ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

আব্দুল গণির একদিন

সৌরভ আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৯, ১৫ মে ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আব্দুল গণির একদিন

আব্দুল গনির একদিন; অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার।

সৌরভ আহমেদ : হ অ অ অ ট পেটিস। হ অ অ অ ট পেটিস। এই পেটিস লন। গরম গরম পেটিস। মচমচা পেটিস। পেটিস লইয়া যান পেটিস এ পর্যন্ত বলে আব্দুল গনি একটু থামে। এটুকু বলাতেই সে আজকাল হাপিয়ে যায়। এপ্রিলের এই প্রচণ্ড দাবদাহে ভয়ংকর বাঘই যেখানে কাবু সেখানে ষাট ছুঁই ছুঁই আব্দুল তো কোনো ছার। বেশ কিছুদিন যাবৎ অব্দুল গনির শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। মাঝখানে আবার বাড়ি থেকে এসেছে। কিন্তু বেড়িয়ে সাধ মেটেনি। কাজেই গৃহকাতরতা, এদিকে অত্যাধিক গরম বেচা-বিক্রিতেও ভাটা। তাছাড়া এসময় তিনগুন ঘাম ঝড়ে এসবের যুগপৎ মিশ্রণে অল্পের মধ্যেই হাপিয়ে যায় আব্দুল গনি।

যৌবনের সেই তীব্র ঝাঁজ আর এখন নেই। পেটিস এখন ছয়/এক (মানে বড় পেটিস ছয় ডজন আর ছোট পেটিস এক ডজন) এর বেশি নিতে পারে না। এই সামান্য পরিমাণ পেটিসে দিন শেষে যা লাভ হয় তাতে সংসার চলে যেত কিছুদিন আগেও। কিন্তু শীতকাল শেষ হওয়ার সাথে সাথে তার বেচা-বিক্রিতে তার ভাষা ঠাডা (ঠাটা) পড়েছে। শীতকালে অনেক সুবিধা পেটিস বিক্রিতে। তখন দশ টাকার পেটিস ফাঁক বুঝে ১২ টাকায়ও চালিয়ে দেয়া যেত। আর এখন? ছয়/এক মালের থেকেও দেড় ডজন ফিরিয়ে আনতে হয়। রাতে মালের হিসেব দেওয়ার সময় প্রায় প্রতিদিনই ছগির মাহাজন বলে গনি ভাই মাল কমাইয়া লইতে পারেন না? ভাই ভাই বেকারীর তো বারোডা বাজাইয়া দেতে আছেন। আইজকের মাল কাইল যখন একজন মানষে খায় তখন কি পোরথোম দিনের মজাডা পায়? এসব কথা আব্দুল গনি এক কান দিয়ে শোনে আর অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়। কারণ সে জানে ৬/১-এর নিচে মাল নিলে তার না খেয়ে থাকতে হবে। অথচ বছর তিনেক আগেও তার সর্বনিম্ন ডাক ছিল ৭/২। ছুটির দুই দিন অর্থাৎ শুক্র আর শনি সে ৭/১ মাল নিত। এটা ছগির মাহাজনের মুখস্থই হয়ে গিয়েছিল। আজকাল বয়সের চাপ তাকে বড় পেয়ে বসেছে। প্রতিদিন অবিক্রিত মাল নিয়ে ফিরতে ফিরতে বিতৃষ্ণা জন্মে গেছে এই পেশাটার প্রতি। অথচ অবস্থা এমন হয়েছে যে এই পেশাটা না করলে না খেয়ে থাকতে হবে। অবিক্রিত মালকে তার কাছে দেনার মতো মনে হয়। কারণ এই মালের হিসেব তার ছগির মাহাজনের কাছে দিতেই হবে। আজ সে এই মুহূর্তে যেখানে বসে পেটিস বলে গলার রগ ফুলাচ্ছে সেটি হচ্ছে বিজয় নগর পানির টাঙ্কি। প্রতিদিন ভোরে ঘুম ভাঙে ‘ভাই ভাই বেকারির’ ম্যানেজার দুলালের ডাকে। ভোরে উঠে নামাজ পড়েই বসতে হয় পিঁয়াজ ছুলতে। বিশ কেজি পিঁয়াজ ছুলে কুচি কুচি করে কেটে দেয়ার বিনিময়ে সে সকালের নাস্তাটা পেয়ে যায়। বিশাল সাইজের  দুটি তরতাজা রুটি আর নিরব হোটেল থেকে আনা সুস্বাদু হালুয়ার আমেজে সকালের নাস্তাটা রাজার হালেই হোত এই কয়েকদিন আগেও।

এখন আর শরীর সব আবেদনে সাড়া দিতে চায় না। কাজ করার সময় এখন প্রায়ই মনে হয় শরীরের ওপর সে জোর জবস্তি করছে। শরীরটাকে সে টেনে বয়ে বেড়াচ্ছে। আজকের ব্যাপারটাকেই বা সে ধরছে না কেন। আজ খুব ভোরে যখন দুলাল তাকে ধাক্কা দিয়েছিল ঘুম ভাঙতে, তখনই সারা শরীরে একটা তিক্ত ভাব ছড়িয়ে পড়ে। সেই তিক্ততার গন্ধ পুরো ভাই ভাই বেকারীতে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিদিনের মতো রসিক কালাম যখন তার সাথে রসের আলাপে ভাব জামানোর চেষ্টা চালাচ্ছিল, তখন সে ঠাট্টাটাকে ঠাট্টা হিসেবে না নিয়ে সিরিয়াস হিসেবে ধরে নেয়। যেমন কালাম যখন আজ ঠাট্টার সুরে ম্যানেজার দুলালের দিকে মুখ করে আব্দুল গনিকে উদ্দেশ্য করে বলল, দুলাল ভাই কারখানার কোনো এক জনের মনে অয় বউ মরছে। চেহারার দিকে দ্যাহেন না চাওয়া যায় না, বলে মিটমিট করে নিচের দিকে চেয়ে হাসছিল আর পিঁয়াজ ছুলছিল তখন আব্দুল গনি কেবল হাতে গোনা কয়েকটা পিঁয়াজ কুচি কুচি করে কাটছে। নতুন একটা ধরবে ধরবে ভাব। মন তখনও তার তিক্তা কাটিয়ে ওঠেনি। ঠিক এই সময় কালামের ইঙ্গিতময় মন্তব্যটি সে ধরে ফেলে। কোনো জমিদারের বাচ্চারে তো চাহোর (চাকর) রাহিনাই, কার বউ মরছে হেইয়া (সেগুলো) খুঁজতে! কথা শুনেই কালাম হতভম্ব। গনি ভাই তো তার সাথে এরকম ব্যবহার করে না।

আকস্মিক আব্দুল গনির এ ব্যবহারে সে থৎমৎ খেয়ে যায়। তবুও মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখে কালাম তার চাচাতুল্য আব্দুল গনি ভাইর সাথে খুব সাবধানে ভাব জমানোর চেষ্টা করে। এরকম সে আজ আরো কয়েকজনের সাথে করেছে। তার ব্যবহার দেখে সবাই যে বিস্মিত হয়েছে, তা জেনেও সে বিরুদ্ধাচরণ করেছে। যে দুলাল তাকে বেশ সমীহ করেই সব সময় কথা বলে, সেই দুলালই আজ তার পেছনে বসে বলছে হ্যাডা ভরা এত রাগ ক্যা এ্যাহ্যাক (এক এক) জনের। এত মাথা ভর্তি রাগ থাকলে হ্যাগো আবার নিজেগো কারখানা লাগে। ইশ আইছে রাগ দেহায়। ওনার রাগের মাহা (মাখা) তামাক খাওনি ছামারপোলা। কইতে তো কিছুই পারো না। সব সোমায় মুহের (মুখের) উফার (ওপর) কইতে অয় ছামার পোলা। এই কথাগুলো দুলাল বলছিল আর সাহস দিচ্ছিল কালামকে। তুইতো ব্যাডা একটা ভোদাই। বালও কইতে পারো না মুহের (মুখের) উফার। এখানেও সিন্ডিকেট আছে। শুধু তাই নয় আছে এলাকা ইজম। দুলালের বাড়ি ছগির মাহাজনের বাড়ির পাশে। কালামেরও। আর সেই কালামকে যখন আট মাইল দূরের কোনো ব্যাক্তি ভৎসনা করে, মুখ বুজে হজম করা তখন কঠিন। দুলালের বাড়তি সুবিধা সে ম্যানেজার পোস্টে আছে। শুধু তাই নয়। সে মিস্তিরিও। সকাল বেলা মাল বানানো থেকে শুরু করে তন্দুর থেকে দুপুরে হকারদের বাক্সে মাল তুলে দেওয়ার আগ পর্যন্ত দুলাল মিস্ত্রি ও ম্যানেজার দুই ভুমিকায়ই কাজ করে। একারণেই সে যখন কারো সাথে কথা বলে কাউকে ছাড় দিয়ে বা বড় ছোট মাথায় রেখে কথা বলে না। কথার সাথে সাথে চোখ মুখ দিয়ে ভুর ভুর করে অহংকার বের হয়। কালাম নরম মনের মানুষ। সে প্রায়ই বলে দুলাল ভাই কানে কানে কথা বলতে পারে না। তাই আজ যখন সকালের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুলাল কালামকে সাহস ও বকা একসাথে দিচ্ছিল তা শুনে সে মরমে মরে যাচ্ছিল। কারণ সে জানে আব্দুল গনি ভাই সব শুনছে । কারখানার এই ভেতরগত দ্বন্দ্ব এখন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। হ অ অ অ ট পেটিস। খাইয়া যান লইয়া যান গরম গরম পেটিস।

 

‘ও চাচা একটা পেটিস দেন তো’ শুনেই অনেকটা চমকে সে বাম দিকে ফেরে। এতক্ষণ সে ডানদিকে পল্টন থেকে আসা পথটির দিকে তাকিয়ে হট পেটিস হট পেটিস করে মরছিল। বিজয় নগর পানির টাঙ্কিটা রাস্তার যে পাশে পড়েছে সে ঠিক তার বিপরীতে পাশের রাস্তার ফুটপাথে অনেকটা পথচারীদের হাঁটার পথ এরিয়ে একটা পেপার বিছিয়ে পিড়িতে বসার মতো করে উপরে বসেছে। কতক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকা যায়। শরীরে আর কুলোয় না। কোনডা দিমু, ছোডডা না বড়ডা কাকা? বয়সে ছোট হলেও সে খুব বিনয়ের সাথে এসব ভাষা প্রয়োগ করে। এসব ভাষা প্রয়োগে কাজ হয়। পেটিসের দাম নিয়ে কেউ ছ্যাচরামি করে না। বিশ পঁচিশ বছর আগে তার গুরু আনাল হক যখন তাকে ভাই ভাই বেকারিতে নিয়ে আসেন, তখনই সে তার শিষ্য আব্দুল গনিকে এসব শিক্ষা দিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন, হোন গনি, কাস্টমাররা অইল লক্ষী, কাজেই ইকটু ভালো ব্যবহার করলেই তোর পেটিস খেতে দূর দুরান্ত থেকে ছুটে আসবে। তোর পেটিস খারাপ অইলেও হ্যারা আইবে। আর বাড়ির দুঃখকে কখনও রাস্তায় নিয়া আবি না। কারণ তোর মন খারাপ দ্যাকলে হ্যরা (তারা বা কাস্টমাররা) মনে মনে কইবে ভাব লোকটা ভাব চোদায়। লাগে যেন জজ ভ্যারিস্টার। হ্যারা কিন্তু তোর পেটিস খাইবে না। মানুষ সব চিয়া (চেয়ে) বেশি দ্যাকতে চায় আসি-খুশি মুখ। গ্যাদা পোলাপানের মতো আসও (হাসিও) মানুষের মইদ্যের (মধ্যকার) সম্পর্কের জটিলতা ভাইঙ্গা দেয়। বড়ডা দেন। ছোডডায় গাল ভরে না। আব্দুল গনি সুন্দর তরতাজা একটা বড় পেটিস বের করে বাক্সের মধ্যে সাইজ করে রাখা কাগজে পড়ে পেটিসটা কাস্টমারের হাতে দেয়। কাকার কি মন খারাপ নি? আর এদিকে তো আমনেরে ডেলি (ডেইলি) দেহি না। হ কাকা শরীলডা ভালো না। আর গরম পড়ায় ব্যাচা বিক্রিও কোম। এই কারণে এই পোতে (পথে) পেরতেক (প্রত্যেক) দিন আইনা। ও এই ব্যাফার? এরপর আব্দুল গনির প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে কাস্টমার বলে, হ গরমের দিন আসলেই কাকা পেটিস বিক্রির সময় না। শরীলে আর কত কুলায় কন চাচা আব্দুল গনি বলে।

হ মানুষের দিন কাল তো আর চিরদিন এক রোহম (রকম) জায় না। বয়স অইছে না। এ্যাহন আফনের রেস্ট দরকার। এর পরই কাস্টমার দাম মিটিয়ে ‘যাই কাকা’ বলে চলে যায়। আব্দুর গনি ছোট নিঃশ্বাস ফেলে। পুরোনো কাস্টমার। বাড়ি বরিশালেই পিরোজপুর না ঝালকাঠি কোথায় যেন বলেছিল। ছয় সাত বছরের পুরোনো কাস্টমার। বিজয় নগর আসলেই এই কাস্টমার তার পেটিস কিনবে এটা অনেকটা নিশ্চিত। আশে পাশেই কোথাও দারোয়ানের চাকরি করে বলেছিল লোকটা। আজ পেটিস বিক্রি হয়েছে সর্বসাকুল্যে দেড় ডজন। অথচ সূর্য ডুবে গেছে মনে হচ্ছে। পকেট থেকে নোকিয়া এগারোশো মডেলের মোবাইলটা বের করে সময় দেখে নিলো। ধারণা ঠিক। পৌনে ছয়টা বাজে। মাগরিবের আজান দিতে এখনও আধা ঘণ্টা বাকি। আব্দুল গনির টেনশন বেড়ে যায়। গত সাত আট দিন যাবৎ সে ধরে নিয়মিত অবিক্রিত পেটিস ফিরিয়ে নিচ্ছে কারখানায়। এটা তার প্রেস্টিজ ইস্যু। সে পেটিস ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এটা শুনে মাদারিপুরের বান্দর পোলাডা, হারুন না কি যেন নাম তাকে টিটকারী মারে। নাক দিয়ে দুধ গলে ,আর সেই ছেলে কিনা আব্দুল গনিকে খোচা দেয়। এটা কোনোভাবেই মানা যায় না। আজ যে করেই হোক পেটিস সে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে না। সে গলার শিরা ফুলিয়ে অধিক জোর দিয়ে পেটিসের বিজ্ঞাপন ছাড়তে শুরু করে। এই পেটিস লইয়া যান পেটিস। গরম গরম পেটিস। তরতাজা পেটিস।

‘মচমচে তাজা মাংস দিয়া ভাজা যে খাইবে হে কইবে পেটিসের রাজা’। তার গলার লাউডস্পিকারে বিরক্ত হয়ে পাশের এক মুদি দোকানি ধমকের সুরে বলল, এই মিয়া আস্তে কতা কইতে পারেন না? আর কোনো সাউন্ড যেন না শুনি। কোথা থেকে যে এইসব ভোদাই আইসা জোটে। গরমের দিনে আসছে পেটিস ব্যাচতে। কথাগুলো শুনে পিন ফুটোনো বেলুনের মত চুপসে যায় আব্দুল গনি। বদের হাড্ডি লোকটা। এ্যাক্কেবারে চারাল (কর্কস ও নিষ্ঠুর) ধাচের লোকটা। কিন্তু কিছু করার নেই তার। এইডা চারালের এলাকা। এই এলাকায় মেজাজ গরম করলে বিপদ হতে পারে। আব্দুল গনি ভয়েস কমিয়ে দেয় গলার। আজানের আগে তার আরো আটটা পেটিস বিক্রি হয়। তিন ডজন মালও আজ এখন পর্যন্ত তার বিক্রি হয়নি। কে জানে রাত আজ বারোটা বাজে কি না। আজানের সময়টায় সে থাকে ব্যাপক আতঙ্কে। কারণ যে কোন সময় তার জীবিকার একমাত্র অবলম্বন পেটিসের বাক্সটা কাঁধে নিয়ে কেটে পড়তে পারে। এরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন সে কয়েকবার হয়েছে।

এটা ঢাকা শহর। ৬৪ রকম চোর ছ্যাচরের সমাবেশ এই আজব শহর। চোরের কাজ চুরি করা। সেটা সে মসজিদ থেকে করল না মন্দির-গির্জা থেকে করল সেটা ভাবার তার সময় কই। আব্দুল গনি মাগরিবের নামাজের জন্য বিজয় নগর ত্যাগ করে পল্টনের দিকে এগিয়ে যায়। পল্টন মোর হয়ে শাওন টাওয়ারের দিকে যেতে একটা বড় মসজিদ বাজে। এই মসজিদে সে অনেক দিন নামাজ পড়েছে। এমনিতে এই মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়ে ঝামেলায়ও কম বাজতে হয়। অনেক মসজিদের খাদেমতো পেটিসের বাক্স নিয়ে মসজিদে ঢুকতেই দেয় না। বলে পেটিসের বাক্সে যে বোমা নাই তার গ্যারান্টি কোথায়। আর পেটিসের বাক্সের নিচে ধুলাবালি ভরা। ভাগো মিয়া। তার পর থেকে আর সে সেই মসজিদেই ঢোকেনি। মানুষরে মানুষে এত অবিশ্বাস করতে পারে? মসজিদ থেকে বের হয়ে মসজিদের গেটেরই অদূরে সে পেটিসের বাক্সের মুখ খুলে বেচার জন্য পেটিসের বিজ্ঞাপন ছাড়তে লাগল। হ অ অ অ ট পেটিস। এই পেটিস ল অ অ ন পেটিস। গরম গরম পেটিস। মসজিদে বিপরীতে ফুটপাথ দাঁড়িয়ে হাক ছাড়ার পাচ মিনিটের মাথায় এক হালি পেটিস বিক্রি হয়ে যাওয়ায় সে খুব ভারমুক্ত অনুভব করে। যাক প্রায় অর্ধেক মাল বেচা কাভার। কিন্তু ঐ চারটি পর্যন্তই। রাত আটটার মধ্যে ঐ চারটি বাদে পেটিস বিক্রি হয়েছে মাত্র দুটি। (মোট ৩২টি পেটিস আজ তার বিক্রি হয়েছে  এপর্যন্ত)মাথা নষ্ট । রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত বেচা বিক্রিতে উন্নতি নেই। তাই তার উদ্বেগ বেড়ে যায়। সে আর এক জায়গায় বসে বিক্রি করা সমীচিন মনে করল না। যে করেই হোক সবগুলো পেটিস আজকে তার বিক্রি করতেই হবে। সে ফেরিওয়ালার মতো এবার ভ্রাম্যমাণভাবে পেটিসের বিজ্ঞাপন দিতে থাকে। গলার ভয়েস বাড়িয়ে অনবড়ত চেচানোয় তার তার শরীর দিয়ে ঘাম নির্গত হয়। শরীরেই সে ঘাম শুকোনোয় তার পুরোনো কাশিটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। কাশতে গিয়ে ঘাম আরো বেশি করে নির্গত হয়। কষ্টে ও যন্ত্রনায় সে মুখ দিয়ে অশ্লীল শব্দ বের করে বিরক্তি প্রকাশ করে। সকালে বাথরুম না পাওয়ায় এই মুহুর্তে  তার বাড়তি সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাথরুমে যাওয়া দরকার তার এই মুহুর্তে। কিন্তু কোথায় টয়লেট। এই আজব শহরে তার মতো এক উচ্ছিষ্টের উচ্ছিষ্ট ফেলার জন্য কেউ টয়লেট তৈরি করে রাখেনি। পাবলিক টয়লেট পল্টনে কোথাও আছে কি না তার জানা নেই। কারণ এই এলাকায় বসে কখনোই তার পেটে চাপ দেয়নি। বিপদ যখন আসে শত দিক থেকে আসে। কপালটাকে আইজ কে ঠাপালো মনে মনে বলে সে। কপালের মায়রে বাপ। আব্দুল গনি এবার আরো পুরোদ্যমে বিজ্ঞাপন ছাড়তে শুরু করল। কিন্তু কাজ হয় না।

পেটিস আর আগের মতো বিক্রি হয় না। শরীরটা এই মুহুর্তে আরো দুর্বল মনে হচ্ছে। তবে কি আজও গত তিন চার দিনের মতো অবিক্রিত পেটিস ফিরিয়ে নিতে হবে? না না তা কখখোনোই হতে দেয়া যাবে না। কিন্তু যতই সে মনে মনে না না বলুক, শেষ পর্যন্ত তার পূর্বের বিশ্বাসের কল বাতাসে নড়ে যায়। যতটা ঘাম সে ঝড়াচ্ছে সে অনুপাতে পেটিস বিক্রি হচ্ছে না। এখন রাত ন’টা। হতাশ মনে সে যখন ভাগ্যের মায়ের চৌদ্দ গোষ্ঠী গালি দিয়ে  উদ্ধার করছিল আর মতিঝিলের দিকে হাঁটছিল, তখন এক ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে ৮টা পেটিস নিয়ে নেয়। দাম না জানায়, সে লোকটির কাছ থেকে পার পিস ১২ টাকা করে রেখেছে। অথচ প্রতি পিস বড় পেটিসের বর্তমান মূল্য ১০ টাকা। লোকটাকে তার ফেরেশতা মনে হয়েছিল। কারণ ঐ সময় থেকে আধাঘণ্টা আগে তার একটা পেটিসও সেল হয়নি। কিন্তু লোকটাকে সে ঠকিয়েছে এটা ভাবতেই সে নিজের ওপর রাগ হয়। পরে আবার সে ভাব কেটেও যায় এই ভেবে যে, তার যে পরিশ্রম তার যথাযথ মূল্য সে কোনোদিনই পায় না। কাজেই ঐ লোকের সাথে কৃত কাজটিকে ঠিক মনে হতে থাকে। আব্দুল গনি এখন মতিঝিল শাপলা চত্তরে। এই জায়গাটায় বিকেল বেলা অনেক পেটিস বিক্রি হয়। কিন্তু দুপুরের ভাত খেয়ে ছয় ডজন মালভর্তি ভারি বাক্সটাকে নিয়ে চানখারপুল থেকে এতদূর তার আসতে ইচ্ছে করে না। আব্দুল গনি শাপলাচত্তরে ফুট পাতের এক সাইডে বাক্স নামিয়ে দম নেয়। প্রচুর কষ্ট হয়েছে পল্টন থেকে এই জায়গাটুকু আসতে। ভ্রাম্যমাণ তরমুজ বিক্রেতা পেলে তরমুজ খেয়ে শরীরটা ঠাণ্ডা করা যেত। কিন্তু রাত ন’টায় কোথাও তরমুজ থাকার কথা নয়। প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেয়েছে তার। পানি খাওয়া দরকার। আশে পাশে কোথাও চায়ের দোকানও নেই। আব্দুল গনি এবার ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকে নাক বরাবর। গুলিস্তানে নিশ্চয়ই চা বিস্কিটের দোকান পাওয়া যাবে। আব্দুল গনি হাঁটতে হাঁটতে গুলিস্তান আসাতেই তার তৃষ্ণা এতই বেড়ে যায়, যে বিশাল এক মার্কেটে সে ঢুকে পড়ে । তার এই মুহুর্তে পানি দরকার। অনেক কষ্টে ঐ মার্কেটে সে পানির সন্ধান পায়। এই দিকটাতে গত ছয় মাসে তার আসা হয়নি। সবকিছু কেমন পাল্টে গেছে । এই মার্কেটেই তার আরো চৌদ্দটি পেটিস বিক্রি হয়। চৌদ্দটা পেটিসের টাকা পকেটে ঢুকানোর সময় তার মনে হয়েছিল মাঝে মাঝে তৃষ্ণা পাওয়ারও দরকার আছে। মার্কেটের চারতলা পর্যন্ত সে উঠেছিল। ঘণ্টাখানিক বিক্রির পর সে দেখে আর বিক্রি হয় না।

রাত তখন দশটা। রাতের খাবারের মূল সময় আসলে নয়টা থেকে দশটা। আরো কিছুক্ষণ থেকে সে যখন বের হচ্ছিল তখন নোকিয়া এগারোশো অথবা বোবা মোবাইল বের করে দেখে রাত সোয়া দশটা। মার্কেটের মূল ফটক থেকে বের হওয়ার সময় দারোয়ান তাকে এই পেটিস বলে ডাকে। দারোয়ানের ভাষায় যথেষ্ট তাচ্ছিল্য ছিল। কিছুদূর আসতেই দাড়োয়ান বলে মামা পেটিস বাকিতে দেন না? আব্দুল গনি সোজা ‘না’ বলে ওখান থেকে গুলিস্তানের দিকে হাঁটা দেয়। কুত্তায় কামড়িয়েছে তাকে যে সে বাকিতে বিক্রি করবে? ভ্রাম্যমাণ নিত্যখাদ্য বস্তুর আবার বাকি কিসের। প্রতিদিনের হিসেব তাকে প্রতিদিনই দিতে হয়। আর কে না জানে,  বাকি মানে ফাঁকি। আর ঢাকা শহরে একথাতো আরো সত্য।

আব্দুল পেটিসের বাক্স নিয়ে রাস্তার একপাশে পেটিস গুনে দেখে কতটি বিক্রি হয়েছে আর কতগুলো রয়ে গেছে। আব্দুল গনি গুনে দেখে বড় পেটিস এখনো দেড় ডজন আর ছোটতা আধা ডজন রয়ে গেছে। দেখেই তার মাথায় দপ করে আগুন লাগার মতো টেনশন ঢুকে পড়ে। আজো কি প্রতিদিনের মতো মৃত ছেলের লাশের মতো ভারী বিক্রি না হওয়া পেটিসগুলোকে নিয়ে ফিরতে হবে? নাঃ  আজকাল আর টার্গেট নিয়ে সে কাজই করতে পারছে না। আব্দুল শেষ চেষ্টা করে আরেক দমক চেষ্টা চালায়। হ অ অ অ ট পেটিস। এই পেটিস লইয়া যান পেটিস। কিন্তু বিকেলের মতো এখন সে আর জোর পায় না। শব্দের বদলে ফিস ফিস করে কিছু আওয়াজ বের হয়। সন্ধ্যার পরে লাগা ক্ষুধাটা আবার জানান দিচ্ছে।

আব্দুল গনি বাক্স থেকে একটা পেটিস বের করে খাওয়া শুরু করে। একটা পেটিস লস দিয়ে যদি  দু’ডজন পেটিস বিক্রি হয় ক্ষতি কি। মোট এখনো ২৩টি পেটিস রয়ে গেছে বাক্সে। আব্দুল গনি যখন গুলিস্তান গোলাপ শাহ’র মাজারে পৌঁছল, তখন রাত সাড়ে দশটার ওপরে। পথে আরো পাঁচটা পেটিস বিক্রি হয়েছে। গোলাপ শাহ’র মাজারে আবার তিনটা ছোট পেটিস বিক্রি হয়ে যায়। গুলিস্তান আরো কিছুক্ষণ ফেরী করে যখন দেখল, অবস্থা বেগতিক তখন সে আজকে আর বিক্রি হবে এ ধরণের আশা ছেড়ে দিয়ে গুলিস্তান ত্যাগ করল। আর একটি পেটিসও বিক্রি হয়নি। রাত এখন এগারটা। আব্দুল গনি হাঁটছে। শব্দহীন মুখ। বুঝে গেছে সে যে আজ আর পেটিস বিক্রি হবে না। ওসমানি উদ্যান, ফুলবাড়িয়া, অমর একুশে হল, শহীদুল্লাহ হল পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে একটা চিন্তিত মুখ। একটি ক্লান্ত দেহ গন্তব্যে ফিরছে। গন্তব্য নিমতলীর বিখ্যাত ভাই ভাই বেকারী। সামনেই নিমতলী ছাতার মসজিদ। পেছনে নির্মাণাধীন গুলিস্তান ফ্লাইওভার যেটি বুয়েটেরর দিকে চলে গেছে। আব্দুল গনির পা আর এগোতে চাচ্ছে না। বাক্সে এখনও পনেরটি পেটিস রয়ে গেছে।

গত রাতেও যখন মালের ডাক নিতে বলা হয়েছে সে বরাবরের মতো বীরের ভঙ্গিতে বলেছে ৬/১। ছগির মাহাজন বার বার তাকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হয়ে নিচ্ছিল, পারবেন তো? দুলাল কইলো, আফনে নাকি পেরতেক দিন মাল ফেরত আনেন? আনি, কিন্তু হ্যাতো (তাতো) পরদিন সকালে যাইয়া বেইচ্যা আই। আফনাগো মালের টাকা হিসাব মোতো পাইলেইতো আইলো কি কন ছগির ভাই। ঠিক আছে, কিন্তু পেরতেক দিন ফিরাইয়া না আইন্যা কমাইয়া লইলেইতো পারেন। না এটা আব্দুল গনির পক্ষে অসম্ভব। তার বউ পোলাপান এখনও তার রুজি ইনকামের দিকে চেয়ে থাকে। কখন টাকা আসবে ঢাকা থেকে? আব্দুল পেটিসের বাক্সটার মুখ উন্মুক্ত করে পেটিস কটার চেহারা দেখে নিল। কি করা যায় পেটিসগুলোকে। ছোট পেটিস তিনটাতে তিন সাতে একুশ আর বড় পেটিস একডজনে বারো দশে একশ বিশ টাকা হয়। টোটাল একশ একচল্লিশ টাকার মাল। কি করা যায়। খেয়ে ফেললে কেমন হয়। ছগির মাহাজন তাচ্ছিল্য, দুলালের ঔদ্ধত্ত আর মাদারিপুরের হারুইন্যার বিদ্রূপমাখা হাসির চেয়ে পেটিসগুলো নিজের পেটে চালান করে দিলে কেমন হয়। সেই চেষ্টা করেও দেখল । কিন্তু দু’টির বেশি পেটিস সে খেতে পারল না। এখন আর সেই যৌবন কালের ভয়ানক সব চ্যালেঞ্জ সে নিতে পারে না। খেয়ে আফসোস করতে লাগল। বোকার মতো একটা কাজ করা হয়েছে। আব্দুল গনি এবার এগোয়। সামনেই বিশ পা দূরে নিমতলী ছাতার মসজিদ। মসজিদের সামনের গলি দিয়ে ভাই ভাই বেকারির গলির মধ্যে ঢুকতে হয়।  যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত সৈনিকের মতো ১৩টি পেটিস অবিক্রিত রেখেই সে ভাই ভাই বেকারীর গলির দিকে এগিয়ে যায়। হয়তো আজ মাহাজন দুলাল আর হারুনের অস্বস্তিকর মুখ গুলো সহ্য করতে হবে। হয়তো মাহাজন বিরক্ত হয়ে বলেই বসবে পেরতেকদিন মাল ফিরাইয়া আনেন ক্যা? তখন সে হয়তো জবাবে কিছু বলবে, আর তার উত্তরে মাহাজন হয়তো বলবে, আরে মেয়া আমনের, গায় নাই বল ভিড়ের মইদ্যে গোনে (থেকে) দেন দৌড়! এডা অয় কোনোদিন ? হয়তো এসব কিছুই হবে না। কারণ পেটিস বিক্রি না হলে ঐ পেটিস আবার তন্দুরে দিয়ে টাটকা করে নিয়ে পরের দিন বেচা যায়। শুধু ঔজ্জ্বল্যটুকু থাকে না। এসব চিন্তা মাথায় করে একটা দুর্বল মনুষ্য মূর্তি চোরের মত নিমতলী ছাতার মসজিদের সামনে থেকে ভাই ভাই বেকারির গলির ভেতরে হারিয়ে যায়।                                       

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ মে, ২০১৪/শান্ত/রাশেদ শাওন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়