ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

আম্ফানের ৩ বছর: কার্তিকের কান্নার আওয়াজ পৌঁছেনি উপর মহলে 

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০০, ২০ মে ২০২৩   আপডেট: ১৫:৫৩, ২৫ মে ২০২৩
আম্ফানের ৩ বছর: কার্তিকের কান্নার আওয়াজ পৌঁছেনি উপর মহলে 

আম্ফানের স্মৃতি। দীর্ঘদিন লবণ পানির সঙ্গে বসবাসের পরে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ পানিতে দাঁড়িয়ে মানববন্ধন করে

কপোতাক্ষ পাড়ের ছায়া সুনিবিড় হাজতখালী গ্রাম। দিনমজুর বাবার সারাজীবনের জমানো অর্থ আর নিজের শ্রমে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ছোট্ট দালান বাড়ি। মাত্র একমাস ঘরে বসবাস করতে পেরেছেন। গুছিয়ে নিয়েছিলেন সব। বুড়ো বাবা-মা, বউ, ছেলেপুলে সবাই একসঙ্গে ছিল। কিন্তু কে জানত, কোনো এক ভয়াল রাত বাড়িটির সেই উচ্ছ্বলতা কেড়ে নেবে! যা ছিল কারো কল্পনার বাইরে, সেই ঘটনাই ঘটেছিল ২০২০ সালের ২০ মে রাতে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রলয়ে প্রবল স্রোতে ভেসে গেল সব। বাঁধ ভাঙা পানির স্রোত হাজতখালীর খালে ভাঙন বাড়িয়ে তোলে। সেই ভাঙন দিয়ে প্রবেশ করে আম্ফানের স্রোত। স্রোতের তোড়ে ভেসে যায় কার্তিকের বাড়ি। 

আম্ফানের প্রলয় কার্তিককে পথে বসিয়েছে। তিন বছরে বহু স্থানে ধর্ণা দিয়েছে, পুনর্বাসন সহায়তা মেলেনি। সেই ভয়াল রাতের পর থেকে তার পরিবারের ঠাঁই হয় বেড়িবাঁধের উপরে। সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল হাজতখালী গ্রাম এবং আশপাশের অন্যান্য এলাকার বাসিন্দারা। নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী অনেক পরিবার বাড়ি ফিরেছে, অনেকে অন্যত্র চলে গেছে। কিন্তু কার্তিক এবং তার মা উষা রানীসহ কয়েকটি পরিবার এখনো বেড়িবাঁধে বাস করছেন।

গতকাল (১৯ মে) কথা বলতে গিয়ে আবারো কাঁদছিলেন কার্তিক। ঠিক একইভাবে নিঃস্ব এই মানুষটি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ব্যাপক ক্ষতির মুখোমুখি হওয়ার পর। তখন খবরের শিরোনাম হয়েছিল: ‘কার্তিকের কান্নার আওয়াজ কতদূর পৌঁছাবে?’। ঠিক তিন বছর পরে তার কথা থেকে অনুমান করা গেল- সেদিনের সেই কান্নার আওয়াজ পৌঁছেনি উপর মহলে। তিন বছরে পুনর্বাসন সহায়তা পাননি কার্তিক।     

পুরো নাম কার্তিক মন্ডল। বাবা খোকন মন্ডল। বাড়ি খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের কপোতাক্ষ পাড়ের হাজতখালী গ্রামে। কার্তিক এখন নিঃস্ব। আম্ফানের পরে শহুরে লোকজন দেখে আর ক্যামেরা ফ্ল্যাশ লাইটের আলোর ঝলকানি কার্তিকের কান্না আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। সেদিন কাঁদছিলেন তার মা উষা রানী, বউ সুষমা রানী। আজো থামেনি তাদের কান্না। বাঁধের ওপরে ঝুপড়ি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বারবার হাত তুলে দেখাচ্ছিলেন ভেসে যাওয়া বাড়ির স্থান। কার্তিক শ্রমিকের কাজে ছিলেন খুলনায়। অস্থায়ী চাকরি হলেও মাসিক রোজগার ছিল তার। ঘূর্ণিঝড়ের সিগন্যাল পেয়ে বাড়ি চলে এসেছিলেন। কিন্তু এলে কী হবে? শেষ রক্ষা হয়নি। যেখানে হাজতখালী গ্রামটাই নেই, সেখানে কার্তিকের ঘর থাকে কী করে! তার পাঁচ ছেলেমেয়ে- দেব, অরুণ, পুজা, আশা, সুপ্রিয়া। পাশে দাঁড়িয়েছিল সুষমা মন্ডল। কষ্টে বড়দের চোখ ভিজে যায়। ছোটদের চোখ না ভিজলেও ওদের বুকেও হয়তো বইছে হৃদয়ভাঙা হাহাকার। কেননা, এই প্রাকৃতিক বিপদে বড়দের সঙ্গে ছোটরাও কম ভুগছে না!

আম্ফানের আঘাতে দুর্বল বেড়িবাঁধ ধ্বসে ঢুকেছিল পানি। স্থানীয় বাসিন্দারা বিকল্প বাঁধ দিয়েছেন নিজেদের অর্থায়নে। শ্যামনগরের বন্যতলী গ্রাম

কার্তিক একা নন, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রলয়ে গোটা হাজতখালী গ্রামটাই উঠে এসেছিল বেড়িবাঁধের ওপরে। কোথাও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। যে যেখানে সুযোগ পেয়েছে ঘর বানিয়ে বসতি গড়েছিল। কোথায় খাবার পানি, কোথায় টয়লেট, কোথায় রান্না কিংবা থাকার জায়গা, কোথায় গরু-ছাগল রাখার জায়গা- সবকিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। সেটা কী বাস্তবে ছিল; নাকি স্বপ্নে! মিলাতে পারছিলেন না সব হারানো মানুষগুলো। কয়রার হাজতখালী স্লুইজগেট থেকে কাশির হাটেখোলা অবধি মাত্র আধা কিলোমিটার বাঁধ ভাঙন থেকে রক্ষা পেয়েছিল ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের আঘাত থেকে। সেখানেই ঠাঁই হয়েছিল এই পরিবারগুলোর। 

কয়রার কাটমারচর, কাশির খেয়াঘাট, গোবরা এলাকার আরো কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রলয়ে সব হারানোর পরেও তারা পুনর্বাসন সহায়তা পায়নি। কাটমারচরের মোশাররফ হোসেন সরদার বলেন, ‘আম্ফানে সব হারিয়েছি। বাড়ি হারিয়েছি, চিংড়ির খামার হারিয়েছি, কৃষি জমি হারিয়েছি। তিন বছর ধরে বেড়িবাঁধের ধারে বাস করছি। বাড়ির ঘর ঠিক করতে অনেক টাকা প্রয়োজন। কিন্তু কোথায় পাবো সে টাকা? জীবনের গতি ফিরিয়ে আনতে ইতিমধ্যে প্রায় দুই লাখ টাকা ঋণ নিয়েছি। প্র্রাকৃতিক বিপদ আমার দেনার বোঝা বাড়িয়ে দিয়েছে।’  

‘টিকে থাকার লড়াই করছি’

ঘূর্ণিঝড় আম্ফান সবচেয়ে বড় ধাক্কা দিয়েছিল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে। খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি, বাগেরহাটের মংলা, রামপাল এলাকাগুলো সবচেয়ে ক্ষতির মুখে পড়েছিল। ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলার পরে বড় আঘাত পড়েছে ওই অঞ্চলে। ঘূর্ণিঝড় আইলা যে ক্ষত রেখে গিয়েছিল, সেই ক্ষত আরো স্পষ্ট করে দিয়েছে আম্ফান। আম্ফান যখন আঘাত করেছিল তখন ছিল করোনা মহামারী। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চাকরিজীবী মানুষেরা এলাকায় ফিরে গিয়েছিল করোনার কারণে। এটি ব্যতিক্রম। আরেকটি ব্যতিক্রম হলো, আম্ফানের পর অনেক এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় বহু মানুষ প্রায় দশ মাস জোয়ারের লবণ পানির সঙ্গে বাস করেছে। মাসের পর মাস তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে বাস করতে হয়েছে। ফলে আম্ফানের একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়েছে মানুষের জীবন-জীবিকায়। 

সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষ প্রায় ১০ মাস লবণ পানির সঙ্গে বাস করেছে। এদের একজন কুড়িকাহুনিয়া গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন। প্রতাপনগরের প্রাণকেন্দ্র তালতলা বাজারে তার ক্ষুদ্র ব্যবসা ভালোই চলছিল। কিন্তু আম্ফান তার সাজানো সংসার এলোমেলো করে দিয়েছিল। পুরো ১০ মাস তার ঘর লবণ পানিতে ডুবেছিল। ফারুক তার স্ত্রী এবং কন্যাদের পাঠিয়েছিলেন শ্বশুরবাড়ি। নিজে দুই ছেলেকে নিয়ে অন্যের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে বাস করেছেন। সে ঘরের মেঝেতেও জোয়ারের পানি এসেছে প্রতিদিন দুইবার। ফারুক হোসেন বলেন, ‘আমরা টিকে থাকার লড়াই করছি। বারবার প্রাকৃতিক বিপদগুলো আমাদের সব কেড়ে নিয়ে যায়। আমরা আবার শূন্য থেকে শুরু করি। ঘর্ণিঝড় আইলায় সব হারানোর পরে আমি কাজের সন্ধানে ভারত গিয়েছিলাম। প্রায় ১০ বছর কাজ করে ভালোই উপার্জন করেছিলাম। আম্ফানের মাত্র এক বছর আগে এলাকায় ফিরেছিলাম। কিন্তু আম্ফান সব কেড়ে নিয়েছে।’

আম্ফানের প্রভাবে রাস্তাঘাটগুলো এখন সাঁকোতে পরিণত হয়েছে। প্রতাপনগরের ছবি

প্রতাপনগর এলাকার অনেক মানুষের সাথে আলাপ হয়েছে, যারা ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের পর থেকে এখন অবধি টিকে থাকার লড়াই করছেন। জোয়ারের পানি ওঠার কারণে প্রায় ১০ মাস এই মানুষেরা অনেক কষ্টে জীবিকা নির্বাহ করেছে। অনেকে ব্যবসা বা জীবিকার অন্য কোনো পেশা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। তালতলা বাজারের চাল ব্যবসায়ী বাবর আলী ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি এখন যশোরে ফেরিওয়ালার কাজ করে উপার্জন করছেন। এ দিয়ে তার সংসার চলছে অনেক কষ্ট করে। রেজাউল সরদার এলাকায় মাছের ব্যবসা করে ভালোভাবেই জীবিকা নির্বাহ করছিলেন। কিন্তু আম্ফান তার সেই সুন্দর সময় কেড়ে নিয়েছে। স্থানীয় ব্যবসা বাণিজ্য ছেড়ে রেজাউল এখন ঢাকা শহরে কঠিন কাজ করে উপার্জন করছেন। রফিকুল ইসলামের এলাকায় পেশা ছিল ফেরি করে পণ্য বেচাকেনা করা। বাড়িতে তার ছিল গবাদিপশু। সব মিলিয়ে ভালোভাবেই চলছিল সংসার। এখন এলাকা ছেড়ে তাকে জীবিকার জন্য নড়াইলে চলে আসতে হয়েছে।  

ফেরেননি ফারুক এবং আরো অনেকে 

আম্ফানের বেশ কিছুদিন পরে এলাকা ছেড়ে গিয়েছিলেন ফারুক হোসেনের পরিবার। প্রতাপনগরের চাকলা গ্রামের বাসিন্দা ফারুক হোসেন যেদিন বাড়ির সব মালামাল এবং পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খুলনা যাত্রা করেন, সেদিন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি ঝরছিল। ফারুক হোসেন ভাসছিলেন তার চোখের বৃষ্টিতে। কথা বলার সময় চোখ মুছছিলেন বারবার। খুলনায় কেমন ছিলেন ফারুক- খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, সেখানেও অনেক কষ্টে তার জীবন কেটেছে। খুলনায় ফারুক হোসেনের প্রথম ঠিকানা ছিল রূপসা উপজেলার নৈহাটি এলাকায়। সেখানে গিয়ে দেখা যায় পরিবারসহ একটি ছোট্ট ঘরে বাস করছেন। প্রথমে তিনি দুই কক্ষের বাসা ভাড়া নিলেও খরচ পোষাতে না পেরে বাসাটি ছেড়ে দেন। এলাকায় কৃষিকাজ করলেও শহরে গিয়ে তাকে জীবিকা নির্বাহের জন্য ভ্যান চালিয়েছেন। পরে নৈহাটির ছোট্ট বাসাটি ছেড়ে দিয়ে খুলনা শহরের অন্য এলাকায় বাসা নিয়েছেন ফারুক। ভ্যান চালানো বাদ দিয়ে এখন তিনি বাড়ির কেয়ারটেকার। প্রতাপনগরের চাকলা গ্রামে নিজের বাড়ির অনেক জমি নদীর ভাঙনে হারিয়ে গেছে। এখানে বাড়ি গোছাতে হলে অনেক টাকা প্রয়োজন। সে টাকা তার নেই। ফলে এলাকায় ফেরার কথা ভাবতে পারছেন না তিনি। 

ফারুক একা নন, আমার নোটবুকে আছে এমন আরো বহুজনের নাম, যারা বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। বছরের পর বছর এলাকায় স্বাভাবিক জীবন যাপন করলেও প্রাকৃতিক বিপদগুলো তাদের বাস্তুচ্যুত করছে। প্রতিটি বড় প্রাকৃতিক বিপদে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন বহু মানুষ। এদের মধ্যে কিছু মানুষ ফিরে এলেও অধিকাংশ পরিবার আর কখনো ফিরে আসতে পারেন না। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের পরে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো থেকে বহু পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে। 

ঘূর্ণিঝড়ের পরে জরুরি ত্রাণ সহায়তা এবং অন্যান্য জরুরি সহায়তা বরাদ্দ হয়। সরকারি-বেসরকারি তরফে দেয়া হয় অনেক সহায়তা। এসব সহায়তায় হয়তো পরিবারগুলোর ২-৩ মাসের যোগান হয়, কিন্তু প্রাকৃতিক বিপদের বড় বোঝা পরিবারগুলোকেই বহন করতে হয়। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সাতক্ষীরার প্রতাপনগর, গাবুরা, পদ্মপুকুর, খুলনার কয়রার উত্তর বেদকাশি, দক্ষিণ বেদকাশি, মহারাজপুর কিংবা কয়রা সদর ইউনিয়নে পুনর্বাসনের জন্য বিশেষ কোন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে বলে খবর পাওয়া যায়নি। বেড়িবাঁধ মেরামত ও পুনঃনির্মাণের জন্য কিছু কাজ হয়েছে মাত্র। কিন্তু এক একটি পরিবার কিভাবে ক্ষতি কাটিয়ে আবার নতুন জীবন শুরু করবে, সে উদ্যোগ চোখে পড়েনি।    

নুরুন্নাহারের নৌকার জীবন    

‘বাড়িঘর যা ছিল, সব নদীতে হারিয়েছে। প্রাকৃতিক বিপদ থেকে আমরা মুক্তি পাচ্ছি না। কখনো জোয়ারের পানি, কখনো নদীর ভাঙন, কখনো ঘূর্ণিঝড়। বিপদ আমাদের পিছু ছাড়ে না। কোথাও বসবাসের সুযোগ নাই। তাই এখন নৌকায় বসবাস করি।’ কথাগুলো বলছিলেন নুরুন্নাহার বেগম। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের আঘাতে সবুজে ঘেরা খোলা বাড়িটি হারিয়েছেন তিনি। এখন তার নৌকায় জীবন। তিন বছর ধরে স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে তিনি নৌকায় থাকেন। 

আম্ফানের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত অনেক চিংড়ি চাষী বহুদিন বাঁধের উপর বাস করেছেন। কয়রার কাটমারচর গ্রাম

আগে থেকেই মাছধরা ছিল এই পরিবারের পেশা। স্বামী হারুণ গাজী কখনো নিজের নৌকায়, কখনো অন্যের নৌকায় মাছ ধরতে যেতেন। এ থেকে উপার্জন করা অর্থ দিয়ে সংসার চলত। প্রতাপনগর ইউনিয়নের দক্ষিণ-পশ্চিমে হরিষখালীতে তাদের বাড়ি ছিল। কিন্তু ঘন ঘর প্রাকৃতিক বিপদের মুখে তাদের বাড়িটি ক্রমেই নদীর কিনারের দিকে যাচ্ছিল। অবশিষ্টাংশ কেড়ে নেয় ঘূর্ণিঝড় আম্ফান। দুই ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে এই পরিবারটি পড়েন মহাসংকটে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের পরে কিছুদিন আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করছিলেন। কিন্তু জীবিকার পথ খুঁজতে হয় তাদের। সম্বল নৌকা নিয়ে নদীতে নামের তারা। সারারাত তারা নৌকায় বসবাস করেন। রাতে নদীতে জাল ফেলেন। ভোররাতে জাল তুলে কিছু মাছ পাওয়া গেলে বাজারে বিক্রি করেন হারুন। এই সময়ে নুরুন্নাহার তার সন্তানদের নিয়ে নদীর কিনারে এক নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে কিছু সময়ের জন্য অবস্থান করেন। দুপুরে আবার নৌকায় ছুটেন। 

নুরুন্নাহারের স্বামী হারুন গাজীর আদিবাড়ি ছিল প্রতাপনগরের শ্রীপুর গ্রামে। তার বাবার তিন বিঘার ভিটে ছিল। ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলায় সে বাড়িটে নদীতৈ হারায়। এর পরে পরিবারটি বেড়িবাঁধের বাসিন্দা হয়ে যায়। প্রায় দুই বছর বেড়িবাঁধের উপরে খুপড়ি ঘরে বসবাস করে। বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় সে সময় নৌকায় বসবাস করেন প্রায় তিন বছর। নৌকা ছেড়ে পরিবারটি ইটভাটার কাজে যায়। দুই বছর পরে ফিরে এসে আবার নৌকায় কিনে মাছধরা শুরু করে। পরিবারটি আবার নৌকায় বসবাস শুরু করে। এরপরে কিছুদিনে বেড়িবাঁধের উপরে বসবাস করেছেন। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের পরে আবারো নৌকায়। 

ঘূর্ণিঝড় আম্ফান বিধ্বস্ত এলাকায় নুরুন্নাহারের মত আরো অনেক ভাসমান পরিবার রয়েছে। কেউ বেড়িবাঁধের উপরে, কেউ অন্যের বাড়িতে, কেউ সরকারি খাস জমিতে ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে কোনমতে জীবিকা নির্বাহ করছে।   

নাজুক বেড়িবাঁধে ভয়!

ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের অনেক আগে থেকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের মানুষের দাবি ছিল টেকসই বেড়িবাঁধ। এই দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে অনেক। আম্ফানের পরে এই দাবি আরো জোরালো হয়। মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদানসহ নানান কর্মসূচি পালিত হয় টেকসই বেড়িবাঁধের দাবিতে। এ কথা সকলেই স্বীকার করেছেন, নাজুক বেড়িবাঁধই আম্ফানে বড় ক্ষতির অন্যতম কারণ। তা সত্বেও বেড়িবাঁধ নিয়ে বড় কোন প্রকল্প আসেনি। কয়রা ও গাবুরা এলাকায় বেড়িবাঁধের বিশেষ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও তা সব এলাকাকে ঝুঁকিমুক্ত করতে পারবে না বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। এই প্রতিবেদন লেখা আগে মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখনো অনেক এলাকায় বড় ভয় নাজুক বেড়িবাঁধ। 

প্রতাপনগরের তালতলা এলাকার বাসিন্দা মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘আমরা আমাদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য শক্ত, টেকসই এবং প্রযুক্তিনির্ভর একটি বেড়িবাঁধ চাই। একমাত্র নাজুক বেড়িবাঁধই ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের পরে আমাদের এলাকাকে প্রায় দশ মাস জোয়ারের পানিতে ভাসিয়েছে। কিন্তু আমাদের সে দাবি পূরণ হয়নি। এখন আমাদের এখানে কোথাও থেকে জোয়ারের পানি প্রবেশ করছে না। তবে অনেক এলাকার বেড়িবাঁধ এখনো নাজুক। এগুলোকে ঠিক বেড়িবাঁধ বলা যায় না। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের পরে বড় কাজটি হয়েছে কুড়িকাহুনিয়া লঞ্চঘাটের ক্লোজার নির্মাণ। সেখানে সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে কাজ হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য এলাকাগুলো এখনো নাজুক অবস্থায় আছে। এখন বর্ষা মৌসুমে প্রবল বাতাসে আমাদের ভয় বাড়ে। জোয়ারের চাপে নাজুক বাঁধ ভেঙে যেতে পারে।’

চিংড়ি চাষী মনিরুল ইসলাম গাজী। তার পেছনে নদীতে হারিয়ে গেছে চিংড়ির খামার। এখন সে দিনমজুর। আশাশুনির কুড়িকাহুনিয়া

ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের পরেও কয়রার কয়েকটি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকেছিল। বেড়িবাঁধ ভেঙে গিয়েছিল দক্ষিণ বেদকাশির চরামুখা এলাকার। শ্যামনগরের গাবুরা, পদ্মপুকুরসহ অনেক স্থানে এখনো ঝুঁকি আছে বেড়িবাঁধে। এলাকাবাসী বলেছেন, শক্ত বেড়িবাঁধ নির্মাণ না হলে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের ঝুঁকি কমানো যাবে না। জোরাতালি নয়, বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য নিতে হবে বড় প্রকল্প। 

কৃষিতে বিপর্যয়

ঘূর্ণিঝড় আম্ফান বিধ্বস্ত এলাকাগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চিংড়ি চাষ হতো। কিছু এলাকায় ধানের আবাদ হতো। ফলে এলাকার মানুষেরা ধান ও চিংড়ির উপর নির্ভরশীল ছিল। অধিকাংশ এলাকার চিংড়ির খামার এবং ধান ক্ষেত লবণ পানিতে ভেসে গিয়েছিল। ফলে চিংড়ি ও ধানের উপর নির্ভরশীল মানুষগুলো চরম ক্ষতির মুখে পড়ে। চিংড়ি চাষীরা সাধারণত অন্যের জমি লিজ নিয়ে চিংড়ি চাষ করে। লিজের বিনিময়ে জমির মালিককে টাকা দিতে হয়। অনেকে দুই-তিন বছরের জন্য জমি লিজ নেন। একসাথে দুই-তিন বছরের টাকা অগ্রিম পরিশোধ করতে হয়। অনেক চিংড়ি চাষির সাথে আলাপ হয়েছে, যারা অগ্রিম লিজের টাকা পরিশোধ করার পরই ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের মুখে পড়ে সব হারিয়েছেন। অনেকের খামারে চিংড়ি ছিল; যা ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে ভেসে গেছে। 

প্রতাপনগর গ্রামের কৃষক আবদুস সামাদ বলেন, ‘আমার কৃষি জমিতে তিন বছর ধরে ধান আবাদ করতে পারছি না। দশ মাসের বেশি সময় জমির উপরে জোয়ারের পানি এসেছিল। এমনকি আমার বাড়িও ছিল পানির মধ্যে। নতুন করে আবাদ শুরু করতে আরো সময় লাগবে। আমি এখন ঋণ করে সংসার চালাচ্ছি। এভাবে আর কতদিন চলব।’ আবদুস সামাদের মত আরো অনেক কৃষক জমি চাষাবাদ করতে পারছেন না। জমিগুলো দীর্ঘদিন লবণ পানির তলায় থাকার কারণে উর্বরতা নষ্ট হয়ে গেছে। জমিগুলো আবাদী হতে আরো সময় লাগবে। তবে সংকটের মধ্যে অনেকে চেষ্টা করছেন চাষাবাদের। হয়তো এলাকায় আবার সবুজ ফিরবে, সেই অপেক্ষায় আম্ফান বিধ্বস্ত এলাকার মানুষেরা। 
 

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়