এ কে খন্দকারের ফিউনারেল প্যারেড অনুষ্ঠিত
প্রয়াত এয়ার ভাইস মার্শাল বীর উত্তম এ কে খন্দকারের মরদেহের কফিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ, জাতির গর্বিত কৃতী সন্তান এবং সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল বীর উত্তম আব্দুল করিম খন্দকারের (এ কে খন্দকার) ফিউনারেল প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর-আইএসপিআরের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, এ কে খন্দকার শনিবার সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর ১১ মাস ২০ দিন। তিনি দুই পুত্র, এক কন্যা ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটি বাশার প্যারেড গ্রাউন্ডে রবিবার (২১ ডিসেম্বর) তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত থেকে তার কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে তার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন।
রাষ্ট্রপতির পক্ষে সামরিক সচিব, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান ও বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত থেকে এ কে দন্দকারের মরদেহের কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে তার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন।
অনুষ্ঠানে প্রয়াত এ কে খন্দকারের পরিবারের সদস্য, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং অন্যান্য পদবির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। ফিউনারেল প্যারেড শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকে বিমান বাহিনী ঘাঁটি বাশারে শাহীন কবরস্থানে দাফন করা হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধার সম্মানার্থে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ফ্লাই পাস্ট অনুষ্ঠিত হয়।
এ কে খন্দকার ১ জানুয়ারি ১৯৩০ সালে পাবনার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম খন্দকার আব্দুল লতিফ এবং মাতার নাম আরেফা খাতুন। তিনি মালদা জেলা স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন, রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং পিএএফ কলেজ, রিসালপুর থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ৫ জানুয়ারি ১৯৫১ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনী একাডেমিতে যোগদান করেন এবং ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫২ সালে জিডি (পি) শাখায় কমিশন লাভ করেন।
এ কে খন্দকার ছিলেন একজন চৌকস ফাইটার পাইলট। বিমান বাহিনীতে চাকুরিকালীন তিনি এল-১৯, টি-৬জি, টেমপেস্ট, ফিউরি, টি-৩৩, এফ-৫ ও এফ-৮৬ বিমানে সফলতার সঙ্গে ৩৪০০ ঘণ্টারও বেশি সময় উড্ডয়ন পরিচালনা করেন। চাকরিকালীন তিনি দেশ-বিদেশে বিভিন্ন কোর্সে অংশগ্রহণ করেন এবং সফলতার সঙ্গে তা সম্পন্ন করেন। তিনি জেট ইন্সট্রুমেন্ট রেটিং কোর্স, ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টরস কোর্স এবং এয়ার স্টাফ কোর্স অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করেন।
এ কে খন্দকার ১৯৭১ সালে ঢাকাস্থ পাকিস্তান বিমান বাহিনী ঘাঁটিতে সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে নিযুক্ত থাকাকালীন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি তার অধীনস্ত সাতজন বাঙালি কর্মকর্তা এবং কিছু সংখ্যক বিমানসেনা নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ১২ মে ১৯৭১ সালে ঢাকা থেকে ত্রিপুরার উদ্দেশে রওয়ানা হন এবং ১৫ মে ১৯৭১ তারিখে ত্রিপুরার মতিন নগরে পৌঁছান। তৎকালীন মুজিবনগর সরকার তাকে মুক্তিবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ পদে নিযুক্ত করেন। তিনি মুক্তিবাহিনীর অপারেশন্স এবং প্রশিক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এ দায়িত্ব পালনে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক অবস্থা ব্যক্তিগতভাবে পর্যবেক্ষণ এবং নিরীক্ষণ করতেন, যা মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী ও উদ্যমী ভূমিকা রাখতে সহায়তা করে। এ সময় তিনি ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে প্রথম বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠন করেন। তিনি মাত্র ৯ জন কর্মকর্তা, ৫৭ জন বিমানসেনা এবং ৩ টি বিমান নিয়ে গঠিত এই বাহিনী নিয়ে ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অভিযান পরিচালনা করেন।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিনিধি করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের উপ-অধিনায়ক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার জন্য তিনি ১৯৭২ সালে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত হন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এ কে খন্দকার। তিনি স্বাধীনতা উত্তর মাত্র দুই বছরের মধ্যে ১টি ফাইটার স্কোয়াড্রন, ১টি হেলিকপ্টার স্কোয়াড্রন এবং ২টি র্যাডার ইউনিট এই বাহিনীতে সংযোজন করতে সফলতা অর্জন করেন। তিনি বিমান বাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি জাতীয় পতাকাবাহী বাংলাদেশ বিমানের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে ১৯৭২-১৯৭৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকালে এই সংস্থাটিকে সুসংহত করার প্রয়াস পান। তিনি ১৫ অক্টোবর ১৯৭৫ তারিখে দীর্ঘ ২৩ বছর ১৯ দিন কমিশন চাকরি সমাপনান্তে বিমান বাহিনী প্রধান হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
অবসরের পর এ কে খন্দকার ১৯৭৬-১৯৮২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় এবং ১৯৮২-১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সালে রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা ও পরবর্তীতে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় মুক্তি বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হিসেবে তার অসামান্য অবদান, স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে একটি সুসংগঠিত ও কার্যকরী বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা এবং সর্বোপরি স্বাধীনতা পরবর্তীকাল থেকে অদ্যাবধি দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে দেশ গঠনে অক্লান্ত পরিশ্রমের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১১ সালে তাকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ক্ষণজন্মা এই সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান এর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ গত ১০ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে তার নামে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘাঁটির নামকরণ করা হয়েছে।
ঢাকা/রাসেল