ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘বাহাদুর শাহ পার্ক ইতিহাসের কুলীন স্বাক্ষর’

রুহুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৫২, ৩০ জুলাই ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘বাহাদুর শাহ পার্ক ইতিহাসের কুলীন স্বাক্ষর’

রুহুল আমিন : বাহাদুর শাহ পার্কে যখন পৌঁছালাম তখন বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে দুপুরের দিকে। ঠিক দুপুর না হলেও দুপুর ছুঁই ছুঁই করছে। মেঘভরা শ্রাবণের আকাশে হঠাৎ কাঠফাটা রোদের আস্ফালন। পার্কে ঢুকে ছায়া দেখে এক জায়গায় বসলাম। অবশ্য ছায়া খুঁজতে হয়নি। পুরো পার্ক যেন সবুজে ছেয়ে থাকা অরণ্য। উপুড় হয়ে আকাশ দেখতে হলে একটু কসরতই করতে হয়।

পার্কের ভেতরে বসে মনে হবে ঢাকার ভেতরে, সদরঘাট থেকে একটু সামনে যানবাহন, ময়লা-আবর্জনা আর হাজারো মানুষের কোলাহল থেকে অল্প দূরত্বে এ যেন বিচ্ছিন্ন একটি সবুজঘেরা দ্বীপ। অবশ্য পচা-ময়লার দুর্গন্ধ কিন্তু তখনো আসছিল।

বর্তমানে পার্কটি প্রায় সব সময় জনাকীর্ণ থাকে। পার্কটির পাশেই অবস্থিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেকে এখানে এসে আড্ডা দেন। আছে প্রেমিক যুগলের পায়চারী।

কথা হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী রাহিতুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রায়ই বাহাদুর শাহ পার্কে এসে আড্ডা দেন। আজ তিনি এক বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছেন। বন্ধু এলে ক্লাস অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে আলোচনা করবেন।

 

 

এক নজরে বাহাদুর শাহ পার্কের ইতিহাস : আঠার শতকের শেষের দিকে এখানে ঢাকার আর্মেনীয়দের বিলিয়ার্ড ক্লাব ছিল। যাকে স্থানীয়রা নাম দিয়েছিল আন্টাঘর। বিলিয়ার্ড বলকে স্থানীয়রা আন্টা নামে অভিহিত করত। সেখান থেকেই এসেছে ‘আন্টাঘর’ কথাটি। ক্লাবঘরের সঙ্গেই ছিল একটি মাঠ বা ময়দান যা আন্টাঘর ময়দান নামে পরিচিত ছিল। ১৮৫৮ সালে রানী ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করার পর এই ময়দানেই এ সংক্রান্ত একটি ঘোষণা পাঠ করে শোনান ঢাকা বিভাগের কমিশনার। সেই থেকে এই স্থানের নামকরণ হয় ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক’। ১৯৫৭ সালের আগ পর্যন্ত পার্কটি ভিক্টোরিয়া পার্ক নামে পরিচিত ছিল।

১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর এক প্রহসনমূলক বিচারে ইংরেজ শাসকরা ফাঁসি দেয় অসংখ্য বিপ্লবী সিপাহিকে। তারপর জনগণকে ভয় দেখাতে সিপাহিদের লাশ এনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় এই ময়দানের বিভিন্ন গাছের ডালে। ১৯৫৭ সালে (মতান্তরে ১৯৬১) সিপাহি বিদ্রোহের শতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে পার্কের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক। সিপাহি বিদ্রোহ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইংরেজ শাসনের সমাপ্তি ঘটিয়ে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের শাসন পুনরায় আনার জন্য। তাই তার নামানুসারে এর নতুন নামকরণ করা হয় ‘বাহাদুর শাহ পার্ক’।

উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ইংরেজরা এটি কিনে নেয়। তারা এটিকে একটি পার্কের রূপ দেয় এবং এর চারদিকে লোহা দিয়ে ঘিরে দিয়ে এর চার কোণায় চারটি দর্শনীয় কামান স্থাপন করে। অচিরেই স্থানটি জীর্ণ হয়ে গেলে ভেঙে নওয়াব আব্দুল গণির উদ্যোগে একটি ময়দান মত তৈরি করা হয়। তখনো এর চারপাশে অনেক আর্মেনীয় বাস করত। ১৮৪০ সালেও এটি ছিল কয়েকটি রাস্তার মাঝে এক টুকরো খালি জায়গায় বৃত্তাকার একটি বাগান।

 


ক্লাবঘরটির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ঢাকার নবাব আব্দুল গণি ও নবাব আহসান উল্লাহ। ক্লাবটিতে ইংরেজরা বিলিয়ার্ড ছাড়াও র্যা কেট, টেনিস, ব্যাডমিন্টন খেলতেন এবং আড্ডা দিতেন। এখানে পার্টি-ফাংশনও আয়োজন করা হতো। ঢাকা ক্লাবের ইতিহাস এবং পুরনো নথিপত্র অনুযায়ী আন্টাঘর ময়দানের কাছে ঢাকা ক্লাবের এক একর জমির ছিল। পুরনো কর্মচারীদের মতে, ঢাকা ক্লাব ১৯৫২ সাল পর্যন্ত এ এলাকা তিন একর জমির জন্য খাজনা প্রদান করত। বিশ শতকের বিশের দশকে ঢাকার নবাবদের ক্ষমতা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তির ভাটা পড়লে ক্লাবটির প্রতি তাদের অনুদান কমে যায়। ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে ঘোড়দৌড় আয়োজন এবং আরো অন্যান্য প্রয়োজনে ইংরেজরা ঢাকা ক্লাবটিকে শাহবাগ এলাকায় স্থানান্তরিত করেন।

এ ময়দান বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে ১৮৫৭ সালে। ১৮৫৭ সালের ২২ নভেম্বর ইংরেজ মেরিন সেনারা ঢাকার লালবাগের কেল্লায় অবস্থিত দেশীয় সেনাদের নিরস্ত্র করার লক্ষ্যে আক্রমণ চালায়। কিন্তু সৈন্যরা বাধা দিলে যুদ্ধ বেধে যায়। যুদ্ধে আহত এবং পালিয়ে যাওয়া সেনাদের ধরে এনে এক সংক্ষিপ্ত মার্শালের মাধ্যমে তাদের দোষী সাব্যস্ত করে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বিচারের পর ১১ জন সিপাহিকে আন্টাঘর ময়দানে এনে জনসম্মুখে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়। স্থানীয় লোকদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করতে লাশগুলো বহু দিন যাবৎ এখানকার গাছে গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এ ঘটনার পর বহুদিন পর্যন্ত এই ময়দানের চারপাশ দিয়ে হাঁটতে ঢাকাবাসী ভয় পেত, কারণ এ জায়গা নিয়ে বিভিন্ন ভৌতিক কাহিনী ছড়িয়ে পড়েছিল। সিপাহি বিদ্রোহ দমনের পর ইংরেজরা তাদের সেনাদের স্মরণে আন্টাঘর ময়দানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছিল।

আর্মেনীয় ক্লাবঘরের চার কোণায় বসানো সীমানা নির্দেশক চারটি ব্রিটিশ কামাণ পরবর্তীকালে তুলে এনে এই পার্কের চারদিকে বসানো হয়। এ পার্কের উন্নয়নে নওয়াব আব্দুল গণির ব্যক্তিগত অবদান ছিল। তার নাতি খাজা হাফিজুল্লাহর মৃত্যুর পর তার ইংরেজ বন্ধুরা জনাব হাফিজুল্লাহর স্মৃতি রক্ষার্থে চাঁদা তুলে ১৮৮৪ সালে এখানে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করেছিলেন।

১৯৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে `ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট` (ডিআইটি)-এর উদ্যোগে এই স্থানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ জুলাই ২০১৬/রুহুল/মুশফিক

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়