ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

কারাগারের জমিতেই হোক ছাত্রাবাস

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪৮, ২৫ আগস্ট ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কারাগারের জমিতেই হোক ছাত্রাবাস

মাছুম বিল্লাহ : বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রয়াত জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী স্যার একবার এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঘোরাফেরা করা এবং হলে থাকাই এক ধরনের শিক্ষা’। কথাটি যথার্থ। হলে না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়-জীবন অপূর্ণ থেকে যায়। হলে থাকা মানে সহমর্মিতা, সহযোগিতা, সামাজিকতা, প্রশাসন ও রাজনীতি এসব শেখা । হলে থাকলে মনে হয়, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্বিত শিক্ষার্থী। দেশ আমাকে এই সুবিধা দিয়েছে, দেশকেও আমার অনেক কিছু দিতে হবে, কারণ আামার দেশের খেটে খাওয়া মানুষের ট্যাক্সের টাকায় আমি এখানে থাকছি, অবশ্যই দেশের প্রতি আমার অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। এই অনুভূতিগুলো অজান্তেই মনের মধ্যে জন্ম নেয়।

 

আর যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকা না যায়, মেসে কষ্ট করে থাকতে হয়, অনেক দূর থেকে বাসে চেপে এসে ক্লাস করতে হয় তাহলে মনের মধ্যে এক ধরনের বিদ্রোহী ভাবনার সৃষ্টি হতে পারে- এই আমার দেশ! একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালোভাবে পড়াশোনা করার জন্য একটি হল, সেই হলে একটি আসন আমার প্রাপ্য। অথচ দেশ আমাকে এতটুকুও দিতে পারল না! আমি দেশকে কী দেব?

 

আমরা জানি যে, ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় আইন (২৮ নং অনুচ্ছেদ) অনুযায়ী জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তরিত করা হয়। কিন্তু এই বিদ্যাপীঠের উল্লেখযোগ্য অবকাঠামো নির্মিত হয়নি। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এখানে নতুন করে কোনো আবাসিক হল নির্মিত হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীদের ভাড়া করা বাড়ি কিংবা মেসে থাকতে হয়। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া দুটো জঙ্গি ঘটনা শিক্ষার্থীদের মেসে ও ভাড়া বাড়িতে থাকা নিয়ে আরও নতুন এক ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করেছে। তাই শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এসেছে তাদের হল নির্মাণের দাবিতে। জগন্নাথ কলেজ থাকার সময় যে আবাসিক হোস্টেল ছিল সেগুলো বেদখল হয়ে গেছে এবং শিক্ষার্থীরা সেখানে অসহায়। তারা হল নির্মাণের জন্য আন্দোলনরত। সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছে কেন্দ্রীয় কারাগারের জায়গায় তাদের জন্য আবাসিক হল নির্মাণ করে দেয়ার জন্য।

 

এলাকাবাসী বিষয়টি ভালভাবে সমর্থন করে না। কারণ হলের শিক্ষার্থীরা চাঁদাবাজি, মাস্তানি, ছিনতাইসহ অনেক ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এটি তাদের অভিজ্ঞতা। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের দিকে অগ্রসর হলে মিছিলে পুলিশ বাধা দেয়, লাঠিচার্জ করে। ফলে সৃষ্টি হয় বিশাল জন-দুর্ভোগের। এটিও সাধারণ মানুষ, পথচারী, গাড়িওয়ালা, এলাকাবাসী ভালভাবে নিচ্ছে না। হলের শিক্ষার্থীরা চাঁদাবাজি করে, এটি চরম এক অপমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য। দু’চারজন হয়তো এর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। তাই বলে ঢালাওভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীদের দিকে এ কারণে অভিযোগের আঙুল তোলার সুযোগ নেই। তাদের এভাবে অপমানিত করা অশোভনীয়।

 

আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অন্যান্য দেশের মতোই শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক হলের ব্যবস্থাসহ গড়ে উঠেছে।  কিন্তু অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ এবং  অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে সকল শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা এখনও করা সম্ভব হয়নি। দেশের সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, এক তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীদের জন্য হলে থাকার ব্যবস্থা আছে। তাও নানা রকম অনিয়মে ভরা। যেহেতু শিক্ষার্থী অনুপাতে হলে আসন সংখ্যা কম, তাই সেখানে রাজনীতি এবং  অনিয়ম সিট পাওয়ার নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও এটি হওয়া উচিত ছিল না। স্বল্পসংখ্যক সিট যদি মেধাক্রম, শিক্ষাবর্ষ ( অর্থাৎ তৃতীয় বর্ষ, চতুর্থ বর্ষ ও মাস্টার্স) এবং বাড়ির দূরত্ব বিবেচনা করে  শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হতো তাহলে এক ধরনের সান্ত্বনা থাকত এবং শিক্ষার্থীরা  সেটা সহজে মেনে নিতো। কিন্তু বাস্তবে হচ্ছে কী? সব সময় প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠন হলের সিটগুলো নিজেদের দখলে রাখে এবং নিজ পার্টিতে নতুন শিক্ষার্থীদের ভেড়ানোর জন্য ‘সিট রাজনীতি’ করে। ফলে প্রকৃত ও মেধাবীরা হলে সিট পায় না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের কাছে অসহায়, কারণ এসব ক্যাডারদের অনেক ওপর থেকে সাপোর্ট দেওয়া হয়। আমরা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এবং দেশের প্রকৃত কল্যাণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি এই হীন কাজটি করতে না দিতাম তাহলে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনুকরণীয় হয়ে থাকতো। অনেক বিদেশী শিক্ষার্থীও এখানে পড়তে আসতো। কিন্তু সামান্য স্বার্থ আর দলবাজির জন্য এই বিষয়টি আমরা হারিয়েছি। এখন উল্টো আমাদের দেশের অনেক মেধাবী বিদেশ চলে যায়। অনেকে আর ফিরেই আসে না।

 

আমরা অযথা অনেক রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যয় করি, অনেক অপচয় করি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যারা এক সময় রাষ্ট্র পরিচালনার মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করবে তাদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভাল কোনো ব্যবস্থা করতে পারিনি। এটি আমাদের জন্য লজ্জাজনক। জাতির অনেক সমস্যা, অনেক বিশৃঙ্খলা এমনিতেই মিটে যেত যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আমরা ঠিক তাদের মতো করে থাকতে দিতাম। আমরা দলমত নির্বিশেষে যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সঠিক মানুষ তৈরির কারখানা হিসেবে তৈরি করতে পারতাম এবং হীন ও সংকীর্ণ স্বার্থে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার না করতাম তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ঠিকই দেশপ্রেমিক তৈরি করত, অনেক বড় বড় বিজ্ঞানী তৈরি করত, বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষক তৈরি করত। এখন সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীরা বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। তাদের মেধা, মনন, সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে উন্নত দেশগুলো ফায়দা লুটছে। আমরা এসব দেখেও যেন না দেখার ভান করছি।

 

আমাদের বিশ্ববিদ্যায়গুলোর দিকে তাকালে দুঃখ পাওয়া ছাড়া কিছু করার নেই। যেসব শিক্ষক ও ছাত্র সরাসরি রাজনীতি নামক খেলার সাথে যুক্ত তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে সবকিছু। আর যারা গবেষণা ও পড়াশোনা নিয়ে আছেন তারা অসহায়। এই অবস্থার পরিবর্তন কবে হবে? কীভাবে হবে জানি না।

 

আমি দেখেছি, ক্যাডেট কলেজে প্রতিটি শিক্ষার্থীর জন্য আলাদা খাট, আলমারি, টেবিল আছে। তারা পড়াশোনায় সেভাবে নিজেদের আত্মনিয়োগ করতে পারে। ভবিষ্যতে এসব শিক্ষার্থীরা শুধু দেশে নয়, বিদেশেও মেধার স্বাক্ষর রাখছে এবং দেশে পাঠাচ্ছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও পড়ার জন্য, গবেষণা করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এটি অপচয় নয়, বিনিয়োগ। কিন্তু আমরা কেন যেন এখানে বিনিয়োগ করতে সব সময়ই অনীহা প্রকাশ করি।

 

২ আগস্ট থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরিত্যক্ত কারাগারের জমিতে হল নির্মাণের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছে। তারা জমিটি পেতে ২০১৪ সালের মার্চ মাসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে আবেদন করেছিল। এবারের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে জায়গাটির জন্য গত ১৪ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আবেদন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপাচার্য মীজানুর রহমান। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এগারো বছরেও নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকার সুযোগ পেল না। কর্তৃপক্ষ বার বার তাদের শুধু আশ্বাসই দিচ্ছেন কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে। ভর্তিযুদ্ধে লড়াই করে স্বপ্নের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে থাকতে হচ্ছে মেস ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে- এটি হতে পারে না। তাদের দাবি যৌক্তিক এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষ যাতে দ্রুত তাদের দাবি মেনে নেন এবং হল নির্মাণ করার ঘোষণা দেন সেটিই এখন সবাই দেখতে চাইছে। হল নির্মাণ শুরু একটি জটিল প্রক্রিয়া। তারপরেও শুরু হোক। যেসব শিক্ষার্থীরা আজ রাজপথে আন্দোলন করছে তারা হয়তো হলে থাকতে পারবে না। কারণ হল নির্মাণ করতে যে সময় লেগে যাবে সেই সময়ের মধ্যে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা হয়তো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পার করে কর্মজীবনে পা রাখবে। তবে ভবিষ্যত শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের এই আন্দোলন। উচ্চশিক্ষার সঠিক পরিবেশ সৃষ্টির এই আন্দোলন। এই আন্দোলন সমর্থন করি। তবে শিক্ষার্থীরা আবেগপ্রবণ হয়ে যাতে কোনো ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজ না করে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। 

 

লেখক : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ আগস্ট ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ