ঢাকা     রোববার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৭ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

পা হারানোর এক যুগ: কেমন আছেন সেই লিমন 

সানজিদা জান্নাত পিংকি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৩৯, ২৩ মার্চ ২০২৩   আপডেট: ১৬:৫০, ২৩ মার্চ ২০২৩
পা হারানোর এক যুগ: কেমন আছেন সেই লিমন 

২০১১ সাল। ঝিনাইদহে ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে এক কলেজ ছাত্রের পায়ে গুলি করে র‍্যাব। পরে বেরিয়ে আসে পেছনের ঘটনা। নির্দোষ যুবকের জীবন যেন থমকে যায়। তবে তার পাশে দাঁড়ায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। তার পড়াশোনার দায়িত্ব নেয় সংস্থাটির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গণ বিশ্ববিদ্যালয়। আইন বিভাগে পড়াশোনার পর তিনি প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক হন। অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় থাকা জীবন হয়ে ওঠে আলোকিত। 

আজ ২৩ মার্চ। ১৬ বছর বয়সী সেই কিশোর লিমনের পা হারানোর ১ যুগ। অদম্য সেই লিমন হোসেনের জীবন যুদ্ধে হার না মানার গল্প জানতে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সানজিদা জান্নাত পিংকি

সকল প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে ভালো আছি 

যখন আমার দুর্দিন গেছে, চারদিকে অন্ধকার, নাকের উপরে পানি উঠে গেছে এমন পরিস্থিতিতেও আমি হাসিমুখে বলেছি ‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।’ আজও সেটাই বলবো। পড়াশোনা শেষ করে কর্মজীবনে এসে দারুণ একটা সময় পার করছি। চাকরির পর পারিবারিকভাবে বিয়ে করেছি। বিবাহিত জীবনে আমরা খুবই ভালো আছি।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র আমার কাছে আবেগের জায়গা

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র অসহায়, নিপীড়িত মানুষদের জন্য একটি আশ্রয়ের জায়গা। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে আমি আমার দ্বিতীয় একটি জীবন পেয়েছি। এখানে আমি নতুন করে হাঁটতে শিখেছি, নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শিখেছি। এই প্রতিষ্ঠান আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আমাকে পিতৃস্নেহে বড় করেছেন। সন্তানের মতো লালন-পালন করেছেন। তাদের জন্য আমি আজকের এই লিমন হোসেন হতে পেরেছি। 

হয়রানির শিকার হওয়ার দরুণ আইনে পড়ার সিদ্ধান্ত 

আমি র‍্যাবের গুলি খেয়েছি, রাষ্ট্রের কাছ থেকে হয়রানির শিকার হয়েছি। আমার মা আইনের আশ্রয়ের জন্য অনেকের দুয়ারে ঘুরেছেন। সেখান থেকেই আইন নিয়ে পড়ার ইচ্ছে জাগে। এটি এমন একটি পেশা যেখান থেকে খুব সহজেই মানুষকে সেবা করা যায়। সমাজে একটা কথার প্রচলন আছে যে, উকিলের কাছে গেলেই অনেক টাকা ঢালতে হয়। গরীব, অসহায়, নিপীড়িত, প্রতিবন্ধী মানুষকে বিনামূল্যে আইনি সহোযোগিতা করতে চাই। ভবিষ্যতে একটা ল’ ফার্ম করবো ভেবেছি। 

শিক্ষকতা এক দারুণ অভিজ্ঞতা 

স্নাতকের পর আমি নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজ বিভাগেই শিক্ষকতা করছি। এটা এক দারুণ অনুভূতি। যদিও জীবনে কখনো শিক্ষক হওয়ার ভাবনা ছিল না। তবে এই পেশায় দারুণ একটা সময় পার করছি। এই ক্যাম্পাস, এই ক্যাম্পাসের মানুষগুলোকে আমি ধারণ করতে পারি। আমার ছাত্র-ছাত্রীরা যখন আমার কাছে ভালো-মন্দ সব বিষয়ে শেয়ার করে, তখন মনে হয় আসলেই হয়তো তাদের আস্থার জায়গা হতে পেরেছি। কোথাও ঘুরতে গেলেও স্টুডেন্টদেরকে বলি, ‘তোরা যাবি নাকি? চল।’ ওরা দলবেঁধে আমার সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। এক পা হারিয়ে যেন আমি হাজারো পা পেয়েছি পথচলার জন্য। 

মানবাধিকার নিয়ে কাজ করতে চাই 

আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল, মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা। কেননা আমি খুব কাছে থেকে মানুষের নির্যাতন, নিপীড়ন দেখেছি। মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য একটা মানুষকে কতটা যুদ্ধ করতে হয় তা আমি জানি। তাই আমি মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে যেতে চাই। আমি উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছি। শিক্ষকতার পাশাপাশি দেশের মানুষের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করবো। সেজন্য নিজেকে আরো ভালো করে গড়তে হবে। আমার গাড়ি, বাড়ি করার কোনো ইচ্ছে নেই। সাধারণ মানুষ, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের হয়ে কাজ করতে চাই।

যতটা হয়রানি হয়েছি তার চেয়ে বেশি ভালোবাসা পেয়েছি

পা হারানোর বিষয়টা আমার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। যেন ঘুম থেকে উঠে দেখলাম আমার একটি পা নেই। আজও আমার মাথায় একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খায়, ‘আমার অপরাধ কি?’ যিনি আমাকে গুলি করেছিলেন তাকে আমি প্রশ্নটা করতে চাই। তবে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েও আমি অনেক মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। পা হারানোর দুঃখ ভুলে গেছি। মানুষের ভালোবাসা আমাকে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। 

আমি একটি নজির স্থাপন করতে চাই

আজ এত বছর পরও আমার মামলা প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় রয়েছে। এখনো নাকি তদন্ত চলছে। অনেকেই বলে র‍্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করে কিছু করতে পারবেন না। আমি একটা নজির রেখে যেতে চাই। আইনের চোখে সবাই সমান, আইনের উর্ধ্বে কেউ না; এই বিশ্বাসেই আমি এখনো অপেক্ষা করছি। আশা করি আমি ন্যায়বিচার পাবো। আমি রাষ্ট্রের কাছে চাচ্ছি বিচার কার্য যেন দ্রুত শুরু হয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়। 

/ফিরোজ/

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়