ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

জগতে আনন্দযজ্ঞে ছড়ার নিমন্ত্রণ

লুৎফর রহমান রিটন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:১২, ২২ জানুয়ারি ২০২১  
জগতে আনন্দযজ্ঞে ছড়ার নিমন্ত্রণ

ছড়ার ভাষা: খুকুমণির ছড়া থেকে তেলের শিশি

প্রতিটি শিল্প-মাধ্যমের নিজস্ব ভাষা থাকে। সেই ‘নিজস্ব ভাষা’টিই তাকে স্বাতন্ত্র্য দেয়। অন্যদের থেকে আলাদা করে। শিল্প মাধ্যম ছড়ার ভাষাটিও তাই অন্য কারো সঙ্গে মেলে না। এমনকি মেলে না তার নিকটাত্মীয় কবিতার সঙ্গেও।

বাংলা ছড়াকে প্রথম মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী। আজ থেকে একশ কুড়ি বছর আগে বাংলা ১৩০৬ সালে যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘খুকুমনির ছড়া’ শীর্ষক বইটির ভূমিকা লিখতে গিয়ে তিনিই প্রথম ‘ছড়াসাহিত্য’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। ছড়াকে প্রথম সাহিত্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছিলেন তিনি। ছড়াকে সাহিত্যের মর্যাদায় সমুন্নত রাখতে ছড়াকারদের চেষ্টার কমতি নেই। কখনো প্রবীণদের প্রদর্শিত পথে হেঁটে, কখনো প্রবীণদের প্রদর্শিত পথকে অস্বীকার করে নবীন ছড়াকাররা ছড়াকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এবং এই এগিয়ে চলার পথটি দীর্ঘ। দীর্ঘ এই পথ পরিক্রমায় আমরা লক্ষ্য করি যে পাল্টে যাচ্ছে ‘ছড়ার ভাষা’।

শিশুর প্রথম পাঠ হচ্ছে ছড়া। শিশুর পবিত্র মুখে কথা ফোটার শুরুতেই আধো আধো বোলে ওরা ছড়া আওড়ায়। বড়দের কাছ থেকে ছড়া শুনে শুনে অনায়াসে সেই ছড়াগুলো মুখস্থ করে ফেলে শিশুরা। বর্ণমালা চেনার আগেই মায়ের কথার মাধ্যমে কিংবা ছবির মাধ্যমে ছড়া ওদের চেনা হয়ে যায়। এককালে মুখে মুখে রচিত হতো ছড়া। মায়েরা তাদের ছোট্ট সোনামণিদের সঙ্গে খেলতে খেলতে মুখে মুখে ছড়া বানাতেন। ওদের খাওয়াতে কিংবা ঘুমপাড়াতেও মায়েরা ছড়া বলতেন। একালের আধুনিক মায়েরাও শিশুদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন ছড়ার মাধ্যমেই। যুগ যুগ ধরে এভাবেই মা এবং শিশুর কথোপকথনের একটা কার্যকর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে ছড়া। ছড়ার ভাষাটা এখানেই আর সব ভাষা থেকে স্বাতন্ত্র্য ও উজ্জ্বল।

ছড়ার ছন্দ শিশুর মনোজগতকে রাঙিয়ে তোলে। ছড়াই পারে শিশুর শৈশব বর্ণাঢ্য ও ছন্দময় করে তুলতে। শিশুর কল্পনাশক্তিকে প্রখর ও বিস্তারিত করতে। ছড়ার ছন্দ এবং মিল শিশুকে আকৃষ্ট করে বলেই শিশুরা প্রায়শঃ নিজেরাও ছড়া বানায় মুখে মুখে। ছড়া এবং ছবির মাধ্যমেই একটি শিশু প্রবেশ করে তার একান্ত নিজস্ব সৃজনশীলতার অপরূপ ভুবনে।

গ্রামের অক্ষরজ্ঞানহীন সহজ সরল মানুষে মুখে মুখে ছড়া বানাতেন। বিশেষ করে গাঁয়ের বধূরা, কিষাণীরা, মায়েরা, বোনেরা তাদের দৈনন্দিন যাপিত জীবনের দুঃখ-কষ্ট-বেদনা আর নিপীড়নের কাহিনি ছড়ার মৌখিক ফরম্যাটে বাণীবদ্ধ করে রাখতেন। স্বামী নামের ভয়ঙ্কর পুরুষরূপী হায়েনার হিংস্র্রতা, দজ্জাল শাশুড়ির অমানবিক শারীরিক-মানসিক নির্যাতন এবং ননদিনি বাঘিনীদের ষড়যন্ত্র ও কূটনামির চিত্র মূর্ত হয়ে আছে এই শ্রেণির ছড়াগুলোয়। কেউ সেটা লিখে রাখত না, বা লিখে রাখার সুযোগ তখন ছিল না। মা-খালা-ভগ্নিদের মুখ থেকে শুনে শুনে অন্যেরা সেটা আওরাতে চাইতেন। এই রকম আওরাতে গিয়ে শ্রুতি নির্ভর স্মৃতিতে ধরে রাখা ছড়াটির কোনো কোনো শব্দ বা অংশ যেতো পাল্টে। ভুলে যাওয়া শব্দটির জায়গায় অবলীলায় নতুন শব্দ বসিয়ে নিতেন তাঁরা অপরূপ দক্ষতায়। গ্রামের অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষদের এই দক্ষতাকে অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন ‘অশিক্ষিতের পটুত্ব’। লোক মুখে সেই ছড়া ছড়িয়ে পড়ত। আর ছড়িয়ে পড়ার ধারাবাহিক পরিক্রমায় মূল ছড়াটির আদল খানিকটা বদলে যেত। সে কারণেই প্রাচীন একটি ছড়ার বেশ কয়েকটি রূপ আমরা দেখতে পাই। অশিক্ষিতের পটুত্বের নিদর্শন সেই ছড়াগুলোর রচয়িতার নামটি আমরা আর খুঁজে পাই না। ছড়াটি টিকে থাকে লোকমুখে লোকসমাজে কিন্তু ছড়াকার যান হারিয়ে। ক্রমে ক্রমে লিখতে জানা মানুষেরা গ্রাম বাংলায় ছড়িয়ে থাকা সেই মণিমাণিক্যগুলো অর্থাৎ ছড়াগুলো তুলে এনেছেন লেখ্য রূপে। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘খুকুমনির ছড়া’ সেই রকম একটি রত্নভাণ্ডার।

ছড়া আমাদের লোকসাহিত্যের আদিতম নিদর্শন। লোকছড়ার জন্ম তখন, যখন জন্ম হয়েছিল ভাষার। ভাষার পরিবর্তনের পাশাপাশি পাল্টেছে তাই ছড়াও। সময়ের ব্যবধানে একই ছড়াকে সেকারণেই আমরা কয়েকটি পরিবর্তিত রূপে দেখতে পাই। ভবতারণ দত্তের ‘বাংলাদেশের ছড়া’ শীর্ষক গ্রন্থে একই ছড়ার কয়েকটি রূপের দেখা মেলে। সময়ের ব্যবধানে মুখে মুখে রচিত ছড়াগুলো পাল্টে গিয়েছে মুখে মুখেই।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ছড়া কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখে কিংবা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ছড়ার আদৌ কোনো কার্যকর ভূমিকা আছে কিনা সেদিকে একটু নজর দেওয়া যাক। আমাদের চারপাশ ছন্দময় এবং ছড়াময়। শুধু শিশুরাই নয়, ছড়ায় মন্ত্রমুগ্ধ প্রাপ্তবয়স্করাও। এমনকি প্রবীণরাও। দেয়াল লিখনে, মিছিলের স্লোগানে, রাজনৈতিক সমাবেশে, সামাজিক-রাজনৈতিক অসঙ্গতি-অনাচার-অবিচার-শোষণ-বঞ্চনা প্রতিরোধে, প্রতিবাদে- কোথায় নেই ছড়া? সেই প্রাচীনকাল থেকে মানুষের মুখে মুখে রচিত হয়ে ছড়া ফিরেছে মানুষের মুখে মুখে। এখনো ফেরে। ছড়া এমনই। রাজনৈতিক কোনো বক্তব্য ছড়ার ছন্দে গাঁথা হলে সেটা আলাদা শক্তিতে দীপ্র ও ক্ষীপ্র হয়ে ওঠে। তারপর তা মানুষের মুখে মুখে ফিরতে থাকে। ছন্দ ও মিলের অপূর্ব ম্যাজিকের কারণে ছড়া খুব সহজেই আলোড়িত করে মানুষকে। ছড়ার এরকম শক্তির কারণেই আন্দোলনে অভ্যুত্থানে, প্রতিবাদী মানুষের প্রধান অবলম্বন ‘স্লোগান’ হয়ে ওঠে ছড়া।

সময়ের প্রয়োজনে তখন, ছড়া হয়ে ওঠে গণ-মানুষের দাবির ভাষা। সহস্র মানুষের অপ্রতিরুদ্ধ মিছিলের স্লোগান হয়ে ওঠা ছড়াকে, ছড়ার ভাষাকে তখন বসাতেই হয় আলাদা মর্যাদার উচ্চতর আসনে। গৌরবের আসনে। স্বাধীনতা-পূর্বকালে আমার সহযোদ্ধাদের কেউ একজন রচনা করেছিলেন অমর পঙ্ক্তি ‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা।’ কী বিপুল শক্তি ধারণ করেছিল স্লোগানরূপী ছড়াটি। একটি জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়কে তার অস্তিত্বের শেকড়কে তার স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষাকে প্রবলভাবে চিত্রিত ও চিহ্নিত করেছিল মাত্র ছয়টি শব্দের একটি ছড়া। স্বাধীনতা উত্তরকালে ‘খুন হয়েছে আমার ভাই/খুনি তোমার রক্ষা নাই’ অথবা ‘এক দফা এক দাবি/এরশাদ তুই কবে যাবি?’- এরকম বহু ছড়া স্লোগানে রূপান্তরিত হয়ে উদ্দীপ্ত করেছে মুক্তিকামী গণ-মানুষকে। ছড়ার ভাষা মানুষকে উদ্দীপ্ত করে, উত্তেজিত করে, প্রশান্ত করে, আনন্দিত করে। ভয় দেখায় আবার অভয়বাণীও শোনায়। স্বপ্ন দেখায় এবং সাহসে বুক বাঁধতে প্রেরণা জোগায় ছড়া।

ছড়া ছোট, কিন্তু লক্ষ্যভেদী। আপাত নিরীহ, কিন্তু অভ্রভেদী।

ছড়ার দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আমরা লক্ষ্য করি- আধুনিক কালে এসে সুকুমার রায় থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত ছড়া হাস্যরস আর উদ্ভট চিত্রকল্পে আবদ্ধ ছিল। অন্নদাশঙ্কর রায় এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটালেন- ‘তেলের শিশি ভাঙলো বলে খুকুর পরে রাগ করো/তোমরা যে সব বুড়ো খোকা/ভারত ভেঙে ভাগ করো/তার বেলা?’ সেই থেকে শুরু হলো ভিন্নতর যাত্রা, ছড়ার। আধুনিক কালের ছড়াকাররা অবলীলায় শামিল হলেন অন্নদাশঙ্করী ধারায়। আর সে কারণেই বাংলাদেশে আমরা দেখি- বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, বাহাত্তর তেহাত্তরের অরাজক পরিস্থিতি, চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, পঁচাত্তরের শেখ মুজিব হত্যা, সামরিক শাসন থেকে শুরু করে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীদের চরিত্রপতনের ঘটনাগুলো ছড়াকাররা তাঁদের ছড়ায় খুবই খুদে আয়তনে বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে ধরে রেখেছেন। বাংলাদেশের ইতিহাস রচনায় এই টুকরো টুকরো দৃশ্যগুলো রীতিমতো ‘রাজসাক্ষী’র ভূমিকায় অবতীর্ণ। ষাটের দশকে বক্তব্যপ্রধান রাজনৈতিক ছড়ায় ‘শাসক’ আর ‘শোষিত’ এই দুটি শ্রেণিকে বোঝাতে ছড়াকাররা ‘রাজা ও প্রজা’ শব্দ দুটি পুনঃপুনঃ ব্যবহার করেছেন। সত্তরেও এই ধারা প্রায় অক্ষুণ্ন ছিল। কিন্তু সত্তরের শেষে আশির শুরু থেকে রাজা-প্রজা নামক রূপক শব্দের চাইতে সরাসরি নাম ব্যবহারের প্রবণতা বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে মারাত্মক আকার ধারণ করে। এতে করে ছড়ার শিল্পগুণ বিনষ্ট হচ্ছে বলে কোনো কোনো সমালোচক ধারণা পোষণ করেন। কিন্তু আমার সমর্থন ও অবস্থান আগল ভাঙা তরুণদের পক্ষেই দৃশ্যমান। সময়ের প্রয়োজনে ছড়ার ভাষা তো পাল্টাবেই। সময়ের সঙ্গে ঐতিহ্যের নবায়ন যদি আধুনিকতা হয় তাহলে ছড়ার ভাষার এই পরিবর্তনকে মেনে নিতেই হবে আমাদের।

ছড়ার ভাষার শক্তি এবং দ্যুতি উপলব্ধি করেছিলেন বলেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা কাজী নজরুল ইসলামও উৎসাহী হয়েছিলেন ছড়া রচনায়। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীপুত্র সুকুমার রায়, সুকুমারপুত্র সত্যজিৎ রায় অতঃপর অন্নদাশঙ্কর রায়- এই তিন রায়ের হাতে বাংলা ছড়া পেয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা। তবে, ছড়াকে একেবারেই অকল্পনীয় ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গেছেন সত্যজিৎ রায়। ছড়ার ভেতরকার অমোঘ শক্তিকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তিনি। ছড়ার আঙ্গিক অনুসরণ করে ছড়ার ভাষা ব্যবহার করে তিনি নির্মাণ করেছিলেন অনন্যসাধারণ চলচ্চিত্র ‘হীরক রাজার দেশে’। আমরা জানি চলচ্চিত্রের রয়েছে নিজস্ব ভাষা। সেই ভাষার সঙ্গে ছড়ার ভাষাকে যুক্ত করেছেন সত্যজিৎ রায় তাঁর অপরূপ শৈল্পিক দক্ষতায়।

ছড়ার ভাষা দ্রুত কম্যুনিকেটিভ এবং স্মৃতিবান্ধব। আর তাই টিভি বিজ্ঞাপনে এবং জিঙ্গেলেও ছড়ার ব্যবহার আমরা লক্ষ্য করি। সাহিত্যে শিল্পে একটি দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও প্রাকৃতিক চালচিত্রের প্রতিফলন ঘটে। সাহিত্যের অন্যান্য মাধ্যমের তুলনায় ছড়ায় এই প্রতিফলন অধিক স্বচ্ছ। আর সে কারণেই দেখি প্রাচীন ছড়ায় বাঁধা পড়ে আছে ইতিহাস। রচয়িতার নামটি হয়তো হারিয়ে গেছে কিন্তু টিকে আছে ছড়াটি। ধরা যাক এই ছড়াটির কথা:
‘খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো
বর্গী এলো দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেবো কিসে?
ধান ফুরালো পান ফুরালো খাজনার উপায় কী?
আর ক’টা দিন সবুর করো
রসুন বুনেছি।’

নবাব আলীবর্দী খাঁর শাসন আমলে, ১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দে বর্গী হামলার সময়ে রচিত হয়েছিল ঐতিহাসিক এই ছড়াটি। বর্গী হামলার খবরের পাশাপাশি একই সঙ্গে ছড়াটি জানিয়ে দিচ্ছে তৎকালীন সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামর্থ্য আর অসামর্থ্যরে কথাও। গরিব অসহায় হতদরিদ্র প্রজা সব খুঁইয়েছে বর্গী হামলায়। উৎপাদিত শস্র-ধান-পান সবই ফুরিয়ে একেবারেই নিঃস্ব প্রজা। কিন্তু তাতে কি? রাজা বা জমিদারকে (শাসক) খাজনা বা ট্যাক্স তো দিতেই হবে। নইলে পাইক পেয়াদা এসে ধরে নিয়ে যাবে। অমানুষিক নির্যাতন করবে। নিঃস্ব প্রজা তাই পরবর্তী শস্য উৎপন্ন হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার আকুল আবেদন জানাচ্ছে, কারণ সে রসুন বুনেছে। এই রসুন বিক্রি করে প্রাপ্ত টাকায় কিংবা সরাসরি রসুনগুলোই খাজনা হিসেবে সমর্পণ করবে সে। গরিব প্রজা খেতে পেলো কি পেলো না, উপোস দিলো কি দিলো না সেটা দেখা তো রাজা বা শাসকের কাজ নয়। তার দরকার খাজনা- কী ভয়াবহ সমাজচিত্র! এই ঘটনার প্রায় আড়াইশ বছর পরেও আমরা দেখি সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশের গরিব কৃষক অত্যাচারী রাজার নিষ্ঠুর নিপীড়নের শিকার হয়ে স্বীকার করছে, ‘বাকি রাখা খাজনা/মোটে ভালো কাজ না/ভর পেট না-ও খাই/রাজ কর দেওয়া চাই/যায় যদি যাক প্রাণ/হীরকের রাজা ভগবান।’

আধুনিক বিশ্বে অত্যাচারের ধরন পাল্টালেও শোষকের চরিত্র পাল্টায়নি। আর তাই আমরা দেখছি ছড়ার চরণ পাল্টালেও ধরন (প্রেক্ষাপট)পাল্টায়নি।

সময়ের সাক্ষী ছড়া। ক্ষদ্রায়তনের একটি ছড়ার ছোট্ট ক্যানভাসে আঁকা থাকে হাজার বছরের ইতিহাসের বিপুল বিশাল অবিনাশী চিত্র। সাত পৃষ্ঠা লিখে যা বোঝানো হয় ছড়ায় সেটা সাত লাইনেই সম্ভব। আগেই বলেছি, ছড়া ছোট কিন্তু লক্ষ্যভেদি। ছোটগল্পের ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে ‘গোস্পদে আকাশ দেখা’। ছড়ার ক্ষেত্রে ছোটগল্পের এই ক্ষমতাটির পাশাপাশি উল্টোটাও অর্থাৎ কিনা আকাশে গোস্পদের চিহ্নও অবলোকন করা সম্ভব। অর্থাৎ ছড়ার রয়েছে বহু দূর থেকে দেখা কিংবা একেবারে কাছে থেকে দেখার অদ্ভুত ক্ষমতা। ছড়ার আছে খুবই পাওয়ারফুল একটা লেন্স। যা দিয়ে ‘জুম ইন জুম আউট’ করে আপনি অতীত বর্তমান এবং কখনো কখনো ভবিষ্যৎও দৃশ্যমান করে তুলতে পারেন।

আমি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাবার পর অভিনেতা আফজাল হোসেন আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে ডান হাতের দুই আঙুলে ছোট্ট একটা স্পেস নির্দেশ করে বলেছিলেন, ‘তুমি হচ্ছো সেই খেলোয়াড় যাকে খেলতে হয় এই এতোটুকুন একটা মাঠে। এবং এইটুকুন স্পেসেই তোমাকে তোমার যাবতীয় ক্ষমতা আর দক্ষতাকে প্রকাশ করতে হয়। খেলাটা সহজ নয়। সামান্য স্পেসে বড় খেলা দেখাতে হলে মারাত্মক স্কিল্ড হতে হয়। সেই কারণেই তুমি সবার থেকে আলাদা।’

অভিনেতা আফজাল হোসেনের কথাটা আমার পছন্দ হয়েছিল। কারণ তিনি ছড়া সম্পর্কিত নিগূঢ় সত্যটিই উচ্চারণ করেছিলেন। ক্ষুদ্রায়তনে বিপুল শক্তির আধার, ছড়া। সমাজ-ইতিহাসের স্বরূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি ছোট্ট ছড়ার বিশাল জানালা দিয়ে।

কিছু ছড়া পুরোনো হয় না। কাল সে জয় করতে পারে। একটি কালজয়ী ছড়ার কথা বলি:

‘খোকন খোকন ডাক পাড়ি
খোকন গেলো কার বাড়ি?
আয় রে খোকন ঘরে আয়
দুধ মাখা ভাত কাকে খায়।’

বর্তমানের কিংবা আগামী দিনের পাঠক নাম না জানা ছড়াকারের এই ছড়াটি পাঠ করে অনায়াসেই বুঝতে পারবে যে, ছড়ায় বর্ণিত এই খোকন সে নিজে। যে মা তাকে ডাকছে, সেই মা হচ্ছে জননী জন্মভূমি। যে দুধ মাখা ভাতের কথা বলা হয়েছে, সেই দুধ মাখা ভাত হচ্ছে তার দেশের সম্পদ। যে কাকের কথা বলা হয়েছে সেই কাক হচ্ছে অপশক্তি আর অসুন্দরের প্রতীক। সেই অপশক্তি আর অসুন্দরের হাত থেকে মা-কে রক্ষা করতে, দুধমাখা ভাতগুলো রক্ষা করতে সন্তানের প্রতি মায়ের আকুল আহ্বান হচ্ছে এই ছড়া।

দেশের দুর্যোগে দুঃসময়ে যুগে যুগে ছড়াকাররা ছড়ার ভাষায় এভাবেই ডাক দিয়ে যায়। ইতিহাস সাক্ষী, ছড়াকার ডাক দিয়ে যায়। 
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়