ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

কূটনীতির সাফল্য ও শত বছরের মধ্যপ্রাচ্য সংকট

মো. আলাউদ্দীন ভুঁইয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৪৯, ২১ মে ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কূটনীতির সাফল্য ও শত বছরের মধ্যপ্রাচ্য সংকট

মো. আলাউদ্দীন ভুঁইয়া

মো. আলাউদ্দীন ভুঁইয়া : এটুকু বললে হয়তো বেশি বলা হবে না যে, এক মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি বাকি পৃথিবীর রাজনীতির চেয়েও বেশি জটিল। দাবা খেলায় উভয় পক্ষই যেমন মধ্যমাঠের নিয়ন্ত্রণে ব্যতিব্যস্ত থাকে, আধুনিক সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে ঠিক তেমনিভাবে পৃথিবীর শক্তিধর দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যকে করতলে নেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। আজকের মধ্যপ্রাচ্য সংকটের সূর্যোদয় হয়েছিলো ঠিক ১০০ বছর আগে ১৯১৬ সালের ১৬ মে যেদিন ‘সাইকস-পিকট চুক্তি’ (Sykes- Picot Agreement) কার্যকর হয়েছিল।

 

পৃথিবীতে তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। শক্তিধর দেশগুলো দুই শিবিরে বিভক্ত : মিত্রশক্তি (Allies) ও অক্ষশক্তি বা কেন্দ্রশক্তি (Central Powers)। কেন্দ্রশক্তিতে ছিল অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, জার্মানি, বুলগেরিয়া ও অটোম্যান সাম্রাজ্য (মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ অঞ্চল যার অন্তর্ভূক্ত ছিল)। অন্যদিকে মিত্রদের মধ্যে ছিল যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, সার্বিয়া, ফ্রান্স, ইটালি, বেলজিয়াম ও যুক্তরাষ্ট্র।

 

১৯১৫ সালের শেষের দিকে ঘটনা। তখনো বিশ্বযুদ্ধের জয়-পরাজয়ের কোনো রূপরেখা ফুটে ওঠেনি। এরই মধ্যে যুদ্ধোত্তর মধ্যপ্রাচ্য ভাগাভাগিতে নেমে পড়ে সে সময়ে মিত্রশক্তির দুই প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। পরে রাশিয়া এই ভাগ-বাটোয়াতে অংশগ্রহণ করে।

 

মধ্যপ্রাচ্যকে ভাগাভাগির মূল দায়িত্ব এসে পড়ে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের দুই কূটনীতিকের ওপর। এদের একজন মার্ক সাইকস (Mark Sykes), আর অন্যজন জর্জ পিকট (Georges-Picot)। এদের মধ্যে কর্নেল সাইকস ভাড়াটে ব্রিটিশ কূটনীতিক আর পিকট ছিলেন ‘অপরিণত’ পেশাদার ফরাসি কূটনীতিক।

 

সামরিক-বেসামরিক যৌথ মস্তিষ্কে মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে জঘন্যতম যে গোপন দলিল লেখা হয়েছিল, তা ‘সাইকস-পিকট চুক্তি’ (অফিশিয়ালি ‘এশিয়া মাইনর চুক্তি’) বা মধ্যপ্রাচ্য ভাগাভাগির গোপন চুক্তি নামে পরিচিত। রাশিয়ার বলশেভিক আন্দোলনের (১৯১৭) নেতারা এ চুক্তি গ্রহণ করেননি বলে তারা চুক্তির বিষয়টি প্রকাশ করে দেন।

 

<

সূত্র : দ্য ইকোনোমিস্ট

 

সাইকস ও পিকট মিলে ভূ-মধ্যসাগরের উপকূল থেকে শুরু করে ইসরায়েলকে দুই ভাগ করে সিরিয়া-জর্ডানের সীমারেখা ধরে সোজাসুজি ইরাকের মসুল নগরীর নিচ ও কিরকুকের ওপর দিয়ে ইরানের সীমান্ত পর্যন্ত মোটামুটি একটি সরল রেখা টেনে মধ্যপ্রাচ্যকে দুই ভাগে বিভক্ত করেন। ওপরের অংশে অবস্থিত তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাংশ, সিরিয়া, ইরাকের মসুল। লেবানন চলে যায় পিকটের (ফ্রান্সের) পকেটে আর নিচের ইসরায়েলের দক্ষিণাংশ, জর্ডান, ইরাক, কুয়েত ও সৌদি আরবের পারস্য উপকূলীয় অংশ নেন সাইকস (যুক্তরাজ্য)।

 

এ ভাগাভাগিতে রাশিয়ারও একটা অংশ ছিল। সে তুরস্কের পশ্চিমাংশ ও ইস্তাম্বুল নিয়ে নেয়। চুক্তির বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে আরেক মিত্রশক্তি ইতালি শেষমেষ (১৯১৭ সালে) তুরস্কের দক্ষিণে ভূ-মধ্যসাগরের উপকূলীয় ভূ-খণ্ডটুকু নিয়ে নেয়। এভাবে সাইকস-পিকটের এক চুক্তিতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে তুরস্ক থেকে মধ্যপ্রাচ্য (উত্তর আফ্রিকা ও সৌদি আরবের অধিকাংশ ভূ-খণ্ড বাদে) চার মিত্রশক্তির করতলে চলে আসে। এর পরের ১০০ বছর শুধুই রক্তপাতের ইতিহাস।

 

আরব বিদ্রোহ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে রক্তপাতের শুরু হয়। ১৯১৬ সালের জুন মাসে মক্কার আমির শরিফ হুসেইনের (হুসেইন বিন আলী) নেতৃত্বে আরব বিদ্রোহ শুরু হয়। এ বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ছিল অটোমন সাম্রাজ্যের (তুরস্কের) হাত থেকে সমগ্র আরব ভূ-খণ্ডের স্বাধীনতা লাভ। অর্থাৎ আরবরা জুন মাসেই ভূ-খণ্ডের জন্য লড়াইয়ে নেমেছিল, যা মে মাসেই গোপনে তিন পক্ষের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়।

 

শরিফ হুসেইন অখণ্ড আরবের স্বাধীনতায় ব্রিটিশদের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। এ নিয়ে মিশরে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার হেনরি ম্যাকমোহনের সঙ্গে তার কয়েক দফা পত্র যোগাযোগও হয়। এটি ‘হুসেইন-ম্যাকমোহন পত্রযোগাযোগ’ (Hussein–McMahon Correspondence) নামে পরিচিত। ম্যাকমোহন তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আরবদের পূর্ণ সহযোগিতার শর্তে হুসেইনকে অখণ্ড আরব ভূ-খণ্ডের স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

 

ব্রিটিশ-ফরাসিরা কথা রাখেনি। বরং তাদের দ্বৈতনীতি এমন ছিল যে, তারা একদিকে আরব ভূ-খণ্ডের স্বাধীনতা আন্দোলনে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আরবদেরকে তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে টেনে আনে, অন্যদিকে আরব ভূ-খণ্ডকে নিজেদের মতো ভাগবাটোয়ারা করে উপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করতে থাকে। সে সময়ে ব্রিটিশ-ফ্রান্স-আরব কর্তৃক হেজাজ রেলপথ ধ্বংস, আকাবা বন্দর দখল ও তৎপরবর্তীকালে ব্রিটিশ-ফ্রান্সের কূটনৈতিক ছলাকলার পটভূমিতে ডেভিড লিনের পরিচালনায় নির্মিত ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’ (Lawrence of Arabia, 1962) ছবিটি সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।

 

কেবল দ্বৈতনীতিতে থেমে থাকেনি ব্রিটিশরা। মধ্যপ্রাচ্যে রাজনীতিতে তারা তৃতীয় যে নীতি যোগ করে তা ‘বেলফোর ঘোষণা’ (Balfour Declaration, 1917) নামে পরিচিত। বেলফোর ঘোষণা হলো- ফিলিস্তিনে ইহুদিদের স্থায়ী আবাসভূমির অঙ্গীকার করে ব্রিটেনের প্রতাপশালী ইহুদি নেতা ওয়াল্টার রথসচাইল্ডকে লেখা ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব আর্থার জেমস বেলফোরের এক চিঠি। চিঠিতে বেলফোর লিখেছিলেন- His Majesty’s Government view with favor the establishment in Palestine of a national home for the Jewish people…। এরই সূত্র ধরে ১৯৪৮ সালে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল রাষ্ট্র গড়ে ওঠে।

 

মধ্যপ্রাচ্যে আরবীয়রা যেমন ব্রিটেন বা ফ্রান্সের শাসন মেনে নেয়নি, তেমনি তারা ইসরায়েল রাষ্ট্রকেও কখনো মেনে নিতে পারেনি। ধীরে ধীরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ব্রিটিশ-ফরাসিরা উপনিবেশিক শাসন শেষ করতে বাধ্য হলেও তারা সেখানে দুটি বিষবৃক্ষ রেখে গেছে। এক. আরব জাতিগত, গোত্রগত বিভক্তি। দুই. অযাচিত একটি ইসরায়েল রাষ্ট্র।

 

আজকের মধ্যপ্রাচ্য সংকটের তিনটি মূল কারণের মধ্যে জাতিগত ও গোত্রগত কারণ দুটি ব্রিটিশদের সৃষ্টি। অসংখ্য বিভক্তি সৃষ্টি করা হয় জাতিতে জাতিতে, গোত্রে গোত্রে মারামারি-হানাহানি করার জন্য।

 

সাইকস-পিকট চুক্তির মূল দুর্বলতাই ছিল এ অঞ্চলে ক্রমবর্ধিষ্ণু আরব জাতীয়তাবাদকে অগ্রাহ্য করা। পৃথিবীর প্রতিটি স্বাধীনতা আন্দোলনের পেছনে একটি দীর্ঘ বঞ্চনার ইতিহাস আছে। তুর্কিরা আরব জাতিসত্তাকে অগ্রাহ্য করে অটোমন সাম্রাজ্যের যে সর্বনাশ ডেকে এনেছিল, সেই একই ভুলে ব্রিটিশ-ফরাসিরাও আরব ভূ-খণ্ডে শতবছর জিইয়ে থাকা সংকটের সৃষ্টি করেছিল।

 

সে জন্য বলা হয়, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো- ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। তা না হলে র‌্যাডক্লিফ সাহেব এতটা অবিবেচকের মতো ভারত-পাকিস্তান ভাগাভাগি করতেন না; পাকিস্তানও বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদকে কোনো দিনও পদদলিত করতো না। দমননীতিতে কোনো রাষ্ট্রই কখনোই তার ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে পারেনি। রোমান সম্রাট ক্যালিগুলা, কম্বোডিয়ার পলপট, জার্মানির হিটলার, রাশিয়ার স্ট্যালিন, উগান্ডার ইদি আমিন, রোমানিয়ার চসেস্কু, চীনের মাও সেতুং, লিবিয়ার গাদ্দাফি … ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনি।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ মে ২০১৬/রাসেল পারভেজ/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়