ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

তনু-শ্যামল কান্তিরা যেন ‘সর্বনাশের কোকিল’ না হয়

মো. আলাউদ্দীন ভুঁইয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:১৯, ২৪ মে ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তনু-শ্যামল কান্তিরা যেন ‘সর্বনাশের কোকিল’ না হয়

লেখক : মো. আলাউদ্দীন ভুঁইয়া

মো. আলাউদ্দীন ভুঁইয়া : পাঁচ বছর আগের ঘটনা। তিউনিসিয়ার বোয়াজিজির কথা হয়তো আমরা এখনো ভুলে যাইনি। বোয়াজিজি কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা বা কর্মী ছিলেন না। রাষ্ট্র, সরকার, রাজনীতি, স্বৈরতন্ত্র, গণতন্ত্র … এসব কেতাবি ঝুটঝামেলায় তিনি কখনো জড়িত ছিলন না। কয়েকবার সৈনিক পদে পরীক্ষা দিয়ে তিনি চাকরি পাননি। জীবনের তাগিদে পথে পথে ঘুরে সবজি বিক্রি করতেন। তাও আবার রাজধানীতে নয়, বোয়াজিজি সবজি বিক্রি করতেন রাজধানী থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে সিদি বৌজিদ নামক স্থানে।

 

ঘটনাটিও খুব সামান্য। এমনটা আমাদের দেশে ঘটলে আমরাও হয়তো খুব বেশি আশ্চর্য হতাম না। কর্তৃপক্ষের অনুমতি না থাকলে পুলিশকে ঘুষ দিয়ে রাস্তায় বিক্রি-বাট্টা করা তিউনিসিয়ায় অনেকটা নিয়মের মতো। বোয়াজিজির রাস্তায় সবজি বিক্রির অনুমতি ছিল না, ঘুষ দেওয়ার মতো টাকাও না। ‘হয় অনুমতি, নয় ঘুষ’ টাইপের বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি, পরে পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে  পড়েন তিনি। পুলিশ শেষমেষ তার জিনিসপত্র নিয়ে চলে যায়।

 

আমরাও তো হরহামেশা কত হকারকে পুলিশের লাথিগুঁতা খেয়ে ভ্রাম্যমাণ দোকান নিয়ে অথবা বন্ধ করে দৌড়াতে দেখেছি। বোয়াজিজি গভর্নরের কার্যালয়ে গিয়ে তার জিনিসপত্র ফেরত চান। কিন্তু সেখানে কোনো লাভ না হলে রাগে-দুঃখে তিনি পেট্রল কিনে ওই কার্যালয়ের সামনে (১৭ ডিসেম্বর ২০১০) গায়ে আগুন লাগিয়ে দেন। রাজন, রাকিব, তনু বা শ্যামলকান্তিদের ঘটনার সঙ্গে তুলনা করলে বোয়াজিজির ঘটনাটি জঘন্যতার মাপকাঠিতে খুব বেশি কিছু মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই।

 

ব্যাস, এতটুকুই। গায়ে আগুন লাগিয়ে হাসপাতালে পড়ে থাকা ছাড়া বোয়াজিজিকে আর কিছু করতে হয়নি। স্থানীয় জনগণ এ ঘটনায় রাস্তায় নেমে আসে। আন্দোলন মফস্বল থেকে মফস্বলে ঘুরতে ঘুরতে রাজধানীতে পৌঁছায়। এর মধ্যে বোয়াজিজির ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বিচারের দাবি কখন যে সরকার পতনের দাবিতে বদলে যায়, তা কেউ বলতে পারে না। মাত্র এক সপ্তাহে রাস্তায় ঘটা সেই ঘটনা এক গণবিক্ষোভে রূপ নেয়, নাম ‘জেসমিন বিপ্লব’।

 

তিউনিসিয়ার সরকার কোনো ঠুনকো সরকার ছিল না। একটানা ২২ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিলেন প্রেসিডেন্ট বেন আলী। সর্বশেষ ২০০৯ সালেও বেন আলী ৯০ শতাংশ ভোটে পুনর্নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসেন। তার শাসনামলে তিউনিসিয়ার জিডিপি ৩ গুণ বৃদ্ধি পায়, প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ শতাশের ওপরে। দারিদ্র্যের হার ৭ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে কমে ৩ দশমিক ৮ শতাংশে (২০০৫) নেমে আসে।

 

২০১০ সালে বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপের এক প্রতিবেদনে (The African Challengers : Global Competitors Emerge from the Overlooked Continent) তিউনিসিয়াকে আফ্রিকার অন্যতম অর্থনৈতিক ‘সিংহ’ হিসেবে খ্যাতি দেয়। সে বছরের দাভোস ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্লোবাল কমপিটিটিভনেস প্রতিবেদনে আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে তিউনিসিয়ার অবস্থান ছিল প্রথম। দেশটির অর্থনৈতিক দুর্বলতার মধ্যে প্রধানতম ছিল তরুণদের বেকারত্ব (১৩ দশমিক ২৯ শতাংশ, ২০০৯)। তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশ হিসেবে এ হার যে খুবই আশঙ্কাজনক, তা নয়। দেশটিতে তখন অন্য কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতাও ছিল না। এক কথায়, ২০১০ সালে তিউনিসিয়া মোটামুটিভাবে একটি শান্ত দেশ ছিল।

 

বোয়াজিজির আত্মহননের চেষ্টা ও অবশেষে ২০১১ সালের ৪ জানুয়ারি তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সামাজিক বিক্ষোভ কাঁপিয়ে দিয়েছিল আরব বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রকে। একে একে এ বিক্ষোভ গণতন্ত্র কায়েমের বিপ্লবের রূপে মিশর, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন, ইরাক, আলজেরিয়া, সুদান, জর্ডান, সৌদি আরবেও ছড়িয়ে পড়ে। এই বিপ্লবের নাম ‘আরব বসন্ত’।

 

বোয়াজিজির ঘটনার পরে মাত্র ২৭ দিনের আন্দোলনে বেন আলী সরকারের পতন ঘটে। এত দ্রুত পতনের অন্যতম কারণ ছিল বেন আলী সরকারের অতি আত্মবিশ্বাস ও সেই অলিক আত্মবিশ্বাসের জোরে বিক্ষোভের ওপর দমননীতির প্রয়োগ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো- ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার ইত্যাদিতে জোরালো প্রচার।

 

শুধু জেসমিন বিপ্লব নয়, পুরো আরব বসন্ত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পিছনেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল। নতুন সরকারের আমলে গত পাঁচ বছরে তিউনিসিয়া বড় ধরনের কোনো অগ্রগতি তো পায়ইনি, বরং দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা এখন অনেক বেশি নাজুক। সরকারের পরিবর্তন হয়েছে, মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি; ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশ, দেশের সেইসব আপমর জনসাধারণ, যারা-ই একদিন পরিবর্তনের নেশায় রাজপথ সরগরম করে তুলেছিল।

 

রাজন, রাকিবের মৃত্যু, তনুর মতো নারীদের ধর্ষণ, হত্যার উদাহরণ বাংলাদেশে কম নেই। গুলিতে গর্ভের শিশুর মৃত্যু, সরকারি কর্মকর্তাকে হাসপাতালে প্রেরণ, সাগর-রুনির রহস্যজনক মৃত্যু, শিক্ষককে হেনস্তা- এমন অনেক ঘটনারই তদন্ত হয়েছে, বিচার হয়েছে বা চলছে। তবুও এসবের পুনরাবৃত্তি বন্ধ নেই। শ্যামলকান্তির মতো শিক্ষকদের অপমানিত হওয়ার আরো ঘটনা উল্লেখ করাটা দুঃসাধ্য নয়। তনুর পুনরায় ময়নাতদন্ত হয়েছে। শ্যামলকান্তিকে চাকরিতে পুনর্বহাল ও স্কুল কমিটিকে বাতিল করা হয়েছে। তবে এসব ঘটনা ও সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের  মধ্যে যে সময়টুকু থাকে সে সময়ে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে যে ঘূর্ণিঝড়ের আর্বিভাব ঘটে, সেটাকে সময়মতো গুরুত্ব না দেওয়া সুবিবেচ্য নাও হতে পারে। আমাদের তো আবার আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি নেই।

 

শ্যামলকান্তির ঘটনায় লক্ষ্যণীয় হলো- ইসলামকে টেনে এনে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা। আমরা কি নিশ্চিত, যারা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির বিরুদ্ধে আন্দোলন জমাতে পারেনি, তারা এ ধরনের কোনো ইস্যুর ছায়াতলে সমবেত হচ্ছে না? যুদ্ধাপরাধদের নগ্ন চেহারার চেয়ে ধর্মের মুখোশ অনেক বেশি শক্তিশালী।

 

যদি শ্যামলকান্তির ধর্মবিরোধী কোনো বক্তব্য প্রমাণিত হয়, তবে প্রচলিত আইনে তার বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু কানধরা অনুষ্ঠানকে জায়েজ করার জন্য ইসলামের বিরুদ্ধে কথিত বক্তব্যকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করাকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। আজ যদি কানধরা জায়েজ হয়, কাল তবে ধর্মের কটূক্তিকারীর হত্যাকেও স্বীকৃতি দিতে হবে। আমরা ধর্ম নিয়ে কটূক্তি যেমন চাই না, ঠিক তেমনিভাবে অযাচিত কোনো কটূক্তিকারীর ঘাড়ে চাপাতি থেরাপিও চাই না।

 

বোয়াজিজি ছিল আরব বসন্তের কোকিল। তনু, শ্যামলকান্তিরা যেন কোনো সর্বনাশের কোকিল না হয়।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ মে ২০১৬/রাসেল পারভেজ/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়