ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

ভাস্কর্য ভেঙে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলা যাবে না

গোপাল অধিকারী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৪৮, ৮ ডিসেম্বর ২০২০  
ভাস্কর্য ভেঙে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলা যাবে না

ভাস্কর্য নিয়ে দ্বিমত দেশে নতুন নয়। বিভিন্ন সময় ইসলামপন্থী দলগুলো ভাস্কর্য তৈরির বিরোধীতা করে বক্তব্য দিয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ন্যায় বিচারের প্রতীক গ্রীক দেবী থেমিসের একটি ভাস্কর্য স্থাপনের বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের পর চাপের মুখে সেটি স্থানান্তর করা হয়। সরিয়ে ফেলা হয় ঢাকায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে লালনের ভাস্কর্য। বলা যায়, তারই ধারাবাহিকতায় ঢাকার ধোলাইরপাড়া চত্বরে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্য তৈরির পরিকল্পনার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ইসলামপন্থী বেশ কয়েকটি দল সেই পরিকল্পনার বিরোধীতা করে। তারা ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব্য দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্যে ভাঙচুরও করেছে।

এই ঘটনার পর দেশের সবগুলো ভাস্কর্যে অতিরিক্ত নজরদারি শুরু হয়েছে। সারাদেশে শুরু হয়েছে প্রতিবাদের ঝড়। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যসহ দেশের সকল ভাস্কর্য রক্ষায় হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছেন আইনজীবী উত্তম লাহেরি। রিটে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনকে কেন্দ্র করে যে কোনো ধরনের নৈরাজ্য ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি রোধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে ভাস্কর্য নিয়ে জনমনে সৃষ্ট বিভ্রান্তি দূর করতে জনসচেতনতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। এছাড়া রিটে রুল জারির আর্জিও জানানো হয়েছে। প্রশ্নটা হলো- কেন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হলো? এর উত্তর সহজ। কারণ ‘বঙ্গবন্ধু’ শুধু একটি শব্দ নয়। তিনি এই জাতির প্রতীক। আমাদের জাতির পিতা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক। আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি। যারা সেই স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না তারা চাইবে এ দেশ থেকে বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্ব মুছে ফেলতে। সে চেষ্টা তারা বহুবার করেছে। কিন্তু সফল হয়নি। এবার তারা হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে ধর্মকে।

বঙ্গবন্ধুর জীবনী পাঠ করলে, তাঁর রাজনীতি, চেতনা হৃদয়ে ধারণ করলে বোঝা যায় ধর্মান্ধদের ক্ষোভটা কোথায়! বঙ্গবন্ধু ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন এবং এক বছরের জন্য বেঙ্গল মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তাকে গোপালগঞ্জ মুসলিম ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারি নিযুক্ত করা হয়। ১৯৪৩ সালে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে বঙ্গবন্ধু ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ৪ জানুয়ারি মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন আইন পরিষদে ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেবে’ বলে ঘোষণা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে বঙ্গবন্ধু এর প্রতিবাদ জানান।

১৯৫২ সাল। ২৬ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু’। এর প্রতিবাদে বন্দি থাকা অবস্থায় ২১ ফেব্রুয়ারি রাজবন্দি মুক্তি এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি দিবস হিসেবে পালন করার জন্য বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতি আহ্বান জানান। ১৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু এ দাবিতে জেলখানায় অনশন শুরু করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্র সমাজ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, বরকত, রফিক, শফিউর শহীদ হন। বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে এক বিবৃতিতে ছাত্র মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। একটানা ১৭ দিন অনশন অব্যাহত রাখেন। জেলখানা থেকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার দায়ে তাকে ঢাকা জেলখানা থেকে ফরিদপুর জেলে সরিয়ে নেওয়া হয়।

বাঙালি, বাংলাদেশ, বাংলা ভাষার প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল প্রকৃত ভালোবাসা। সেখানে কোনো লুকোচুরি ছিল না। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহের জাতীয় সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। প্রস্তাবিত ৬ দফা ছিল বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ। বঙ্গবন্ধু ৬ দফার পক্ষে জনমত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সারা বাংলায় গণসংযোগ শুরু করেন। এ সময় তাকে সিলেটে, ময়মনসিংহ ও ঢাকায় বারবার গ্রেপ্তার করা হয়। লক্ষ্য করুন, বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে বছরের প্রথম তিন মাসে আটবার গ্রেপ্তার হন। তারপরও তাঁকে টলানো যায়নি। তিনি লক্ষ্যে ছিলেন অকুতোভয়, অবিচল। তখন একটাই তাঁর স্বপ্ন- বাঙালির মুক্তি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আজ যারা ধর্মের মোড়কে রাজনীতি করেন তারা কখনও এই বাংলাদেশ চায়নি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই তাদের পরাজয় ঘটে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর। সেদিনই আসলে ঠিক হয়ে যায়, বাংলাদেশ কীভাবে শাসিত হবে।

আজ এত বছর পরে এসে একাত্তরের পরাজিতরা শোধ নিতে চাইছে। তাদের এই অপচেষ্টা নতুন নয়। স্বাধীনতার পর তারা বহুবার বহুভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করে ফায়দা লুটতে চেয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে। আজ যখন জাতির জনকের কন্যার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে তখন তারা ভিন্ন উপায়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। ভাস্কর্য আর মূর্তি উসিলামাত্র।

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার বিষয়টিকে অনেকে ‘অ্যাসিড টেস্ট’ বলতে চাইছেন। একে প্রশ্রয় দিলে ধীরে ধীরে তারা স্বরূপে ফিরবে। তাই কোনো অবস্থাতেই এই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে না। মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিমাত্র নন, তিনি অবিনশ্বর এক আদর্শ ও প্রেরণার নাম। সেই প্রেরণাতেই এগিয়ে যাবে আগামীর বাংলাদেশ। দেশের অগ্রযাত্রা রুখতে এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে পরিকল্পিতভাবে আঘাত হানা হয়েছে। কিন্তু তারা ভুলে গেছে সন্তানের মন থেকে কখনও পিতার নাম মুছে ফেলা যায় না। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতীক হয়ে থাকবেন- এই সত্যকেও কখনও মুছে ফেলা যাবে না। যারা সেই অপচেষ্টা করবেন ইতিহাস তাদের কখনও ক্ষমা করবে না।

লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়