ঢাকা     রোববার   ০৫ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২২ ১৪৩১

আমি বাবা, আমিই মা

শেখ মো. আনোয়ার হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪৯, ২০ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
আমি বাবা, আমিই মা

আমার লেখালেখির হাত ছোটবেলা থেকেই। স্কুল জীবনে বিভিন্ন সময় দৈনিক পত্রিকার চিঠিপত্র কলামে স্থানীয় বিভিন্ন সময়ে লেখালেখি করতাম।

পরে এসএসসি পাস করার পর কিছু পত্রিকায় স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছি। তবে তা নিয়মিত করা হয়নি। আর এ সমস্ত দিবসে কখনও আমি লেখা পাঠাইনি। এখন আমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছি। গার্মেন্টস কর্মাশিয়াল মানে বাণিজ্যিক কর্মকর্তা হিসেবে। যেহেতু আমার কাজের বেশির ভাগ সময় ব‌্যয় করতে হয় কম্পিউটারে ডকুমেন্টস তৈরি করা, অনলাইন বিভিন্ন ডকুমেন্টস ইনপুট দেওয়া ইত্যাদি। এসব কাজের পাশাপাশি যখন একটু নিজেকে বোরিং বলে মনে হয় তখনই দেশের কারেন্ট নিউজ দেখার জন্য অনলাইন সংবাদপত্রগুলো চোখ বুলাই।

গতকাল রাইজিংবিডি ডটকম অনলাইন পত্রিকায় দেখলাম বাবা দিবসের জন্য লেখা আহ্বান করেছে। হঠাৎ ভাবলাম আমিও একটা লেখা পাঠাবো। তাই আজ কাজের অবসরে বাবা দিবস নিয়ে লিখতে বসলাম।

আমার বাবা গত হয়েছেন ২০০৮ সালের ৭ মার্চ। প্রায় অনেকদিন ক্যানসারের সাথে লড়াই করে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। বাবার ভালোবাসার কথা আমার ভোলার নয়। তখন আমি সবেমাত্র বিয়ে করেছি। তখনও নিজে বাবা হয়নি। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখে আমার প্রথম মেয়ে আদিবার জন্ম। যেহেতু আমি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, তাই আমার কাজের সময় ছিল অনেক বেশি।

ছুটির দিন ছাড়া আমার বাচ্চাকে খুব একটা সময় দিতে পারতাম না। ওর মা ওকে সার্বক্ষণিক সময় দিতো। আসতে আসতে আমার বড় মেয়েটি বড় হতে থাকলো। একটা সময় মনে হলো ওর একজন সঙ্গী দরকার। তাই আমরা প্ল্যান করলাম আমাদের দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার। ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট নারায়াণগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালে সিজারিয়ানের মাধ্যমে আমাদের ঘর আলো করে আমাদের দ্বিতীয় কন‌্যা ঠিক একেবারে সত্যি রাজকন‌্যার মতো দেখতে আনিতার জন্ম। আনিতাকে দেখে আমার চোখ আর ফেরেনা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বললো কমপক্ষে এক সপ্তাহের মতো থাকতে হবে।

পরের দিন ৩০ আগস্ট ভোর ৪টার দিকে আমার বড় বোন ফোন করে বললো, আমার স্ত্রীর শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে তাই আমি যেন তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যাই। আমার বাড়ি  বন্দর রাজবাড়ীতে। আমার বোনের ফোন পাওয়ার সাথে সাথে আমি কিছুক্ষণের মধ্যে হাসপাতালে উপস্থিত হই। সেখানে গিয়ে ডিউটি ডাক্তারের কাছ থেকে জানতে পারি, আমার বউয়ের প্রসাব বন্ধ হয়ে গেছে। তাকে ঢাকা মেডিক‌্যাল কলেজে নিয়ে যেতে হবে। আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম, আমার সুস্থ স্ত্রীর কী  হলো? তখন ডাক্তার আমাকে জানায়, বড় কোনও সমস্যা নেই। ওখানে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমি অ‌্যাম্বুলেন্সে ঢাকা মেডিক‌্যালে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় দেখলাম, আমার স্ত্রীর শরীর বেশ খারাপ। তার শরীর ফুলে গেছে। তার প্রচণ্ড রকমের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। অ‌্যাম্বুলেন্স করে ঢাকা মেডিক‌্যালে পৌঁছার পর যথারীতি দালালের মাধ্যমে টাকা দিয়ে ভর্তি করালাম।

আমার অসুস্থ স্ত্রী শ্বাসকষ্টে কাতরাচ্ছে আর এদিকে বাইরের ডাইগনস্টিক সেন্টার এবং বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা মেডিক‌্যালের ডাক্তারদের মাধ্যমে বিভিন্ন টেস্ট এবং ওষুধ লিখে নিলো। আমি যথারিতি ডাইগনস্টিক এর ম্যাডামকে বেশ অনেক টাকা দিলাম টেস্ট করার জন্য এবং ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির কাছ থেকে ওষুধ বাবদ অনেক টাকা দিয়ে তাদের মনোনীত কোম্পানির ওষুধ কিনলাম।

কিন্তু আমার স্ত্রীর অবস্থা খারাপের দিকে যায়। আমি বার বার পুরুষ ডাক্তার এবং মহিলা ডাক্তারদের অনেক কাকুতি-মিনতি করলাম এবং তাদেরকে অনেক অনুরোধ করলাম কিন্তু কিছুতেই কাজ হলো না। আমি দেখলাম আমার স্ত্রীর অবস্থা ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে যাচ্ছে। পরবর্তীতে আমার মেঝ বোনের ছেলে রানার কথায় সেখান থেকে আমার স্ত্রীকে রিলিজ নিয়ে ধানমন্ডির ইবনে সিনায় নিয়ে যাই। সেখানকার পরিবেশ বাইরের ফাইভ স্টার হোটেলের আদলে তৈরি। প্রথম দিন আইসিইউতে  ভর্তি, চতুর্থ দিন থেকে লাইভ সাপোর্ট এবং ষষ্ঠ দিন দুনিয়া থেকে চির বিদায়।

আমার বড় মেয়ে আদিবার তখন বয়স ছিল সাত বছর। আর ছোট মেয়ে আনিতার বয়স এক দিন। আমি আমার ৭০ বৎসরের বৃদ্ধা মাকে নিয়ে ঐ খেকে সংগ্রাম করে যাচ্ছি। এখন আমার বড় মেয়ের বয়স দশ বৎসর চলছে এবং আমার ছোট মেয়ের বয়স দুই বৎসর দশ মাস। আমার ছোট রাজকন‌্যাটি এখন আমাকে আদো আদো কণ্ঠে বলে, বাবা তুমিই আমার মা আর তুমিই আমার বাবা। সেই থেকে বাস্তব জীবনে বাবা মার অভিনয় করে যাচ্ছি। আজ বাবা দিবসে আমার দুই রাজকন‌্যাদের কাছে মা হারা সিঙ্গেল বাবার অভিনয় করে যাচ্ছি। এর যে, শেষ কোথায় তা জানিনা।                               

নারায়ণগঞ্জ থেকে


ঢাকা/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়