ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

দক্ষিণ কোরিয়াতে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের স্মৃতি

শান্তা ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:০৪, ১৪ এপ্রিল ২০২১   আপডেট: ২১:১১, ১৪ এপ্রিল ২০২১
দক্ষিণ কোরিয়াতে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের স্মৃতি

প্রবাস জীবন দূর থেকে দেখতে যতটা আকর্ষণীয় এবং মনোমুগ্ধকর মনে হয়, আদতে ঠিক ততটাই খারাপ লাগা এবং একাকিত্ব কাজ করে একেক প্রবাসীর মনের গহীনে। এখানে সবকিছুই আছে, শুধু নেই নিজ শেকড়ের সতেজ অনুভূতি, নেই প্রিয়জনের স্নেহমাখা পরম মায়ার উষ্ণছোঁয়া। তারপরও উচ্চশিক্ষা এবং উন্নত জীবনের হাতছানিতে, প্রবাস জীবনটাই বেঁছে নেয় বহু মানুষ।

সময়টা তখন ২০০২ সাল। নিজের সাজানো ছোট্ট জগতেই মগ্ন থাকতাম। খেলাধুলা, পড়ালেখা ও চারপাশ মাতিয়ে রাখাতেই কেটে যেত আমার সময়গুলো। একদিন জানতে পারলাম, আমরা নিজ দেশ ছেড়ে দক্ষিণ কোরিয়া চলে যাচ্ছি। মনটা খারাপ হলো, বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী করবো। কাছের পরিজন ছেড়ে কীভাবে যাবো, এত দূরে মন কিভাবে টিকবে! আরেকদিকে বেশ শিহরণ ও উৎফুল্লও বোধ করছিলাম। ভিন্ন দেশ, নতুন মানুষ, নতুন পরিবেশ। এক কথায় মিশ্র অনুভূতি।  

এখানে আসার পর প্রথম প্রথম তেমন খারাপ লাগা কাজ করেনি। সবকিছু গুছিয়ে উঠতে গিয়ে কোনদিক দিয়ে সময় চলে যেত, বুঝেই উঠতে পারতাম না। আমি আর আমার ভাই পড়ালেখা শুরু করি আর অন্যদিকে বাবা-মা ব্যস্ত হয়ে পড়েন নিজ নিজ কাজে। তবে সারাদিন তো আর নিজেদের ব্যস্ত রাখা যায় না। ভাবনা ঠিকই আসতো, মিস করতাম নিজ দেশ ও পরিজনদের। ভেবেছিলাম হয়ত এখানে ২-১ বছর থাকবো। তবে যাওয়ার পর থেকেই জীবনে অনেক কিছুতে পরিবর্তন আসা শুরু হয়। তাছাড়া পারিবারিক কিছু ঝামেলার কারণেও প্রবাসে থাকার সময়টা দীর্ঘ হতে থাকে। আর পড়ালেখা ছেড়ে দেশে ফিরে আসাটাও আমাদের জন্য গভীর ভাবনার বিষয় ছিল।

প্রবাস জীবনে থাকার অভিজ্ঞতাগুলো অন্য কোনো সময়ে শেয়ার করবো। আজ জানাবো, প্রবাসে থাকাকালীন সময়ে আমার পহেলা বৈশাখ উদযাপনের গল্পগুলো। প্রথম দিকে এখানের বাঙালি কমিউনিটির সঙ্গে আমার তেমন পরিচিতি ছিল না। আমার মনে পড়ে, কোরিয়াতে যাবার বেশ কিছুদিন পরের ঘটনা। একদিন বাসায় অনেক মেহমান এলেন। বাবা জানালেন, সকলেই ওনার পরিচিত। বাঙালি দেখে বেশ ভালো লাগা কাজ করলো, তাই সবাইকে আঙ্কেল বলে সম্বোধন করলাম। উনারা আমায় খুব স্নেহ করলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।  কীসে পড়ছি, কোথায় পড়ছি জিজ্ঞেস করলেন। খুব উৎসাহ নিয়ে উত্তরগুলো দিলাম। উনারা মূলত এসেছিলেন কোনো এক প্রোগ্রামের বিষয়ে কথা বলতে। চলে যাবার পর আগ্রহ নিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, ওনারা কারা? কেনো এসেছিলো? বাবা বললেন, তাদের সকলে প্রচেষ্টায় এখানে একটি বাঙালি কমিউনিটি আছে। প্রতিবছরের মতো এবছর পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে একটি প্রোগ্রাম করতে চাচ্ছেন তারা, তাই দাওয়াত দিতে এসেছিলেন। আমি শুনে খুবই উচ্ছসিত বোধ করলাম। আনন্দিত ছিলাম এই ভেবে যে,যাক! অনেকদিন পর দেশী মানুষদের সঙ্গে এক মিলনমেলা হবে।

প্রোগ্রামে আমি কী কী করব, কোন ড্রেস পরবো, কীভাবে নিজেকে সাজাবো এসব নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পরলাম। আমার আগ্রহ দেখে আমার বাবা-মা বেশ খুশি হচ্ছিলেন। দেখতে দেখতে প্রোগ্রামের দিন চলে এলো। আমার মনে পড়ে, সেদিন ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিলো। আমি আম্মুর একটি শাড়ি পড়লাম। ঠিক মত নিজ থেকে পড়তে পারিনি। তবুও আমার বেশ ভাল লাগছিল কারণ শাড়ি আমার খুব পছন্দের। এদিকে আমি, আমার স্কুলের দুজন বান্ধুবীকেও দাওয়াত করেছিলাম, সময়মত তারাও চলে এলো। শাড়ি পড়েছি দেখে তারা দুজন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।  একজনকে জিজ্ঞেস করলাম শাড়ি পড়বে কি না। বোধ হয়, সে আমার এই প্রশ্নের অপেক্ষাতেই ছিল। মুহূর্তেই রাজি হয়ে গেলো। তাকেও আম্মুর একটি শাড়ি পড়িয়ে দিলাম, যতটুকু পেরেছি আর কি!  

বান্ধবীদের পাশে পেয়ে ভালো লাগলো। কোরিয়ানরা এমন প্রোগ্রামে অভ্যস্ত না, আমি যতটা না উচ্ছসিত ছিলাম, তাদের মাঝেও ঠিক সেই পরিমান আনন্দ দেখতে পাচ্ছিলাম। সকলে মিলে উপস্থিত হলাম ইভেন্টে। বৈশাখী মেলা চলছিলো, বেশ কয়েকটা স্টল দেখতে পেলাম।  কেউ বসেছে চা-কফি নিয়ে কেওবা চটপটি ও ফুচকার স্টল নিয়ে। তবে মেলার মূল আকর্ষণ ছিল বৈশাখের মূল খাবার পান্তা-ইলিশ। অতিথিদের সকলেই পান্তা-ইলিশ খাচ্ছিলো, তাই স্টলটাতে বেশ ভিড় ছিল। আমরাও বেশ তৃপ্তি নিয়ে পান্তা-ইলিশ খেলাম। আম্মু আমাদের পাত্রের মাছের কাটাগুলো সরিয়ে দিচ্ছিলো। আমার কোরিয়ান বান্ধবীরা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলো একটু পরপর, আমার বেশ মজা লাগছিল দেখে। আবহাওয়া সেদিন অনুকুলে ছিল না, হালকা ঝড় হচ্ছিলো। বাতাসের কারণে শাড়ি ঠিকমতো সামলাতে পারছিলাম না। আম্মু আমায় দেখে হাসতে লাগলো আর শাড়ি ঠিক করে দিল। মেলায় খেলাধূলার আয়োজনও ছিল। সুঁই-সুতা, হাড়িভাঙ্গা, মোরগ লড়াই আরও কত কিছু! এখানে  এমনসব খেলার আয়োজন দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম।

আমাদের এরিয়াতে বাংলাদেশি, ভারতীয়, নেপালি, শ্রীলংকান, ফিলিপিনো এবং আফ্রিকান সবাই মিলে প্রোগ্রামের আয়োজন হত। এভাবেই প্রতি বছর বৈশাখ পালন করতাম আমরা। দিন দিন আমাদের স্কিল বাড়ছিলো, আরও বেশি আপডেট হচ্ছিলাম। প্রোগ্রামগুলোতে নতুন নতুন আয়োজন যোগ হতে থাকলো। বিদেশের মাটিতে বছরে ঈদ ও বৈশাখটাই মনে হয় বেশ বড় করে পালন করা হত। তাই সারা বছর এই দিনগুলোর অপেক্ষায় থাকতাম। একটা সময়ের পর থেকে, আনন্দের ভাগিদার হতে অন্যান্য শহরগুলোর প্রোগ্রামেও যাওয়া শুরু করলাম।

সময় বেশ ভালো কাটছিল। আমরা স্পন্সর পাচ্ছিলাম, প্রোগ্রামগুলো আরও বেশ বড় পরিসরে হওয়া শুরু করেছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই, আয়োজক দু-তিনজন আঙ্কেল দেশে ফিরে এলেন। বাকিরাও ধিরে ধিরে চলে আসতে শুরু করলো। তাই প্রোগ্রামটাও বন্ধ হয়ে যায় যায় অবস্থা। আমার মন এতো খারাপ বোধ হচ্ছিল যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না, রীতিমত কান্না পাবার মত অবস্থা হয়েছিল। বৈশাখী অনুষ্ঠানটা, আমাদের এলাকার সকলের মিলনমেলার সবচেয়ে বড় একটি অংশ ছিল যেখানে হাসি-আনন্দে সময় কাটতো আমাদের। প্রবাসেতো সকলেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে, কাজের মাঝে বিলিয়ে দেয় পরিপূর্ণভাবে। অন্যদিকে দেশের মায়ার কারণে মন খুলে হাসাও হারিয়ে ফেলে। প্রোগ্রামটা আমাদের সবার মনে আনন্দের খোঁড়াক যোগাতো। দেশ ও পরিজন থেকে দূরে থাকলেও মনে আনন্দ ছড়িয়ে দিত, সতেজ করে দিত। আমার কিছুতেই এই আয়োজনগুলোকে হারিয়ে যেতে দিতে ইচ্ছে হতো না। তাই ভাবতাম, নিজ থেকে কী কী উদ্যোগ নিতে পারি যা আবারো সকলের মাঝে উৎসাহ আর সতেজতা সঞ্চার করবে। সব সময় মাথায় ঘুরতো আমাকেই কিছু একটা করতে হবে।

২০১৫ সালের কথা, আমি আমার কিছু বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে শেয়ার করলাম আমার ভাবনার ব্যাপারে, জানালাম আমার ইচ্ছার কথা। তারা আগ্রহ সহকারে শুনলো। শুনে খুশি হলো এবং সানন্দ্যে রাজি হয়ে গেল। কথা দিল, যেকোনো ব্যাপারে তারা আমার পাশে থাকবে। আমার মনে আবারো সুবাতাস বইতে শুরু করলো। আয়োজনগুলো কীভাবে করবো তা নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করে দিলাম।

আমার পরিচিত কিছু আর্টিস্ট ছিলেন যারা বেশ ভালো গান করেন, কেও নাচে পারদর্শী, কেও মধুর সুরে সাক্সোফোন বাজাতে পারেন, কেও ভিডিও করতে জানেন, আবার কেও মুগ্ধ করা পেইন্টিং করতে জানে। একে একে তাদের সকলের কাছেই গেলাম। তারা আমায় হতাশ করলো না। আগ্রহ সহকারেই প্রোগ্রামে আসতে রাজি হলো। বাকি থাকে স্টেজ এবং খাবারের দিকটা। আমার এক বন্ধু একটি এনজিওর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিলো যারা খাবারের দায়িত্বটা নিয়ে নিল। আর অন্যদিকে স্টেজ সাজানোর দায়িত্ব দিলাম এলাকার বড় ভাইদের। এভাবেই স্বল্প বাজেটের মধ্যে বৈশাখী মেলার আয়োজন শুরু করলাম। দিন-রাত জেগে অনুষ্ঠানের পোস্টার তৈরি করলাম।

আবহওয়া কিছুটা প্রতিকুলে ছিল। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে সেগুলো লাগিয়ে ফেললাম। এরপর দাওয়াত দেওয়ার পর্ব শুরু করলাম, আনাচে-কানাচে থাকা সকল বাঙ্গালিদের জানালাম। ফেসবুকে একটি পেজ তৈরি করে সেখানেও ইভেন্ট খুলে সবাইকে আমন্ত্রণ করলাম।

কিন্তু একি হলো! শুনতে পেলাম ১৪ তারিখে নাকি অনেক ঝড় হবে, তাই প্রোগ্রামটিকে এক সপ্তাহ পিছিয়ে দিতে হবে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। তারপরও আশাহত হইনি, অপেক্ষা করছিলাম। সবার মনে আনন্দ বিলিয়ে দিতে হবে এটাই ছিল আমার উদ্দেশ্য।  ২৬শে এপ্রিল নতুন তারিখ ঠিক করা হলো। সেদিন ভোর না হতেই সবকিছু চেক করা শুরু করে দিলাম। নাহ, সব ঠিক আছে।  কিছুক্ষন পর মিষ্টি রোদ শুরু হলো। পাশাপাশি পেলাম সতেজ কোমল ফুলের ঘ্রান। আহা! কি সুন্দর সকাল ছিল সেদিন। শুরু হয়ে গেলো অনুষ্ঠান।

সেদিনও আমি শাড়ি পড়েছিলাম। আমার দেখাদেখি আমার কোরিয়ান বান্ধবীরাও শাড়ি পড়েছিল। দেখে কি যে ভাল লেগেছে আমার ।

নাচ-গান আর খেলাধুলায় মেতে ছিল সকলে।

কোরিয়ান, ফিলিপাইন, নেপালি আর্টিস্টরাও ছিল, তাদের কারণে প্রোগ্রামটা আরও জমে উঠেছিল। আমার এত ভাল লাগা কাজ করছিল যে তা লিখে প্রকাশ করার মতো না। সবার মুখে হাসি দেখে আমার চোখ ভিজে গেল। আমি ভাবতে পারিনি যে আমার পাশে এত মানুষ এসে দাঁড়াবে, হাত বাড়িয়ে দিবে ,উৎসাহিত করবে। আমন্ত্রিত অতিথিদের দেখে মনে হয়েছে তারাও অনেক বেশি উপভোগ করেছে।

খুব ভাল মানের না হলেও অনেক বাঁধা থাকা সত্ত্বেও, একটি প্রোগ্রাম আয়োজন করতে পেরেছি এটাই আমার জীবনের অন্যতম সফলতা। বারবার মাথায় ঘুরছিল, ‘দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ’।  সবসময় নির্দিধায় স্বীকার করি,  সেসময়ে বাকিরা যদি আমার পাশে এসে না দাঁড়াতো, সবাই মিলে যদি একসঙ্গে কাজ না করতো, তাহলে এই আয়োজন করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। আজো যখন আমি দিনগুলোর কথা ভাবি, মনের অজান্তেই মুখে তৃপ্তির হাসি চলে আসে । আবেগতাড়িত হয়ে পড়ি। 

প্রবাসে আমরা হয়তো কেও কারো রক্তের আত্মীয় নই, তবে সকলেই আমরা একে অপরের আত্মার আত্মীয়। এই আয়োজনগুলোই তা প্রমান করে, আমাদের মাঝে টান ও ভালোবাসা বৃদ্ধি করে তোলে। প্রবাসে থেকেও আমরা বাঙালিরা যে আমাদের শেকড় ভুলে যাইনি তা সকলের নিকট রঙিনভাবে ফুটিয়ে তোলে আর বাঙ্গালিদের সংস্কৃতি সম্পর্কে বিশ্ববাসীর কাছে শক্তভাবে জানান দেয়।

সবাইকে বৈশাখের অনেক অনেক শুভেচ্ছা।

ঢাকা/সাব্বির

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়