ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

পদ্ম পাতার জল : প্রশংসার দাবিদার মিম

নাবীল অনুসূর্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৩, ২ আগস্ট ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পদ্ম পাতার জল : প্রশংসার দাবিদার মিম

পদ্মপাতার জল সিনেমার দৃশ্যে মিম

নাবীল অনুসূর্য : প্রচার প্রচুর। মিডিয়াতে আলোচনাও অনেক। কিন্তু ঈদ বাজারের ভাগাভাগিতে পদ্ম পাতার জল-এর ভাগ্যে সিনেমা হল জুটেছে নিতান্তই কম। তাই অনেক জায়গাতেই হলের বাইরেও বাণিজ্যিক প্রদর্শনী করা হচ্ছে। তা বৈধ কিনা সেটি আলাদা প্রশ্ন, তবে উদ্যোগটা মন্দ নয়। সব মিলিয়ে তন্ময় তানসেনের প্রথম পরিচালনার সিনেমাটা অগ্নি টু আর লাভ ম্যারেজ-এর সঙ্গে খুব বেশি পাল্লা দিতে পারেনি হয়তো। তবে সিনেমাটি যে একেবারেই দর্শক পায়নি, তাও ঠিক নয়।

সিনেমাটির কাহিনি কেমন জমেছে, কতটা ভালোভাবে সে গল্প বলা গেছে, সে সব প্রশ্নের আগে খানিকটা ধন্যবাদ প্রাপ্য প্রচলিত ধারার বাইরের একটি কাহিনি বেছে নেয়ার জন্য। গল্পটি তো নতুনই বটে, গল্পটির ধরনও প্রচলিত ধারার নয়। বহুদিন পর অ্যাকশন ছাড়া একটি স্রেফ ড্রামা-নির্ভর প্রেমকাহিনির সিনেমা বাংলাদেশের মূল ধারায় মুক্তি পেল।

সিনেমার গল্প ব্রিটিশ আমলের প্রেক্ষাপটে। এক জমিদারপুত্র কবি রিজওয়ান আর এক বাঈজী ফুলেশ্বরীর প্রেমকাহিনি। কাব্যপ্রেমী জমিদারপুত্র রিজওয়ান কলেজে পড়তে আসে। সেখানে দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধুর উৎসাহে দেখতে যায় বাঈজী নাচ। গিয়েই বাঈজী শিরোমনি ফুলেশ্বরীর সঙ্গে চোখাচোখি। পরে গান-কবিতার বিনিময়ে মাধ্যমে তাদের ভালো লাগা পরিণয়ে রুপ নেয়। সিনেমাটিতে সচরাচর অন্যান্য সিনেমাগুলোর মতো অনেকগুলো ঘরনার মিশ্রণ ছিল না। স্রেফ রোম্যান্স-ড্রামা। কাজেই কাহিনিতে নায়ক-নায়িকার প্রেম হওয়ার জন্য বেশ সময় পাওয়া গেছে। অসুস্থ কবির দীর্ঘদিন বাঈজী মহলে থেকে বাঈজীর সঙ্গে প্রেমটা পোক্ত করা, সে পোক্ত করার পথে কলেজ জীবন উচ্ছন্নে দেয়া, ছোঁয়াছুয়ির লুকোচুরি খেলা, ফুলেশ্বরীর আকাশ নামের পাখি-বন্ধুর রূপকে তার মুক্তির আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করা। এগুলো তাদের প্রেমকে প্রতিষ্ঠা করতে বেশ কাজ করেছে। পাশাপাশি মহলে ফুলেশ্বরীর প্রতি ঈর্ষান্বিত বেশ কয়েকজন বাঈজীও ছিল, যদিও তারা তেমন সক্রিয় হয়ে ওঠেনি। সব মিলিয়ে নায়ক-নায়িকার প্রেম হওয়ার জন্য বেশ খানিকটা সময় নেয়া হয়েছে, যা জরুরি। এবং যার অভাব প্রায়ই সিনেমাগুলোতে থাকে। তবে সে সময়ের পরিমাণটা আরেকটু পরিমিত হওয়া উচিত ছিল।

কাহিনি শেষ দিকে বেশ দ্রুতগতির। তাতে বেশ কিছু বাঁকবদলও আছে, যার কয়েকটি অনুমানদুরূহও বটে। তবে একই সঙ্গে সেগুলো বিশ্বাস করাও দুরূহ ব্যাপার। বিশেষ করে সরফরাজের গল্প শুনে রিজওয়ানের ফুলেশ্বরীকে বিক্রি করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়াটা অতিমাত্রায় মেলোড্রামাটিক তথা অতিমাত্রায় অতিনাটকীয়তা দোষে দুষ্ট। বিষয়টা অনেকটা বিশ মাইল নদীর উনিশ মাইল সাঁতরে, দম ফুরিয়ে গেছে বলে ফিরে আসার মতো যুক্তি। এমনকি সরফরাজের প্ররোচনায় জীবনে প্রথম বারের মতো মদ খাওয়াটাও সেটাকে জাস্টিফাই করতে পারে না। তবে এই অতিমাত্রায় অতিনাটকীয়তা দোষের মাধ্যমে বাংলার আবেগি মানুষদের, বিশেষ করে তাদের প্রয়োজনীয় আবেগের তুলনায় অপ্রয়োজনীয় আবেগের প্রাবল্যের প্রতি উপহাস করার ভাবনাটা মোটেই স্থূল নয়। ইমোশনাল ফুলস শব্দবন্ধটাও সে কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি চাইলে ব্রিটিশ অপেরা-গায়িকা ইসাবেলা কর্তৃক বাঙালি বাবু সরফরাজকে প্রতারিত করার গল্পটাকে নানাভাবে প্রতীকি ব্যঞ্জনাতেও ভাস্বর করা যেতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত ওই উনিশ মাইল সাঁতরে দম ফুরিয়ে গেছে বলে শেষ মাইল বাকি রেখে ফিরে আসার ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না। অবশ্য বিক্রি করে দেয়ার পরের দৃশ্যটিতে যে টুইস্টটি আছে, সেটি বেশ ভালো।

কাহিনির শুরুতে রিজওয়ানের দুই বন্ধুর চরিত্র বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মধ্যে আবার হিন্দু-মুসলমানের মৈত্রী দেখানো হয়েছে। তারা প্রথমে বন্ধুকে উচ্ছন্নে নিয়ে যায়। পরে আবার তারাই বন্ধুর প্রেমকাহিনির সফল পরিসমাপ্তির বন্দোবস্ত করে। এমনকি খলনায়ক রণবীর সিংকে ভুল পথে চালানোর কুটদায়িত্বও তাদের কাঁধেই বর্তায়। তবে ভুল পথে চালিত রণবীর সিং কাপুর কীভাবে সেদিনের মধ্যেই সরফরাজের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে, সে এক রহস্য। এখানে সময়ের ঐক্য মেলানো একটু মুশকিলই বটে। সে ঐক্য কোনোভাবে মেলানো গেলেও, বৃষ্টির রাতে নৌকার অভাবে আটকা পড়লেও, পরদিন সকালে বৃষ্টি থেমে গেলেও কেন রিজওয়ান ফুলেশ্বরীকে নিয়ে নদী পার হয়ে পৈতৃক বাড়ির পথে রওয়ানা দেয় না, তার উত্তর মেলা ভার।

সব মিলিয়ে সিনেমাটির কাহিনিতে নতুনত্ব থাকলেও, তাতে মোটা দাগেই বেশ কিছু ফাঁকফোকড় থেকে গেছে।

সিনেমাতে শেষ পর্যন্ত মূল চরিত্র ফুলেশ্বরী। বাঈজীর এই চরিত্রটি বিদ্যা সিনহা মিম ভালোই ফুটিয়ে তুলেছেন। বিপরীতে জমিদারপুত্র ও কবি রিজওয়ান চরিত্রে ইমনের উপস্থিতি তেমন জোরদার ছিল না। তবে লতিফুল ইসলাম শিবলীর লেখা রিজওয়ানের কবিতাগুলো ভালোই ছিল। খলনায়ক প্রথমত রণবীর কাপুর সিং, অভিনয়ে অমিত হাসান, বরাবরের মতোই। আর বাবুসাহেব সরফরাজের চরিত্রে শহীদুজ্জামান সেলিমের অভিনয় হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবেই ছিল অতিনাটকীয়, প্রচলিত মঞ্চনাটকের ঢংয়ে। বাঈজীমহলের মাসির চরিত্রে নিমা রহমান প্রত্যাশা-অনুযায়ী ভালোই করেছেন। দুই বন্ধুর চরিত্রে নয়ন খান-আবু হেনা রনির মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই রম্যধর্মিতার কারণে আবু হেনা রনি বেশি করতালি পেয়েছেন। খানিক সুযোগে রোমানা স্বর্না খারাপ করেননি। তারিক আনাম ও চিত্রলেখা গুহ অভিনয়ের তেমন সুযোগই পাননি। অন্যান্যদের চরিত্রও ছিল তেমনি, হ্রস্ব— অনন্ত হীরা, পীরজাদা শহীদুল হারুন প্রমুখ।

অতীত প্রেক্ষাপটের কাহিনি বলে, সিনেমাটিতে কাহিনি-অভিনয়ের মতোই গুরুত্বপূর্ণ ছিল লোকেশন, সেট ডিজাইন এবং মেকআপ-কস্টিউম। এগুলোর মধ্যে লোকেশন-সেট ডিজাইনে সিনেমাটি ভালো মতোই উৎরে গেছে। লোকেশন হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা— সোনারগাঁ লোকশিল্প জাদুঘর, পানাম নগর, আহসান মঞ্জিল, ধনবাড়ি-মহেড়া-নাগরপুর জমিদারবাড়ি ইত্যাদি। সেট ডিজাইনও মন্দ হয়নি। বিশেষ করে জলসাঘরটির জাঁকজমক কম থাকলেও, জলসাঘর বলে চিনতে তেমন কষ্ট হয়নি। রিজওয়ানদের কলেজটিকেও ব্রিটিশ আমলের বলে মেনে নেয়া গেছে। এমনকি মেকআপও মন্দ হয়নি; বিশেষত মেকআপের দুর্বলতায় কাউকে বিশেষ দৃষ্টিকটু ঠেকেনি।

তবে চূড়ান্ত গোলমাল পাকিয়ে গেছে কস্টিউম ডিজাইনে। সিনেমাটির কস্টিউম সেভাবে নির্দিষ্ট করে কোনো সময়ের কথা বলেনি, বরং একেকবার কস্টিউমগুলো মেকআপসমেত একেক সময়ের বলে মনে হয়েছে। বলে না দিলে, কস্টিউম দেখে কেউ ধন্ধে পড়েই যেতে পারে যে, সিনেমাটি কোন সময়ের। (সে জন্যই গল্প-বর্ণনে ভোকাল ন্যারেশন বেশ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।) গানের কস্টিউমগুলো আবার অনেকটাই পশ্চিমা ঢংয়ের। গানের দৃশ্যায়ন বলে তার ব্যাখ্যা দেয়া গেলেও, সিনেমার কস্টিউম ডিজাইনের ধারা বারবার পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দেয়াটা দুষ্কর। আর সব বাদ দিলেও, একাধিক দৃশ্যে ইমন কেন কাপড়ের উপর মেয়েদের-কটি-সদৃশ চোপড় পড়ল, সে প্রশ্নের উত্তর বিশেষ দরকারি।

পরিচালক নিজে সঙ্গীতশিল্পী হওয়ায় সিনেমাটির গানগুলো নিয়ে বিশেষ আগ্রহ ছিল, এবং সে আগ্রহ ষোলআনা পূরণও হয়েছে। গানের কথা, সুর, শিল্পীচয়ন— সবই মুগ্ধ করার মতো। কবিতার মতো গানগুলো রচনার জন্যও লতিফুল ইসলাম শিবলীর প্রশংসা পাওনা। গানের কথাগুলোও বেশ মনোযোগের দাবিদার। সিনেমায় অর্নব, এলিটা করিমের মতো শিল্পীদের, শিরোনামহীন, চিরকুটের মতো ব্যান্ডের গান গাওয়া এটাই প্রথম না হলেও, বিরলই বটে। সে প্রাপ্তির সঙ্গে বাড়তি পাওনা ছিল গানগুলোর সুন্দর কোরিওগ্রাফি। বাঈজী নিয়ে কাহিনি বলেই হয়তো, কিংবা রোম্যান্স-ড্রামা বলে, সিনেমাতে গান অন্যান্য সিনেমার তুলনায় বেশি ছিল— তীর মেরো না, তোমায় আমি, পদ্ম পাতার জল, একাকিনী তারা, আলোকিত সারাদিন, আমার রূপকথা জীবন, গোপনে গোপনে— মোট সাতটি। তারচেয়েও বড় পাওনা, বাঈজীর প্রেমকাহিনি নিয়ে সিনেমা হলেও, কাহিনির দাবি মিটিয়ে তাতে কোনো ধুমধাড়াক্কা আইটেম সং রাখা হয়নি।

সিনেমাটোগ্রাফিও মন্দ নয়। বেশ কয়েক জায়গায় ব্যয়বহুল এরিয়েল শট নেয়া হয়েছে বটে, তবে সেগুলোতে ঝাঁকুনিটুকু বাদ দেয়াটাও জরুরি ছিল। তারপরও আমাদের সিনেমায় এরিয়েল শট ঠিক সুলভ নয়, কাজেই ধন্যবাদ প্রাপ্য। মোটের উপর বেশ কিছু দৃশ্যে সিনেমাটোগ্রাফি মুগ্ধই করেছে। বিশেষ করে রাতের দৃশ্যগুলো, যেখানে রিজওয়ান-ফুলেশ্বরীকে নিয়ে পালাচ্ছিল, আর রণবীর কাপুর সিং তাদের ধাওয়া করছিল, পথে বৃষ্টি নামল, সেই দৃশ্যগুলোতে সিনেমাটোগ্রাফি এবং লাইটিং দুই-ই ভালো। সে দৃশ্যের জন্য বানানো ঘোড়ার গাড়িও মন্দ হয়নি।

তবে তালগোল পেকেছে এডিটিংয়ে গিয়ে। প্রায়ই দুই সিকোয়েন্সের মধ্যে কোনো ট্রানজিশন শট ছিল না। চলেছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ঘটনাটা ঘটেছে একটা গানের শেষেও। গান শেষ হতেই দর্শকদের রীতিমতো ধাক্কা দিয়ে আরেকটি সিকোয়েন্সে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। আর শেষ দৃশ্যের এডিটিংয়ে একটু বেশিই গোলমাল হয়ে গেছে। শেষ দৃশ্যে ইমনের দুর্বল অভিনয় ঢেকে যাওয়ার কথা ছিল বিপরীতে মিমের প্রাণবন্ত উপস্থিতি আর দুর্দান্ত লোকেশনে। কিন্তু এডিটিংয়ের দুর্বলতার কাছে সবই ম্লান হয়ে গেছে। এমনকি নায়ক যে শেষ দৃশ্যে উপমহাদেশের স্বভাব-বিরুদ্ধ ধরনে অসহায় আত্মসমর্পণ করল, তবুও আকাঙ্ক্ষিত ফল পেল না, এমনকি মূল ধারার সিনেমার বৈশ্বিক ফর্মুলা ভেঙে নায়ক-নায়িকার মিলনও যে ঘটল না, সে সবই ম্লান হয়ে গেছে এডিটিংয়ের ফাঁকের কাছে।

সব মিলিয়ে পদ্ম পাতার জল-এর কাহিনিতে নতুনত্ব থাকলেও, তাতে বেশ কিছু ফাঁকফোকড়ও রয়ে গেছে। দুর্দান্ত গান, তার সঙ্গে ভালো লোকেশন-সেট ডিজাইন-সিনেমাটোগ্রাফি সেই দুঃখ হয়তো ভুলিয়েই দিত। কিন্তু কস্টিউম আর এডিটিংয়ের দুর্বলতা তাকে বরং আরও তিক্ত করেছে।


 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ আগস্ট ২০১৫/নাবীল/রাশেদ শাওন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়