ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘নগ্ন আগন্তুক’ নিভৃত পাঠের চয়নে

প্রিয়দর্শী চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৪৯, ৬ মে ২০২৩   আপডেট: ১৭:৫৪, ৬ মে ২০২৩
‘নগ্ন আগন্তুক’ নিভৃত পাঠের চয়নে

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে প্রান্তিক জীবনের আখ্যান-নির্মাণের ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের। বৌদ্ধিক বলয়ে অভিজাত দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তার কণামাত্র ছায়া ফেলে না সমাজের নিম্নবর্গীয় যে স্তরে, সেই সব দৈনন্দিন যাপন-বৃত্তান্ত আলোয় তুলে আনায় নিরন্তর প্রয়াস নাগরিক কাহিনিকল্পের সমান্তরাল এই সাহিত্যিক ধারার। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী থেকে শুরু করে দুই বাংলার বেশ কয়েকজন কথাসহিত্যিক এমন পথে হেঁটেছেন বারবার, গত শতকের দ্বিতীয়ার্ধজুড়ে। বাংলাদেশের মঞ্জু সরকার তেমন গন্তব্যের পর্যটনেই উন্মুখ এক পরিশ্রমী অক্ষরকর্মী।

পূর্ব বাংলার উত্তরাংশে রংপুরে দারিদ্র্যপীড়িত যে অঞ্চলে পাঁচের দশকের শুরুতে এই সাহিত্যিকের জন্ম, দীর্ঘদিন তা রাষ্ট্রীয় উন্নয়নপ্রকল্পের আওতার বাইরেই ছিল। ফলে বেড়ে ওঠার পরিপার্শ্বের সামাজিক বা অর্থনৈতিকভাবে ব্রাত্য জনপদের বরোমাস দুর্দশা-সংঘাত-যুঝে চলার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় জারিত তাঁর অন্তরঙ্গ সৃজনমানস। প্রথম জীবেনই তাই প্রান্তিক গ্রামীণ জীবনকেন্দ্রিক গল্প লিখে বুদ্ধিজীবী মহলের নজর কেড়েছিলেন, মুখ্যত জীবনবোধ এবং সামাজিক বাস্তবতার বহুমুখী স্তরের বিশ্বস্ত প্রতিবেদনে। এমনকী, যখন পরবর্তী জীবেন তিনি রাজধানী শহর ঢাকায় স্থিত হলেন, মঞ্জু সরকার তাঁর স্বভাবজাত অভ্যাস থেকে বিচ্যুত হতে পরেননি। নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত নাগিরক যাপন, দুর্নীতি-অপশাসন-দাঙ্গা- নিচুতলার যাবতীয় অন্ধকারটুকু ছেঁচে তুলে আনায় তিনি স্থির লক্ষ্যে আসীন নিরন্তর, তাঁর বিবিধ ছোটগল্প ও উপন্যাসে।

মঞ্জু সরকার লিখেছেন অসংখ্য গল্প এবং উপন্যাস। পেয়েছন বাংলা একাডেমির সর্বোচ্চ সাহিত্যসম্মানসহ আরও নানা পুরস্কার। সম্প্রতি হাতে পেলাম তাঁর উপন্যাস ‘নগ্ন আগন্তুক’। যদিও তা ‘বাংলাপ্রকাশ’-এর মাধ্যমে ২০২০ সালে প্রকাশিত পরমার্জিত সংস্করণ, তবে ইন্টারনেটের দৌলতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এই আখ্যানের প্রথম প্রকাশ প্রায় তিন দশক আগেই; ১৯৮৬ সালে। যাই হোক, নিবিড়পাঠে কতদূর উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভব পাঠক হিসেবে, নিজের অর্জিত বোধে সেটুকু যাচাই করে নেয়ার আগ্রহেই এই পাঠ-প্রতিক্রিয়া।

উপন্যাসের সূচনা প্রায় সিনেম্যাটিক। তিস্তার বাঁকে কোনো এক সকালে ফুঁড়ে ওঠা রহমতের চর, যা সময় আর নদীর স্রোতের পলিতে ক্রমশ মজে ওঠা আস্ত এক জমজমাট গ্রাম। সেইখানে ভোরবেলা অকস্মাৎ অজানা এক আগন্তুকের আগমন-  উলঙ্গ, ভাবেলশহীন, পাথুরে নির্বাক। বিদ্যুৎগতিতে খবর ছড়িয়ে পড়ায় নারী-পুরুষ নির্বিশেষ জটলা তৈরি হচ্ছে অদম্য কৌতূহলে- কোন মতলেব এই আদিম পুরুষের ছোট্ট এই জনপদে আবির্ভাব? জলে ঘেরা বিচ্ছিন্ন এ তল্লাটে রাতবিরাতে কোন পথেই বা! আপাত গতানুগতিক কৃষিনর্ভর গ্রামীণ দৈনন্দিনে হঠাৎ যেন নড়চড়ে ওঠার তরঙ্গ, যেখানে আগ্রহ আর ভয় সমানুপাতিক মাত্রায় সক্রিয় কায়ক্লেশে বেঁচেবর্তে থাকা অভাজন বৃত্তে।

ভয়ের ঘাম ক্রমশ থিতু হয়ে গড়ায় বিশ্বাসে- অচেনা পুরুষ কি তবে তাদের সুদিনের কেউ বার্তাবাহক? গ্রামের ইমাম করিম মোল্লার বাড়িতেই তেনাকে প্রথম দেখতে পাওয়ার খবর সংশয়ের বরফগুলো ভাঙতে থকে দৈব আশীর্বাদের খোয়াবে। আর পূণ্য লাভের আকাঙ্ক্ষায় গরিব-গুব্বো-মাতবরে ভেদাভেদ নেই। ধনেমানে, খেতখামারের ন্যায্য-অন্যায্য মালিকানায় গাঁয়ের প্রায়-জমিদার বিশা মন্ডল তাই ‘ন্যাংটা দরবেশ’কে হাইজ্যাক করে নিয়ে তোলে নিজের বাড়িতে, অবস্থাপন্ন গৃহে তার যথোপযুক্ত দেখভালের বাহানায়। ‘বাবা’র কিঞ্চিত অযতেœও যেন রহমতের চওে যেন ঐশ্বরিক কোপ না নেমে আসে। একমাত্র ব্যতিক্রম দিনরাত প্রাণপাত পরিশ্রমে ভাগ্য-শাসনে বিশ্বাসী হানিফ পালোয়ান, একমাত্র সেই সন্ধিগ্ধ আগন্তুকের এই পাগলাটে অবয়বে কোনও অলৌকিক ভরসায়। 

এদিকে ভোরবলায় এই অদ্ভুত নগ্ন পুরুষের আবির্ভাবের প্রথম সাক্ষী, ইমামের ‘ভাতারখাকী ডাইনী’ কন্যা অপরূপা সালমা। তাকে ঘিরেও আরেক জটলা ছেলেদর ভিড়ে পেছনের সারিতে পড়ে যাওয়া মেয়েদের। 

এভাবেই এগোতে থাকে গল্প, বা চরিত্রদের বাহ্যিক ও মানস গতিপ্রকৃতি। আগেই বলেছি, উপন্যাসের শুরু খানিকটা সিনেম্যাটিক। আর তেমন উপকরণ আরো- বর্তমানের তুমুল চিত্তচাঞ্চল্যের বিবৃতির মাঝে ঔপন্যাসিক সুকৌশলে গুঁজে দিয়েছেন প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের স্থিতি-অস্থিতির ফেলে আসা পরিপ্রেক্ষিত। অনেকটা চলচ্চিত্রের পরিভাষায় যা ‘মেমোরি কাট’, খানিক তেমনই। করিম-বিশা-সালমা-হািনফ একে একে প্রত্যেকেই পাঠকের সামনে উন্মুক্ত হয়ে উঠতে থাকে। পাশাপাশি ঘিরে আসে পারিপাশির্^ক বলয়ও- কৃষিনির্ভর গ্রাম্য বিবাদ-বিসংবাদে, সাংসারিক টানাপোড়েন, অথবা লোকলজ্জার তোয়াক্কা না-করা নারীমাংসের অদমিত আকর্ষণে। আদুড় দরবেশ অবলোকনে প্রত্যক্ষ অস্বস্তির বিপ্রতীপ সমান্তরালে, মন্দ-ভালোর মিশেলে প্রহরবৃত্তের অনিবার্য নগ্নতায়। 

এবং এরপর এসে মেশে নিয়তি-নির্ভর দারিদ্র্যে ছোঁয়াচে রোগের মতো বেড়ে ওঠা সম্ভাব্য দৈব আশীর্বাদের জনশ্রুতি। নগ্ন আগন্তুক আসলে আল্লাহর প্রতিনিধি কোনো বুজরগ আউলিয়া, এসেছেন প্রকৃতির রোষ কিংবা কষ্টার্জিত গ্রাসাচ্ছদনে নিত্যপীড়িত আটকপালে এই রহমতের চরে, গুব্বো মানুষগুলোর জন্য কোনো এক রহস্যময় স্বেচ্ছাপ্রণোদিত অনুকম্পায়। তার আবির্ভাবের দিনটিতেই করিম মোল্লার গোয়ালে দশ মাসের পোয়াতি গাভীর নাদুস-নুদুস বাছুর প্রসব যুক্তিবুদ্ধিরহিত তেমন বিশ্বাসের ইন্ধনের আগুন জ্বালিয়েছিল, ক্রমশ তার ধোঁয়া গাঢ় হয়ে গুজবের পাহাড় জমে। ওই উলঙ্গ ভবঘুরের ঐশ্বরিক সত্তা জোরদার করে তোলা যেন চরের মানুষগুলোর পরম কর্তব্য, যেন পাথুরে বাস্তবের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে নিজের সঙ্কীর্ণ বলয়ে একলাফে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন! জবরদস্তি বানানো গুজব শেষমেশ বিফলেও যায় না।

বিদ্যুৎগতিতে রাষ্ট্র হয়ে যায় আশপাশের গঞ্জে-গ্রামে, হাটেবাজরের গুঞ্জনে, বিশ্রামালাপের অবসরে। এমনকী, ‘দোয়া’ বা ‘পানিপড়া’র প্রাপ্তিযোগের লোভ সঞ্চারিত হয় তৃণমূল স্বার্থ ছাপিয়ে ইউনিয়ন বোর্ডের কর্তাব্যক্তি বা এমপি নির্বাচেন ভোটপ্রার্থীর মতো প্রভাবশালীদের মধ্যেও। দরেবেশের ভাবেলশহীন প্রস্রাবও যখন এক ফোঁটা পবিত্র সুগন্ধী। সমাজবিজ্ঞানীর বীক্ষণে যা পিছিয়ে থাকা কোনও জনপদের আপাদমস্তক অন্ধকারের সূচক, তেমনই সুচারু সৃজন ঔপন্যাসিকের তরফে। প্রগতিশীল নজরের বাইরে থেকে যাওয়া আমাদরই দুর্গম প্রচ্ছন্ন স্বদেশ। চোখ ধাঁধানো নাগরিক প্রগতির বোধগম্যতায় যার লেশমাত্র প্রবেশাধিকার নেহাতই অলীক।

উপন্যাসের মাঝামাঝি এসে পাঠকের মনোযোগ এই রহস্যাবৃত দরবেশকে জড়িয়ে গাঁয়ের যাবতীয় উদ্দীপনা পাগলামো থেকে সরে এসে ক্রমশ কেন্দ্রীভূত হয় হানিফ পালোয়ানের জাগতিক অথবা মানসিক রন্ধ্রে। অশিক্ষা-কুসংস্কারে জর্জরিত এক গ্রাম্য-বলয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠে মজে ওঠা বিশ্বাসের পাচিলে বেয়াদপ হাতুড়ির ঘা মারতে মারতে সেই-ই যেন ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতরানো নিঃসঙ্গ, অথচ জেদের তেজে বলীয়ান এক মূর্তিমান প্রতিবাদ। যদিও নাস্তিক সে কোনোমতেই নয়, কিন্তু কোনও সুলুক সন্ধান ছাড়াই ‘নগ্ন আগন্তুক’-এর ওপর চাপিয়ে দেওয়া অলৌকিক আউলিয়া বিভূষণের সে বিরোধী, এবং কায়েমি শ্রেণীস্বার্থে এই গুজব-বুজরুকির ব্যবহার তাকে আরও ক্রুদ্ধ করে তোলে। বিশা মন্ডলের সঙ্গে জমিজমা নিয়ে দীর্ঘকালীন বিবাদ, করিম মোল্লার বিধবা কন্যা সালমাকে নিয়ে অন্তরে জিইয়ে থাকা কিছু স্বপ্ন আকাক্সক্ষা, এদিকে চরম অভাবের সংসারে স্ত্রী-পুত্র-মা আশ্রিতদের জোয়াল টেনে চলা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সংশয়- কোনও পরিস্থিতিই নিরক্ষর গোঁয়ার হানিফের মধ্যে নিয়তি-নিয়ন্ত্রক ‘বাবা’র প্রতি কণামাত্র আস্থা জাগাতে পারে না। লড়ে চলে নিরন্তর, ক্রোধে-আবেগে নিজেই নিজের ভাগ্যবিধাতা হিসাবে। শিক্ষিত আধুনিক সমাজের  চোখে ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা’র যেমনতেরা তাত্ত্বিক অবয়ব, মেঠো জীবনের কর্দমাক্ত আলপথে বারে বারে ঠোক্কর  খেয়েও এগিয়ে চলার এই প্রত্যয় যেন তারই অনুরূপ কোনও ইঙ্গিত!

যদিও শেষমেশ রোগেভোগে সন্তানের অকালমৃত্যুতে মুহ্যমান বাপ হানিফই যখন পাড়া-প্রতিবেশীদের বিবেচনায় অভিযুক্ত হয় তার অবিশ্বাসের পরিণামে অনিবার্য এই চরম খেসারতে, তালগোল পাকানো ঘোরের বশে সেও গিয়ে উপস্থিত হয় জনশ্রুতিতে গজিয়ে ওঠা পীরের দরগায়। ক্ষমা চাইতে নয়, অবোধ শিশুর ওপর কোন পাপের কোপ- জবাবদিহি চাইতে। কেনই-বা বিশা মন্ডলের মতো কুচক্রী দৈব আশীর্বাদে ফুলেফেঁপে ওঠে, আর তার মতো অভাগার কপাল পুড়তেই থাকে আরও, আল্লার অনৈতিক বিবেচনায়? গোটা উপন্যাস ক্লাইমেক্সে ওঠে জোৎস্নায় আগন্তুক, হানিফ আর মধ্যিখানের চাঁদমারি সালমাকে ঘিরে। ক্ষণিক নিবেদন ভুলে ফিরে আসে ‘পরাক্রান্ত প্রতিদ্বন্দ্বী অদৃশ্য নিয়িত’র বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ক্রোধ। সন্ধিগ্ধ পালোয়ানের দৈহিক বলের কাছে পরাভূত এবার স্বয়ং ঈশ্বর-প্রতিনিধি। দূরে মসজিদ থেকে ভেসে আসা সম্মিলিত জিকির ধ্বনি ‘লাইলাহা ইল্লালাহু’র ব্যাকড্রপ, আর তিস্তার জলে বিসর্জন খোদাতায়ালার নামে বানিয়াবৃত্তির বিগ্রহের। আবারও চলচ্চিত্রের ক্যামেরার ফ্রেমে ধরা পড়ার মতো বড় উপেযাগী দৃশপট, শিল্প অথবা সত্য- দু’য়েরই জবরদস্ত আঙ্গিকধর্মে।

উপন্যাস হয়েতা শেষ হয়ে যেতে পারত এই পর্বেই। সে সম্ভাবনাও ছিল। কিন্তু মঞ্জু সরকার পাঠককে নাটকীয় মোড়ে এনে দায় ঝেড়ে ফেলতে  রাজি নন। দিনদুনিয়া যতটা আঁকাবাঁকা লৌহসম, তাকে সরল সোজা করার মতো সার্বলৌকিক কামারের নির্ধারক শক্তি কি হানিফ পালোয়ানের বল্গাচ্যুত বন্য বাহুতে? ব্যক্তিগতভাবে আমি মৃণাল সেনের ছবির ভক্ত। অনুরাগ, কারণ পরিচালক হিসাবে মৃণালবাবু কখনোই তাঁর সিনেমার দর্শকদের স্থিত হতে দেননি অন্তিম কোনো স্বস্তিতে। মঞ্জু বাবুও তাঁর এই উপন্যাসে তেমন সড়ক ধরেই সমাপ্তি পর্যন্ত এগিয়েছেন। শেষ পৃষ্ঠা পড়ে বই গুটিয়ে নেয়ার মুহূর্তেও যেন পাঠক চরম অস্বস্তিতে ভুগতেই থাকেন। পান না কোনো মীমাংসিত সমাধান।

আসলে ভালোমন্দ সবই হয়তো মিশে যায় জনমানসের আবহমান বিশ্বাসে- ‘আল্লার কী কুদরত’! গ্রামের ঘাড়ে চেপে বসা ‘মহামানব’ দরবেশকে হত্যাার ছিল না কোনও সাক্ষী, একমাত্র সালমা ছাড়া। যে আবার ক্রমশ কাঠিন্য ভেঙে ততদিনে হানিফের প্রতি নির্ভর। তাই সন্দেহের কেন্দ্রে থেকেও সহজেই হানিফ পার পেয়ে যায় অভিযোগ থেকে। দৈব বিধিনির্বন্ধে একদিকে যেমন ভরসা খুঁজে পায় অঘটনের সম্ভাব্য কারণ প্রসঙ্গে খুঁজে পায় গ্রামবাসীদের আন্দাজ, বিশা মন্ডলের হুঙ্কার-ধমকও আর পায় না কোনও খেই। তেমনি হয়তো-বা ফেনিয়ে ওঠা অলৌকিকের জাল ছিড়ে বিশ্শবাসের মর্যাদাটুকু শেষমেশ বাঁচানোয় হানিফও খোদাতায়ালার তৎকালীন আশীর্বাদে অন্তত বিচ্যুত হয় না। যদিও সেই মৃত্যুর নবমাত্রায় ‘মহিমান্বিত উত্থান’ তাকে পীড়িত করে। সে যাই হোক। এই পর্যন্ত পাঠকের তরফে নিশ্চিতই কিছুটা স্বস্তি। কিন্তু আবারও মোচড় ফিরে আসে উপন্যাসের শেষাংশে। অতিমানব নয় হানিফ। দোষে-গুণে, জৈবিক আকাঙ্ক্ষা-কল্পনায় সেও গোটাগুটি গড়পড়তাই। যেটুকু জমিজমা, তাও বেচে সালমার সঙ্গে দূরে কোথাও সংসার গড়ার পরিকল্পনা করে। আবার হাতে কিছু টাকা পেয়ে পিছুটান-  আসন্ন প্রসবা বউ খোদেজা বা সংসারের সার্বিক স্বার্থে কতটুকু অর্থ বরাদ্দ রাখা যায় একটি নতুন গরু কেনায়। নেহাতই মানবিক টানাপোড়েন। আর অন্যমনস্ক ফাঁকটুকুর সুযোগে মধ্যরাতের অন্ধকার গলে ঢুকে পড়ে কায়েমী স্বাার্থান্বেষী দুবৃত্ত। 

প্রতিরোধে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর আগেই কণ্ঠনালি বিদ্ধ হয় তমসাবৃত আরও এক আগন্তুকের অতর্কিত ছুরিকাঘাতে। যদিও সকালে লাশ  বেমালুম গায়েব! আগন্তুকের রকমফের- কখনও ঐশ্বরিক, কখনওবা হত্যাকারীর ছদ্ম আড়ালে। অচেনা অথবা সম্ভাব্য চেনা- দুয়েরই নগ্ন প্রকট আগ্রাসী বৈভবে। ভাটিয়াপাড়ায় হানিফের প্রতিবেশী-পরিজন যদিও দ্বিতীয় এই দুর্ঘটনায় অঙ্গুলিহেলনের উৎসটুকু উপলব্ধিতে সহমত, তবুও একমাত্র মনসুরের মরিয়া বিদ্রোহের মুখেও সবাই কুণ্ঠিত মূক, প্রশাসনের দখল নেওয়া ক্ষমতাবানের আধিপত্যের সামনে নিরুপায় সমর্পণে। নিরীহ মনসুরই বিশা মন্ডলের কুযুক্তির জালে পুলিশের চোখে বনে যায় অপরাধী। মিনিটখানেকের তদন্ত বিধিকর্ম সেরে সদলবলে দারোগা রওনা দেয় ‘ল্যাংটা বাবার মাজার’-এর উদ্দেশে। বেয়াদপির যাবতীয় কাঁটা নিকেশে উচ্ছ্বাসের প্রাবল্যে বিশার দর্পিত অভিলাষ- ‘বাবার কুলখানিতে’ এবার হাজারে হাজারে দর্শনাথীর ঢল নামবে। রহমতের চরের আশমান-জমিন জুড়ে বইবে পুণ্যাত্মার মহিমামাখা সুদিনের সৌরভ। ভাটিয়াপাড়ার বেকুব-নাচার-ইতরের জটলা নাগাল পায় না আতান্তরের এই খেলায় প্যাঁচ-পয়জারের বাস্তবিক হালহদিশ। যদিও চাপা ক্রোধ আর উত্তেজনায় আনচানটুকু জিইয়েই থাকে প্রতিকারের স্পৃহায়, সম্মিলিত নিরুপায় মননে। 

এমনতরো অন্তিম সূচকের মধ্যখানে পড়ে পাঠক সংকটাপন্ন বোধ করেন। ধর্মের বাহানায় অধর্মের উড্ডীন ধ্বজার সুরাহা ব্যতিরেকে এই যে নিরন্তর সময়বৃত্তে অবগাহন, সে তো ইতিহাসেরই চরম নিয়তি। তবুও কোথাও হয়তো মানবসভ্যতায় ভরসার রেশও সমমাত্রায় চিরঞ্জীব, তলানিতে মজে থাকা উপলব্ধির চোরা স্রোতে, কিম্বা অসম্ভবের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের কোনও এক স্বপ্ন নির্ঝরে। মঞ্জু সরকার নিশ্চিতই সফল এই ঘুর্ণাবর্তটুকুর উন্মোচনে, অন্তত আমার মতো পাঠকের জন্য, যার বা যাদের গ্রামীণ কৃষিজীবন নেহাতই ধরাছোঁয়ার বাইের কুয়াশাবৃত, নাগিরক ঔজ্জ্বল্যের নিচে গুটিয়ে থাকা আবহমান সংখ্যাগরিষ্ঠের বিস্তৃতি। তিস্তা নদীর ঢেউয়ের মতোই যার ওঠানামা, বালুভূমি থেকে পলিমাটির উত্থান, যদিও অর্থবহ কর্ষণে জোয়াল টেনে চলা ভ্রান্তি- এমন মানবজমিন রইল পতিত/ আবাদ করলে ফলত সোনা.../ মন রে কৃষিকাজ জানো না...। 

নদীমাতৃক এই বাংলাদেশ। নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জনপদের আখ্যানও বঙ্গসাহিত্যের অন্যতম এক নির্মাণ-ক্ষেত্র, যেখানে স্রোতেই ভেসে বেঁচে থাকার আকুতি, আবার পাড় ভেঙে তলিয়ে যাওয়ারও নির্মম ভবিতব্য- যাবতীয় আবর্তেই কৃষিনর্ভর দৈনন্দিনের গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত। তাই প্রান্তিক জীবন সম্পর্কে উন্মুখ বহু আখ্যানকার তাদের সৃজনে বারে বারেই ফিরেছেন কূল বরাবর নিত্য-বহতা বিবিধ আঞ্চলিক প্রাণস্পন্দনে। একের পর এক তৈরিও হয়েছে কালজয়ী উপন্যাস। অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হাঁসুলী বাঁকের  উপকথা’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’, কিম্বা হুমায়ূন কবীরের ‘নদী ও নারী’, শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সরেং বৗ’, আবু ইসহাকের ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ বা আরও সাম্প্রতিক দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ ও আরও অন্যান্য। তুলনায় কলেবরে স্বল্পায়তন মঞ্জু সরকারের এই উপন্যাস ‘নগ্ন আগন্তুক’ দীর্ঘ সেই তালিকায় সংশয়াতীতভাবেই অন্তর্ভক্তু হওয়ার দাবিদার।

মঞ্জু সরকারের লেখা শুধুই গবেষণাধর্মী নয়, আত্ম-অভিজ্ঞতায় বলীয়ান। পলি-ঊর্বর মানব জমিনের কর্দমাক্ত আলপথে পিছলে পড়ার সমুদয় ইঙ্গিতুগুলো যার আয়ত্তাধীন সহজ সরল ভাষ্যে। আর সম্পূর্ণ উপন্যাস পড়ে ওঠার পর, ব্যক্তিগতভাবে অন্তত আমার চেতনায়, কেন্দ্রীভূত হয়ে আসে এমন কাল্পনিক প্লট নির্মাণের মূখ্য অভিপ্রায়ের সারবত্তাটুকু। 

নগ্ন আগন্তুক, মঞ্জু সরকার, প্রথম প্রকাশ: মুক্তধারা ১৯৮৬, বাংলাপ্রকাশ সংস্করণ:২০২০, মূল্য: ২০০ টাকা

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়