ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বিশ্বে শরণার্থী চিত্র ভয়াবহ

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২০ জুন ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিশ্বে শরণার্থী চিত্র ভয়াবহ

শিশু আয়লানের এই ছবি সারা বিশ্বকে আলোড়িত করেছিল

শাহ মতিন টিপু : বিশ্বে এখন শরণার্থী চিত্রটা ভয়াবহ। নিজ ভূমি ছেড়ে একটু নিরাপদ আশ্রয় পেতে কঠিন জীবনের মুখোমুখি অনেক উদ্বাস্তু পরিবার।

 

এইতো গত বছরেরই শেষ দিকের কথা, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে গ্রীসে আসার সময় নৌকাডুবিতে মারা যাওয়া শিশু আয়লানের মৃতদেহের ছবি সারা বিশ্বকে আলোড়িত করেছিল। সমুদ্র সৈকতে লাল জামা গায়ে একটি উপুড় হয়ে পড়ে ছিল ছোট আয়লানের নিথর দেহ। তিন বছর বয়সী আয়লান কুর্দি তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নৌকায় ইউরোপ যাওয়ার সময় সাগরে নৌকা ডুবে মারা যায়।

 

তুরস্কের বোদরুম সৈকতে পড়ে থাকা আয়লানের মৃতদেহের ছবি সংবাদ মাধ্যমে আলোড়ন তোলে।
কেবল আয়লান নয়, ইউরোপে নতুন জীবনের স্বপ্ন সম্বল করে প্রবল ঝুঁকি নিয়ে জাহাজ বা নৌকায় চড়ে বসছেন অসংখ্য শরণার্থী। ভূমধ্যসাগরে একের পর এক মর্মান্তিক ঘটনায় তাদের চরম মূল্য দিতে হচ্ছে। ডয়চে ভেলের এক তথ্যে জানা যায়, এ বছরও তুরস্কে অন্তত ২৭ লাখ সিরীয় শরণার্থী রয়েছে।

 

বিশ্বজুড়ে বাস্তুচ্যুতির এক বিপজ্জনক যুগের সূচনা হয়েছে। ইউএনএইচসিআর- এর হিসেবে যুদ্ধ, সংঘাত ও নির্যাতনের কারণে ২০১৪ সালেই পৃথিবী জুড়ে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ছিল ছয় কোটি। এই প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, নিজেদের বাস্তুভিটা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য মানুষের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বাড়ছে।

 

আজ বিশ্ব শরণার্থী দিবস (World Refugee Day)। প্রতি বছর ২০ জুন বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালন করা হয়। ২০০০ সালের ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভোটে আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। কারণে এ দিনেই ১৯৫১ সালে অনুষ্ঠিত শরণার্থীদের অবস্থান নির্ণয় বিষয়ক একটি কনভেনশনের ৫০ বছর পূর্তি হয় ২০০১ সালে। ২০০০ সাল পর্যন্ত আফ্রিকান শরণার্থী দিবস হিসাবে দিবসটি পালিত হয়ে আসছিলো। পরবর্তীতে দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে শরণার্থী দিবস হিসাবেই পালিত হচ্ছে।

 

তৃতীয় বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ থেকেই প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ পাড়ি দিচ্ছে বিদেশে, অজানার উদ্দেশ্যে। এসব দেশের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে আফগানিস্তান। আফগানিস্তান থেকে বেশির ভাগ মানুষ ইউরোপের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিচ্ছে।

 

এ সম্পর্কে ডয়চে ভেলে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের বর্ণনা এ রকম-

 

‘তুরস্ক এবং গ্রিসের মধ্যে এগেয়ান সমুদ্র। পাঁচজন আফগান একটি ছোট নৌকায় ধীরে ধীরে বৈঠা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। জীবন বাঁচাতে তারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। যারা তাদের পাচার করেছে তারা জানিয়েছে যে, ছয় ঘণ্টা নৌকা পাড়ি দিলেই তারা পৌঁছাবে গ্রিসে। আর একবার গ্রিসে পা রাখার মানেই ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশ। তবে যখনই নৌকা গ্রিসের তীরে এসে পৌঁছেছে, তখনই তাদের নৌকা উদ্দেশ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়েছে।’

 

আফগান আহমেদ করিম জানালেন, ‘সীমান্ত প্রহরী আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেপ্তার করে। আমাদের বড় একটি জাহাজে তোলা হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পর তুরস্কের একটি নির্জন দ্বীপের কাছে আমাদের নামিয়ে দেয়া হয়। আমাদের পানিতেই নামিয়ে দেয়া হয়, ডাঙায় নয়।’` যখন এই ঘটনা ঘটে তখন করিমের বয়স ২৩ বছর। তাদের পরে একটি তুর্কি জেলে উদ্ধার করে। তাদের পাঠানো হয় ইস্তানবুলে। কয়েক সপ্তাহ পর তাদের আবার পাঠানোর চেষ্টা করা হয় পশ্চিমের দেশগুলোতে। হাজার হাজার আফগান সন্ত্রাস, নিরাপত্তাহীনতা এবং অন্ধকার ভবিষ্যতের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যাচ্ছে।

 

এভাবেই প্রতি বছর করিমের মতো হাজার হাজার আফগান সন্ত্রাস, নিরাপত্তাহীনতা এবং অন্ধকার ভবিষ্যতের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। তারা বিশ্বাস করছে আদম পাচারকারীদের। যারা তাদের মিথ্যে কথা বলে ইউরোপে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
স্টেফান টেলোকেন জাতিসংঘের শরণার্থী দপ্তরে কাজ করছেন। তিনি রয়েছেন জার্মান বিভাগে। তিনি বলেন- প্রতি বছরই আমরা শুনি যে শরণার্থীরা মারা গেছে বা যাচ্ছে। তাদের কীভাবে বিভিন্ন নৌকায় বা কন্টেইনারে পাচার করা হয়েছে বা হচ্ছে। ভয়ঙ্কর সমুদ্র তারা কীভাবে পাড়ি দিয়েছে। অথবা সমুদ্রে তাদের কীভাবে নিঃসঙ্গ অবস্থায় ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে ছেড়ে দিয়ে আসা হয়েছে।’ ইরানে বর্তমানে বসবাস করছে প্রায় এক লক্ষ আফগান। অনেকেরই গন্তব্যস্থল ইউরোপ।

 

১৫ জুন (২০১৫) অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল  প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে লাখ লাখ শরণার্থীর অমানবিক জীবনযাপনের জন্য বিশ্ব নেতাদের ব্যর্থতার তীব্র সমালোচনা করে বলা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শরণার্থী সংকট চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের উপেক্ষার কারণে যুদ্ধবিধ্বস্ত মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিকের করুণ মৃত্যু ঘটেছে।

 

অ্যামনেস্টির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিরিয়া থেকে আসা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়া দেশগুলো উল্লেখ করার মতো কোনো আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পায়নি। জাতিসংঘ শরণার্থীদের জরুরি চাহিদা পূরণে তহবিল চেয়ে বারবার আবেদন জানালেও আন্তর্জাতিক মহল সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

 

অ্যামনেস্টির ওই প্রতিবেদনে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা পাচারের বিষয়টিও তুলে ধরা হয়। মালয়েশিয়ার স্টার অনলাইন  প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা পাচারকারী চক্রের মূল হোতা হিসেবে মালয়েশিয়ার কয়েকজন ব্যবসায়ীকে শনাক্ত করেছে সে দেশের পুলিশ।

 

মালয়েশিয়ার অন্তত তিনজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের আড়ালে আন্তর্জাতিক এই পাচার চক্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত বলে পুলিশ জানিয়েছে। চক্রের ৭০ জনেরও বেশি সদস্যকে গ্রেফতারের পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে মালয়েশিয়ার পুলিশ সদর দপ্তরের একটি এলিট ফোর্স তদন্তের মাধ্যমে তাদের শনাক্ত করেছে বলে জানানো হয়। তবে মূল হোতাদের পরিচয় জানানো হয়নি।’

 

আমাদের দেশেও শরণার্থীদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোতে শরণার্থী অভিজ্ঞতা স্থায়ী ছাপ রেখে যাচ্ছে। দেশ বিভাগের সময় বিহারি এবং পরবর্তী সময়ে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গারা আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়ে অবস্থান করছেন। আর এর মধ্যবর্তী সময় মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতে বাংলাদেশিদেরই শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নেওয়ার অভিজ্ঞতা তো রয়েছেই।

 

দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে চলছে রোহিঙ্গাদের এদেশে আসার প্রক্রিয়া। মিয়ানমারে সামরিক জান্তা সরকারের অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়ে ১৯৯২ সালের শুরুর দিকে ২ লাখ ৫২ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে চলে এসেছিল। পরবর্তীতে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনইচসসিআর) মধ্যস্থতায় ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন শরণার্থী স্বদেশে ফিরে গেলেও মিয়ানমার সরকারের ছাড়পত্র না দেয়ার কারণে আরো ২৫ হাজার শরণার্থী নিজ দেশে ফেরত যেতে পারেনি। আবার স্বদেশে ফিরে গিয়েও আবারও সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে তারা।

 

গত ৫ বছরে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে ফিরে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৫০ হাজারের মতো অবৈধভাবে অবস্থান করছে কুতুবপালং শরনার্থী শিবির সংলগ্ন ৪/৫ টি পাহাড়ে। স্থানীয়দের মতে, রোহিঙ্গাদের কারণে আশপাশের বাংলাদেশি জনবসতি গুলোতে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতিসহ নানা সমস্যা-সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে।

 

অন্যদিকে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নিজ দেশের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ।

 

তাদের জন্য নেই সেখানে কোন কাজ। ফলে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু ছোট দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য এই চাপ কতটা সহনীয় সে প্রশ্ন রয়েছে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ জুন ২০১৬/ টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ