয়েছেন। এখন মাহফুজা খাতুন শিলা, নাজমা খাতুনদের মতো দেশসেরা সাঁতারু হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন এই জলকন্যা।

লিমন-ময়না-কেয়াদের মতো প্রতিশ্রুতিশীল প্রতিযোগীদের বাইরে কিছু পরিচিত, জানা শোনা মুখ ট্র্যাক অ্যান্ড, রেঞ্জ এবং পুলে ঝড় তুলেছেন। জাতীয় পর্যায়ে আলো ছড়ানো পদক জয়ী সাঁতারু আরিফুল ইসলাম যুব গেমসে পাঁচটি ইভেন্টে অংশ নিয়ে পাঁচটিতেই জিতে নিয়েছেন স্বর্ণ। ১০০ মিটার কিংবা ২০০ মিটার স্প্রিন্টে যারা বিজয়ী হয়েছেন তারাও জাতীয় পর্যায়ে খেলেছেন, সাফল্য দেখিয়েছেন।

১০০ মিটার স্প্রিন্টে যে হাসান মিয়া এবং রুপা খাতুন সেরার খেতাব জিতেছেন, তারা দু’জনই জাতীয় জুনিয়রে সেরা হয়েছেন, দুজনই বিকেএসপির শিক্ষার্থী। একইভাবে ২০০ মিটার স্প্রিন্টেও জাতীয় পর্যায়ের দুই অ্যাথলেট জহির রায়হান এবং শিউলি খাতুন করেছেন বাজিমাত।

 



১৮ মার্চ যুব গেমসের সমাপনী ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। গেমসের আগেই বিওএ কর্তারা ঘোষণা দিয়েছিলেন, যুব গেমস থেকে বের হয়ে আসা প্রতিযোগীদের উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তোলা হবে। তারা এও বলেছিলেন, একবার আয়োজন করেই যুব গেমস ফাইলবন্দি করে রাখা হবে না। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ গেমস এবং ২০২০ সালে পুনরায় যুব গেমস আয়োজন করা হবে।

অতীতেও অনেকে অনেক কথা বলেছেন। রেখেছেন খুব অল্পজনই। এবারের যুব গেমসে তৃণমূল থেকে উঠে আসা প্রতিভাবানদের দিকে বাড়তি নজর দেবে এবং তাদের উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে- বিওএর থেকে এমন চাওয়া বোদ্ধা থেকে সাধারণের। নইলে যুব গেমস শুধু নামেই একটি আয়োজন হয়ে থাকবে। আলোর নিচে অন্ধকারের প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকবে!  প্রতিভাবানরা হয়ে উঠুক বাংলাদেশের সম্পদ। এমনটাই সবার চাওয়া।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ মার্চ ২০১৮/মামুন/ইয়াসিন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ