ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

অ্যাবাকাস থেকে ব্যক্তিগত কম্পিউটার: অতীত জানুন

মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫৮, ১২ অক্টোবর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অ্যাবাকাস থেকে ব্যক্তিগত কম্পিউটার: অতীত জানুন

প্রতীকী ছবি

মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম : উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণের সহজ দুইটি মাধ্যমে অ্যাবাকাস এবং ব্যক্তিগত কম্পিউটার (পার্সোনাল কম্পিউটার বা সংক্ষেপে পিসি)। উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণের কাজে ব্যবহৃত এই যন্ত্রদ্বয়ের মধ্যে অনেকটা সামঞ্জস্য থাকলেও ইতিহাসের পাতায় এই দুটো যন্ত্রের মধ্যে সময়ের পার্থক্য রয়েছে কয়েক হাজার বছরের।

 

এই নিবন্ধের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে যন্ত্র দুটোর মধ্যবর্তী সুদীর্ঘ পথপরিক্রমার কিছু মাইলফলক প্রত্যক্ষ করা।

 

প্রথম রেকর্ড-কিপার এবং তাদের যন্ত্রসমূহ
মানুষ উপাত্ত লিপিবদ্ধকরণ ছাড়া পৃথিবীতে অনন্তকাল ধরে বসবাস করলেও জাতি গঠনে, ব্যবসা-বাণিজ্যে ও প্রাত্যহিক জীবন-যাত্রায় প্রভূত উন্নতি সাধন করতে পেরেছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দে ব্যাবিলনীয় বণিকগণ ক্লে ট্যাবলেটে তাদের উপাত্ত সংরক্ষণ করতেন। খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ অব্দে চীনারা অ্যাবাকাস নামক একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন। অ্যাবাকাস ছিল একটি হস্তচালিত আদি গণনাকারী যন্ত্র। আবিষ্কারের পর থেকে এর ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। চীন দেশে অ্যাবাকাসকে বলা হয় সুয়ান-প্যান আর জাপানে বলা হয় সরোবান। যদিও এই যন্ত্র ৩০০০ বছর আগের তথাপি আজও পৃথিবীর কোনো কোনো জায়গায় এর ব্যবহার রয়েছে।

 

উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণের ধারাবাহিকতায় নিরীক্ষা (গ্রিকরা) এবং বাজেট (রোমানরা) সংরক্ষণের নবধারা হিসেবে রেকর্ড-কিপিং কৌশলের উন্নয়ন অব্যাহত থাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। ১৬৪২ সালে ব্লেইজ প্যাককেল (যার সম্মানে একটি আধুনিক প্রোগ্রামিং ভাষার নামকরণ করা হয়েছে) নামে একজন ফরাসি যুবক প্রথম যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর যন্ত্রের উন্নয়ন করেছিলেন। এর ৩০ বছর পর গটফ্রেইড ভন লেইবনিৎজ নামে একজন জার্মান গণিতবিদ প্যাসকেলের উদ্ভাবিত যন্ত্রের ব্যাপক উন্নয়ন করে এমন একটি যন্ত্র উপস্থাপন করেছিলেন যার মাধ্যমে যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ এবং সংখ্যামূল বের করা যেত। তবে যন্ত্রটি কীভাবে তৈরি করা হতো তা কেউ জানত না।

 

এমনকি ১৮৮০ সালেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পেন্সিল, কলম এবং মাপকাঠির মাধ্যমে উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণ সম্পন্ন হতো। সেই সময়কালে উপাত্তের বড় খণ্ডগুলো দ্রুত বিশালাকৃতির রূপ ধারণ করতে থাকে এবং হস্তলিখিত এই পদ্ধতি একেবারে নির্ভুল ছিল না। তাছাড়া এই পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াকরণে লাগতো দীর্ঘ সময়। উদাহরণস্বরূপ ১৮৮০ সালের শুমারি ১৮৯০ সালের গণনা শুরুর আগে সম্পন্ন করতে পারেনি। সেন্সাস ব্যুরোর এই হতাশা থেকে ব্যুরো এবং অন্যদের জন্য উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেওয়ায় সেই সময়কালে সৌভাগ্যক্রমে ইলেক্ট্রোমেকানিক্যাল পাঞ্চড কার্ড ইক্যুইপমেন্ট আবিষ্কৃত হয়েছিল।

 

তাঁতী, পরিসংখ্যানবিদ ও তাদের কার্ডসমূহ
পাঞ্চড কার্ডের ইতিহাস ১৮০১ সালের দিকের। জোসেফ মেরি জ্যাকার্ড নামক একজন ফরাসি তাঁতি তার যান্ত্রিক তাঁত নিয়ন্ত্রণের জন্য পাঞ্চড কার্ড আবিষ্কার করেছিলেন। তবে ১৮৮০ সালে শুমারি গণনার সমাপ্তিতে সমস্যা দেখা দিলে পাঞ্চড কার্ডগুলোকে উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তখন শুমারি গণনার সমস্যা সমাধান করার জন্য সেন্সাস ব্যুরো হারম্যান হলেরিথ নামে একজন পরিসংখ্যানবিদকে ভাড়া করে। ১৮৮৭ সালে হলেরিথ তার যন্ত্র-পঠনযোগ্য কার্ডের ধারণার উন্নয়ন করেন এবং ‘সেন্সাস মেশিন’ নামে একটি যন্ত্র তৈরি করেন। হলেরিথের পদ্ধতিতে টেবুলেটিং করতে পূর্বের তুলনায় এক-অষ্টমাংশ সময় লেগেছিল। ফলে ১৮৯০ সালে তার কৌশলগুলোর ব্যবহার শুরু হয়। যদিও ১৮৮০-র দশকে জনসংখ্যা ৫০ থেকে ৬৩ মিলিয়ন বৃদ্ধি পেয়েছিল তথাপি এই গণনা ৩ বছরেই সমাপ্ত হয়েছিল। অবশ্যই এই গণনা সাম্প্রতিক সময়ের মানের তুলনায় ধীরগতির ছিল। ১৯৫০ সালের গণনায় পাঞ্চড কার্ড ইক্যুইপমেন্ট ব্যবহার করে ২ বছর সময় লেগেছিল এবং ১৯৮০ সালের কম্পিউটারাইজড শুমারি মাত্র কয়েক মাসে সম্পন্ন হয়েছিল।

 

১৮৯০ সালের শুমারির পর হলেরিথ তার যন্ত্রটিকে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য রূপান্তর করেন এবং দুটি রেলপথের জন্য ভাড়া গণনা পদ্ধতি স্থাপন করেন। এরপর ১৮৯৬ সালে হলেরিথ তার উদ্ভাবিত পণ্যসামগ্রী তৈরি এবং বিক্রি করার জন্য টেবুলেটিং মেশিন কোম্পানি নামক একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে এই কোম্পানি অপর কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একত্রিত হয়ে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস মেশিন (আইবিএম) কর্পোরেশন নামে বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠানটি গঠিত হয়।

 

পাঞ্চড কার্ড ৮ সেন্টিমিটার চওড়া এবং ১০ সেন্টিমিটার লম্বা পাতলা শক্ত কাগজের তৈরি। কার্ডটি মেশিনে সঠিকভাবে স্থাপন করার জন্য এককোনা সামান্য কাটা থাকে। পাঞ্চড কার্ডের প্রক্রিয়া একটি সাধারণ ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল। ধারণাটি হচ্ছে প্রদত্ত উপাত্ত প্রথমে ছিদ্রপথে সঙ্কেতরূপে (coded form) কার্ডে রেকর্ড করা হতো।

 

প্রক্রিয়াকরণের ধাপগুলো সম্পন্ন করার জন্য পরে এই কার্ডগুলো ইলেকট্রোমেকানিক্যাল মেশিনে ঢুকানো হতো। পাঞ্চড কার্ডের সাহায্যে উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণ হস্তচালিত পদ্ধতির চাইতে অধিক দ্রুতগতিসম্পন্ন এবং নির্ভুল ছিল। তবুও এতে প্রতিটি স্টেপের মধ্যে কার্ডের ট্রে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মানুষের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন ছিল এবং এই কার্ড পৃথক পৃথক মেশিনে ঢোকাতে, চালনা করতে এবং বন্ধ করতে হতো। উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণে এই মনুষ্য হস্তক্ষেপ ছিল বড়ই ঝঞ্ঝাটপূর্ণ। কম্পিউটারে এই ঝঞ্ঝাট সন্দেহাতীতভাবে দূরীভূত হয়েছে। এখন আর প্রতিটি ধাপে মানুষের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয় না।

 

আগেকার দিনে কম্পিউটারের উন্নয়ন
ব্যাবেজের বোকামি : হলেরিথের প্রচেষ্টার প্রায় ৫০ বছর আগে ব্রিটেনের ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের লুকেশিয়ান অধ্যাপক চার্লজ ব্যাবেজ ‘অ্যানালাইটিক্যাল ইঞ্জিন’ নামক একটি যন্ত্রের প্রস্তাব করেন। ব্যাবেজ ছিলেন একজন পাগলা কিচিমের এবং খুব মেজাজী মানুষ। যিনি অবিশ্বাস্যভাবে তার এই জটিল যন্ত্রটি সমাপ্ত করতে জীবনের অধিকাংশ সময় অযথা অপব্যয় করেন। ব্যাবেজের স্বপ্ন ছিল- এই যন্ত্রে থাকবে সংযুক্ত একটি পাঞ্চড কার্ড ইনপুট, স্মৃতি অথবা সংরক্ষণ অংশ, একটি গাণিতিক অংশ অথবা মিল (Mill), স্বয়ংক্রিয় মুদ্রণ ব্যবস্থা, আনুক্রমিক কার্যক্রম (প্রোগ্রাম) নিয়ন্ত্রণ এবং ২০-প্লেস নির্ভুলতা। ব্যাবেজ যে প্রটোটাইপ কম্পিউটার ডিজাইন করেছিলেন তা সে সময়ের তুলনায় ১০০ বছর এগিয়ে ছিল। ব্যাবেজের এই প্রচেষ্টায় সাহায্য করেছিলেন ব্রিটেনের স্বনামধন্য কবি লর্ড বায়রনের কন্যা লেডি অগাস্টা অ্যাডা লাভলেস। অ্যাডা ছিলেন একজন মেধাবী গণিতবিদ। তিনি ব্যাবেজের কাজের কিছু ক্রটি সংশোধন করেন এবং পাঞ্চড কার্ড ব্যবহারের নিমিত্তে প্রোগ্রাম তৈরির নতুন পন্থা আবিষ্কার করেন।

 

এই আবিষ্কারের জন্য লেডি অ্যাডাকে প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে অভিহিত করা হয় (তার সম্মানেও একটি আধুনিক প্রোগ্রামিং ভাষার নামকরণ করা হয়েছে ‘অ্যাডা’)। ১৮৭১ সালে ব্যাবেজের মৃত্যুর পর ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত কম্পিউটারের উন্নয়ন থেমে গিয়েছিল। আর পাঞ্চড কার্ড উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণের কাজে রাজত্ব করতে থাকে সারাবিশ্বে।

 

এবিসি, এনিয়াক এবং আদি প্রবর্তকবৃন্দ: হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হাওয়ার্ড অ্যাইকেন ১৯৩৭ সালে হলেরিথের পাঞ্চড কার্ডের কৌশলগুলো নিয়ে ইলেক্ট্রিক্যাল এবং মেকানিক্যাল প্রযুক্তির সমন্বয়ে একটি ক্যালকুলেটিং মেশিন তৈরির কাজ শুরু করেন। স্নাতকের কিছু ছাত্র এবং আইবিএম-এর প্রকৌশলীদের সহায়তায় তার এই প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছিল ১৯৪৪ সালে। এই প্রকল্পের ফলস্বরূপ আবিষ্কৃত হয় মার্ক ওয়ান নামক ডিজিটাল কম্পিউটার। এর অভ্যন্তরীণ অপারেশনগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হতো ইলেক্ট্রোমেগনেটিক রিলের সঙ্গে এবং গাণিতিক প্রক্রিয়া ছিল মেকানিক্যাল। মার্ক ওয়ান ছিল একটি ইলেক্ট্রোমেকানিক্যাল কম্পিউটার এবং এটি চার্লজ ব্যাবেজের স্বপ্নের যথাযোগ্য বাস্তবায়ন। ‘মধ্যযুগীয়’ এই যন্ত্রটি বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদর্শনের জন্য সংরক্ষিত আছে।

 

আইওয়া স্টেট কলেজের পাদার্থবিজ্ঞান ও গণিতের অধ্যাপক ড. জন ভিনসেন্ট অ্যাটানাসফ কর্তৃক প্রথম প্রটোটাইপ ইলেক্ট্রনিক কম্পিউটারের পরিকল্পনা হয়েছিল ১৯৩৭-১৯৩৮ সালের শীতকালে। কারণ সেই সময়ের বিদ্যমান গণনা যন্ত্র তার প্রয়োজন মেটাতে পারেনি। অ্যাটানাসফ সিদ্ধান্ত নেন তার নিজের মতো করে যন্ত্র আবিষ্কারের। তার মনের মধ্যে পরিকল্পনার ধারণাটি পরিষ্কার হয় এক শীতের রাতের শেষভাগে ইলিনয়েসের রাস্তার ধারে এক সরাইখানায়। অ্যাটানাসফ তার গ্র্যাজুয়েট সহকারী ক্লিফোর্ড বেরিকে নিয়ে একটি টিম গঠন করেন এবং প্রথম ইলেক্ট্রনিক কম্পিউটার নির্মাণে হাত দেন। তারা এই কম্পিউটারের নাম দেন ‘অ্যাটানাসফ-বেরি কম্পিউটার’ বা সংক্ষেপে এবিসি। এতে ব্যবহার করা হয়েছিল স্টোরেজ হিসেবে ভ্যাকিউয়াম টিউব এবং অ্যারিথমেটিক-লজিক ফাংশন।

 

অ্যাটানাসফ এবং বেরি ১৯৪০-৪১ সময়কালে জন ডব্লিউ মউসলির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাকে তাদের কাজ দেখান। মউসলি পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ম্যুর স্কুলে কাজ করছিলেন। তখন তিনি তার নিজস্ব চিন্তাধারা স্পষ্ট করা শুরু করেছিলেন, কীভাবে একটি সাধারণ-উদ্দেশ্যে (জেনারেল-পারপাস) ব্যবহারের জন্য কম্পিউটার তৈরি করা যায় [এবিসি যুগপৎ সমীকরণ পদ্ধতি সমাধানের মতো বিশেষ-উদ্দেশ্যে (স্পেশাল-পারপাস) ব্যবহারের জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল]। ১৯৪০ সালের গোড়ার দিকে এনিয়াকের নির্মাণ সংগঠিত করার জন্য মউসলি ম্যুর স্কুলের স্নাতক প্রকৌশলের ছাত্র জে. প্রেসপার একার্ট জুনিয়রকে নিয়ে একটি টিম গঠন করেন।

 

এনিয়াক ছিল পূর্ণাঙ্গ অপারেশন সংবলিত সাধারণ-উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য তৈরি প্রথম ইলেক্ট্রনিক কম্পিউটার। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর আর্থিক সহায়তায় যুদ্ধকালীন প্রকল্প হিসেবে ম্যুর স্কুলে নির্মিত হয়েছিল (সেনাবাহিনী দ্রুত ক্ষেপণাস্ত্রের গতিপথ নির্ণয়ে আগ্রহী ছিল)। এনিয়াকেও ভ্যাকিউয়াম টিউব ব্যবহার করা হয়েছিল। ৩০ টন ওজন বিশিষ্ট এনিয়াক তিনটি শয়ন কক্ষ দখল করে রাখলেও এটি প্রতি সেকেন্ডে ৩০০টি গুণ করতে পারতো। এই যন্ত্র ছিল তখনকার দিনের অন্যান্য যন্ত্রের চেয়ে ৩০০ গুণ দ্রুতগতির। এনিয়াকের জন্য নির্বাহী নির্দেশনা অভ্যন্তরীণভাবে সংরক্ষণ করা যেত না বরং প্লাগবোর্ড এবং সুইচের মাধ্যমে বাহ্যিকভাবে দেওয়া হতো। এনিয়াক ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনী কর্তৃক ব্যবহৃত হওয়ার পর এটিকে স্মিথসনিয়ান ইনস্টিটিউটে সংরক্ষণ করা হয়।

 

গাণিতিক প্রতিভা জন ভন নিউম্যান ১৯৪০ সালের মাঝামাঝি সময়ে এইচ.এইচ.গোল্ডস্টাইন এবং এ. ডব্লিউ বার্কস-এর সহযোগিতায় একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। এই প্রবন্ধে সুপারিশ ছিল যে: ১. কম্পিউটার নির্মাণে বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতি ব্যবহৃত হবে এবং তা ২. কম্পিউটার নির্দেশনা ছাড়াও অভ্যন্তরীণভাবে যন্ত্রে সংরক্ষিত হতে পারবে।
এইসব ধারণা প্রথমে অ্যাটানাসফের এবিসিতে ব্যবহৃত হয়েছিল এবং ভন নিউম্যানের প্রবন্ধে প্রকাশিত হয়। এই ধারণাটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ বাইনারি সংখ্যা পদ্ধতিতে গতানুগতিক দশমিক পদ্ধতির দশ অঙ্কের (০-৯) পরিবর্তে কেবল দুটি অঙ্কের (০ ও ১) সংখ্যা উপস্থান করা হয়। যেহেতু ইলেক্ট্রনিক উপাদানসমূহ সাধারণত দুটি শর্তের একটিতে থাকে (চালু অথবা বন্ধ) সেহেতু বাইনারি ধারণায় সরঞ্জাম তৈরি অত্যন্ত সহজ। দ্বিতীয় ধারণা সংরক্ষিত-প্রোগ্রামের ধারণাকে আমরা নিশ্চিতভাবে গ্রহণ করতে পারি।

 

সেই সময়ে এই ধারণাটি ছিল একটি অসাধারণ সাফল্য কারণ প্রোগ্রামসূহকে সহজে উপাত্তের অনুরূপ সংরক্ষণ আধারে প্রবেশ করানো যেত। প্রতিটি নতুন অ্যাপ্লিকেশ চালানোর পূর্বে অসংখ্য সুইচ ও তার পরিবর্তনের আর কোনো প্রয়োজন হতো না। সংরক্ষিত-প্রোগ্রামের ধারণাটি এখনও বিতর্কিত হলেও এটি কম্পিউটার পরিকল্পনা সংক্রান্ত দর্শনের মৌলিক অংশে পরিণত হয়। এই প্রবন্ধে বর্ণিত অধিকাংশ আধুনিক কম্পিউটারকে ভন নিউম্যানের যন্ত্র বলা যেতে পারে কারণ তারা এতে এই প্রাচীন পরিকল্পনার ধারণাগুলো ব্যবহার করেছেন।

 

যদিও এই ধারণাগুলো এনিয়াকে অন্তর্ভুক্ত হয়নি তথাপি মউসলি, একার্ট এবং ম্যুর স্কুলের অন্যরা সংরক্ষিত-প্রোগ্রামের সক্ষমতা নিয়ে যন্ত্র নির্মাণের কাজ শুরু করেন। এডভ্যাক যন্ত্রটি বেশ কয়েক বছর পর অবধি সমাপ্ত হয়নি। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এডস্যাক-এর নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৪৯ সালে। প্রথম সংরক্ষিত-প্রোগ্রাম সংবলিত ইলেক্ট্রনিক কম্পিউটার হিসেবে এতে এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল।

 

বাজারে প্রতিযোগিতা : এডভ্যাক তৈরিতে বিলম্ব হওয়ার একটি কারণ ছিল একার্ট এবং মউসলি নিজেদের একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে ইউনিভ্যাক (Universal Automatic Computer) তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। ১৯৫১ সালের গোড়ার দিকে উইনিভ্যাক-১ সেন্সাস ব্যুরোতে কর্মক্ষম হয়ে উঠে। ইউনিভ্যাক-১ যখন সেন্সাস ব্যুরোতে আইবিএম পাঞ্চড কার্ড সরঞ্জাম ডিসপ্লেসড করে তখন আইবিএম-এর প্রতিষ্ঠাতার ছেলে থমাস জে. ওয়াটসন জুনিয়র আইবিএমকে কম্পিউটার জগতে দ্রুত রূপান্তরের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। ১৯৫৪ সালে কেন্টাকির লুইসভিলের জেনারেল ইলেকট্রিকস অ্যাপ্লায়েন্স পার্কে অপর ইউনিভ্যাক-১ স্থাপন করা হয়। উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণ এবং রেকর্ড সংরণ করার জন্য এই ব্যবসায়িক সংস্থা কম্পিউটারটি প্রথম অধিগ্রহণ করে। তবে আইবিএম ৬৫০ বোস্টনে সেবা প্রদান শুরু করে ১৯৬৪ সালের শেষভাগে। এটি ছিল সেই সময়ের জন্য তুলনামূলকভাবে সস্তা যন্ত্র এবং এটি ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছিল। এর জন্য ১৯৫৫ সালে আইবিএম কম্পিউটার উৎপাদনে নেতৃত্ব দিয়েছিল।

 

প্রথম প্রজন্মের যন্ত্রগুলো যদিও বৈজ্ঞানিক কাজে ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়েছিল তথাপি ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৯ সময়কালের মধ্যে উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণের উদ্দেশ্যে অনেক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার অধিগ্রহণ করে। সাধারণভাবে কম্পিউটারে অবৈজ্ঞানিক কাজ হিসেবে অ্যাকাউন্টিং টুলের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। নিত্যনৈমিত্তিক কাজ যেমন পেরোল প্রক্রিয়াকরণের জন্য প্রথম ব্যবসায়িক অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা হয়েছিল। যে সময়ে কম্পিউটারের পূর্ণাঙ্গ বৈশিষ্ট্যকে খাটো করে দেখা হলেও অনেক প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার সংগ্রহ করেছিল কারণ তখনকার সময়ে কম্পিউটার ব্যবহারকে একটি সম্মানজনক ব্যাপার বলে মনে করা হতো। তাই জন্যে আগেকার কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের কঠোরভাবে বিচার করা উচিত হবে না। নতুন টুল ব্যবহারে তারাই ছিলেন অগ্রপথিক। সম্পূর্ণ নতুন একশ্রেণীর কর্মচারী দিয়ে তাদের কম্পিউটার স্থাপন করতে হয়েছিল। তাছাড়া এর জন্য প্রোগ্রাম প্রস্তুত করতে হয়েছিল ক্লান্তিকর যান্ত্রিক ভাষার মাধ্যমে। এসব অসুবিধা সত্ত্বেও দ্রুততা, নির্ভুলতা এবং পর্বতসম কাগজের একজন অকান্ত প্রক্রিয়াকারী হিসেবে কম্পিউটারকে পাওয়া গিয়েছিল।

(ম্যাকগ্র হিল, ইনক. কর্তৃক প্রকাশিত ডোনাল্ড এইচ সেন্ডারস-এর ‘কম্পিউটার টুডে উইথ বেসিক’ গ্রন্থ অবলম্বনে।)

 

লেখক: প্রশিক্ষক, বাংলা একাডেমি।

 

আগামীকাল পড়ুন ‘পার্সোনাল কম্পিউটার বা পিসি’ নিয়ে নিবন্ধটির বাকি অংশ



 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ অক্টোবর ২০১৫/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়