ঢাকা     মঙ্গলবার   ০৭ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৪ ১৪৩১

নীল আকাশের নিচে রাস্তা চলেছেন একা

তাপস রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১২, ২৫ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ১৩:৩৯, ১৬ জুন ২০২৩
নীল আকাশের নিচে রাস্তা চলেছেন একা

‘তুমি অভিনয় করতে চাও। কিন্তু এভাবে ক্যান নিয়ে ঘুরে বেড়ালে তো হবে না। তোমাকে বেছে নিতে হবে। নইলে সারাজীবন ওই অ্যাসিস্টেন্টই রয়ে যাবে।’

সে সময়ের জনপ্রিয় নায়ক রহমান যখন ধমকের সুরে আবদুর রাজ্জাককে কথাগুলো বলেছিলেন মনে ধরেছিল খুব। এক বুক স্বপ্ন চলচ্চিত্রে অভিনয় করবেন। ভালো একটা চরিত্রের জন্য ঘুরছেন পরিচালকদের দ্বারে দ্বারে। ছোটখাটো রোল মিলে যাচ্ছিল ঠিকই তাতে মন ও পকেট কোনোটাই ভরছিল না। শূন্য হাতে সদ্য সপরিবারে কলকাতা থেকে ঢাকা এসেছেন। নতুন শহর। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মানুষগুলোও অচেনা। ভাগ্যদেবীও তখন করছিলেন বিমাতাসুলভ আচরণ। ফলে বাধ্য হয়েই অ্যাসিস্টেন্টগিরির কাজ নিতে হয়েছিল। একদিন শুটিং সেটে ক্যান নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন রহমান কাছে ডেকে কথাগুলো বলেছিলেন বেশ কড়া ভাষায়। ব্যস, পরদিন থেকেই বাদ দিয়ে দিলেন ইকবাল ফিল্মস লিমিটেডের প্রডাকশনে অ্যাসিস্টেন্টের কাজ।

কিন্তু কাজ না করলে সংসার চলবে কী করে? স্ত্রীকে বললেন, চলো কলকাতা ফিরে যাই। জন্মস্থান সেখানে। বাবা-মা না থাকলেও ভাইয়েরা আছেন। ব্যবসাপাতি কিছু একটা করা যাবে। আবদুর রাজ্জাক যখন এমন পরিকল্পনা করছিলেন তখন আড়ালে বসে ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছিলেন ভাগ্যদেবী। ঘরেও তার দেবীর মতো স্ত্রী- রাজলক্ষ্মী। তিনি কিন্তু একমত হলেন না। দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, না। ফিরে যাব না। এসেছ যখন একটা কিছু হবেই।

সেই একটা কিছু কত বিস্ময় নিয়ে যে জীবনে দেখা দেবে, অর্থ-বিত্ত, খ্যাতি, প্রতিপত্তি, সম্মানে ভরিয়ে তুলবে জীবন- সেদিন কেউ ভাবেনি একথা! ভাগ্যিস, রাজলক্ষ্মী সেদিন ফিরে যেতে রাজি হননি। তাহলে আবদুর রাজ্জাকের আর নায়ক হওয়া হতো না। কারণ, ওই যে বললাম, এলেন, দেখলেন, জয় করলেন এমন রাজকপাল নিয়ে তিনি আসেননি। ভক্তের হৃদয়ে ভালোবাসার আসন পোক্ত করেছেন ঠিকই, স্বীকৃতি মিলেছে সময়ের কাছ থেকেও। আবার সেই সময়ের কাছেই তাকে দিতে হয়েছে জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা। সবকটি পরীক্ষায় পাস করে তবেই তিনি নায়ক থেকে হয়ে গেছেন নায়করাজ।

নায়কোচিত চেহারা তার ছিল। নায়ক রহমান নিজেই তাকে একথা বলে সাহস দিয়েছিলেন। ভাষাজ্ঞান ছিল টনটনে। ফলে ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান টেলিভিশনে রাজ্জাক নিউজ রিডার পদে দরখাস্ত করলেন। চাকরি মিলে গেল। ভাবলেন, যাক অন্তত খেয়েপরে বাঁচা যাবে। কিন্তু বাদ সাধলেন অনুষ্ঠান প্রযোজক জামান আলী খান। তার এক কথা- নিউজ রিডারের চাকরি করে ফিউচার নষ্ট করা যাবে না। তিনি রাজ্জাকের অভিনয় গুণের কথা জানতেন। সুতরাং সে চাকরিও আর করা হলো না। তবে এবার তার কল্যাণেই টেলিভিশন নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পেলেন রাজ্জাক। ধারাবাহিক নাটক দিয়ে হলো সূচনা। এ পরীক্ষাতে বেশ ভালোভাবেই উতরে গেলেন তিনি। কিন্তু আরো বড় পরীক্ষা তখন সামনে।

টেলিভিশনে কাজ করার সময় একদিন শুনতে পেলেন জহির রায়হান তাকে খুঁজছেন। জহির রায়হান তখন ডাকসাইটে ডিরেক্টর। অনেক আগে একবার কাজ চাইতে গেলে বলেছিলেন, তার সিনেমায় নেবেন- তাই বলে নায়ক চরিত্রে! এতটা রাজ্জাক নিজেও ভাবতে পারেননি। জহির রায়হান তখন ‘হাজার বছর ধরে’ বানানোর পরিকল্পনা করছিলেন। জলিল চরিত্রে রাজ্জাককে নিতে চেয়েছিলেন। যদিও সে কাজটি পরে হয়নি। প্রচণ্ড আশাহত হতে হয়েছিল রাজ্জাককে। এবারো কি তাই হবে? রাজ্জাক তারপরও প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে দেখা করলেন জহির রায়হানের সঙ্গে। রাজ্জাককে দেখেই জহির রায়হান বলে উঠলেন, আরে! আমি তো একটি ছবি করছি। আপনি সেই ছবির হিরো। একেই বলে রাজকপাল! ছবির নায়ক হিসেবে পাঁচশ টাকা সাইনিং মানি পকেটে নিয়ে রাজ্জাক সেদিন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হয়ে বাসায় ফিরেছিলেন।

এর পরের ঘটনা রাজ্জাক নিজেই বিভিন্ন সময় সাক্ষাৎকারে বলেছেন। তার সারমর্ম মোটামুটি এই : নায়িকা সুচন্দা তখন বেশ জনপ্রিয়। রাজ্জাক তখনও ‘এক্সট্রা’। ফলে ‘বেহুলা’র প্রযোজক তাকে শ্যেনদৃষ্টিতে দেখছিলেন। ইউনিটের সবার চোখ তার ওপর। পরিচালকের মুখও গম্ভীর। রাজ্জাক বুঝে গেলেন এটিই তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। রাজ্জাক ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালেন। চিত্রগ্রাহক ক্যামেরায় চোখ রেখেই বলে উঠলেন, উত্তম কুমারের মতো লাগছে। স্টিল ছবি দেখে অনেকেই মন্তব্য করলেন- আরে! এ তো নায়ক বিশ্বজিত! রাজ্জাক জিতে গেলেন। ১৯৬৬ সালে ‘বেহুলা’ মুক্তি পেল। ছবি সুপারহিট। এক ছবিতেই ঢাকার রুপালি পর্দার ‘নায়ক’ হয়ে গেলেন রাজ্জাক।

এরপর তীব্র বেগে ছুটতে শুরু করল রাজ্জাকমেইল। জীবন থেকে নেয়া, অবুঝ মন, মনের মতো বউ, নীল আকাশের নিচে, ময়নামতি, ঝড়ের পাখি, মধুমিলন, কাঁচ কাটা হীরে, দীপ নেভে নাই, ক খ গ ঘ ঙ, মাটির ঘর, বেঈমান, বদনাম, নাচের পুতুল, দর্পচূর্ণ, অশিক্ষিত, দুই পয়সার আলতা, আলোর মিছিল, বাদী থেকে বেগম, অনন্ত প্রেম, পাগলা রাজা, ছুটির ঘণ্টা, বড় ভালো লোক ছিল, লাইলি মজনু, শুভদা, স্বাক্ষর, বিধাতা- প্রতিটি ছবি দর্শকপ্রিয়তা পেল। এ দেশে কোনো নায়কের একটানা এভাবে পর্দাশাসন বিরল ঘটনা। রাজ্জাক-কবরী জুটি হয়ে উঠল কিংবদন্তিসম। রোমান্টিক নায়ক হিসেবে শক্ত অবস্থান তৈরি করে ফেললেন রাজ্জাক। হয়ে উঠলেন তারুণ্যের আইকন। পর্দায় রাজ্জাককে ‘নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তা চলেছি একা’ গাইতে দেখে তরুণ দর্শক কল্পনায় সেই রাস্তায় নিজেকে আবিষ্কার করত। ‘অনন্ত প্রেম’র রাজ্জাক উচ্ছ্বাসে ভরা যৌবনের প্রতীক। ‘ময়নামতি’র রাজ্জাক গ্রাম-বাংলার শাশ্বত প্রেমিক। আবার ‘প্রায়শ্চিত্ত’ সিনেমায় রাজ্জাককে দর্শক দেখেছে ভণ্ড প্রেমিকের চরিত্রে।

রাজ্জাক প্রতিনিয়ত নিজেকে ভেঙেছেন। কখনো গ্রামের সাধারণ ছেলে, কখনো শহরের শিক্ষিত বেকার, কখনো প্রতিবাদী যুবক, মহল্লার রংবাজ, স্কুলের দপ্তরি, গ্রামের পাহারাদার, আবার কখনো তিনি খেয়ালি রাজা। আশির দশকে এই রাজ্জাকেরই ভিন্ন রূপ। কখনো দর্শক তাকে দেখছে আসামি হয়ে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, কখনো তিনি নিজেই নীতিবান পুলিশ অফিসার। কখনো শিল্পপতি, কখনো ঠেলাগাড়িওয়ালা, কখনো পর্দায় পাড় মাতলামি করছেন, কখনো প্রফেসর সেজে ক্লাস নিচ্ছেন। অর্থাৎ ১৯৬৬-তে ‘বেহুলা’ লখিন্দর রাজ্জাককে নিয়ে সেই যে ভেলা ভাসালেন সেই ভেলা এসে ঠেকল ২০১৫ সালে ‘কার্তুজ’-এ এসে।

ঊনপঞ্চাশ বছরের চলচ্চিত্রজীবনে রাজ্জাক এক জায়গায় আটকে থাকেননি। মেলোড্রামা (রংবাজ), রোমান্টিক (অবুঝ মন), ক্ষ্যাপাটেপনা (পাগলা রাজা) অনেকভাবেই দর্শক তাকে দেখেছে। আমরা যদি ভারতীয় সিনেমার প্রথম সুপারস্টার রাজেশ খান্নার অভিনয় জীবনের দিকে তাকাই তাহলে পার্থক্যটা পরিষ্কার হবে। রাজেশ খান্নার মতো রাজ্জাকের শুরুটা হয়েছিল রোমান্স দিয়ে। দুজনেই ভীষণ রোমান্টিক নায়ক। কিন্তু তারপরেই এলো মারামারি, পর্দায় রক্তক্ষয়ের যুগ। যার সূচনা অমিতাভ বচ্চনের হাত ধরে। অ্যাংরি ইয়াং অমিতাভ বচ্চন এসে হটিয়ে দিলেন রোমান্টিক রাজেশ খান্নাকে। বলিউডে রোমান্টিসিজমের মৃত্যু রাজেশ খান্নার ক্যারিয়ার শেষ করে দিল। হেরে গেলেন তিনি। এখানেই রাজ্জাক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি ‘রংবাজ’ করে ঢাকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তো বটেই বাংলা সিনেমার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। রোমান্টিক নায়কের তকমা ভেঙে রেরিয়ে এলেন এবং সফল হলেন। দুই বাংলার প্রথম অ্যাকশন সিনেমা ‘রংবাজ’ রাজ্জাক প্রযোজিত প্রথম সিনেমাও বটে।

রাজ্জাক বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এমন অনেক নতুনের সাক্ষী। যে সময় বাংলা সিনেমায় চুম্বন দৃশ্য কল্পনাতীত তখন তিনি ববিতাকে নিয়ে করলেন ‘অনন্ত প্রেম’। এটি তার প্রথম পরিচালিত সিনেমা। যদিও ঘটনাচক্রে তিনি পরিচালনায় এসেছিলেন। এই সিনেমার চিত্র সম্পাদক বসিরুল হক ক্যানসারে আক্রান্ত হলে তারই অনুরোধে ছবিটি পরিচালনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন রাজ্জাক এবং এখানেও তিনি সফল হন। অথচ চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টরা তখন বলেছিলেন, এ সিনেমায় নায়ক-নায়িকার মৃত্যু দর্শক ভালোভাবে নেবে না। ভুল প্রমাণিত হলো সে কথা। ‘অনন্ত প্রেম’ সুপার-ডুপার হিট হলো। বলা যায়, এই ছবি করতে গিয়েই রাজ্জাক পরিচালনার প্রেমে পড়েন। একে একে নির্মাণ করেন ‘মৌচোর’, ‘বদনাম’, ‘সৎভাই’, ‘চাপা ডাঙার বউ’, ‘ঢাকা-৮৬’র মতো সিনেমা।  অনেকেরই হয়তো মনে পড়বে ‘চাপা ডাঙার বউ’ সিনেমায় তিনি খলচরিত্রে হানিফ সংকেতকে নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, এই এক ছবি দিয়ে তিনি ছেলে বাপ্পারাজকেও প্রতিষ্ঠিত করলেন ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। প্রযোজনার পাশাপাশি পরিচালনা রাজ্জাকের ক্যারিয়ারে এভাবেই ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। গেঁথে দেয় নায়করাজের মুকুটে সাফল্যের আরো দুটি পালক।

রাজ্জাক খ্যাতি, যশ, প্রতিপত্তি উপভোগ করতেন না। নায়করাজ অভিধা তাকে উদ্ধত করেনি। সুপারস্টারডম তাকে বিগড়ে দেয়নি। ‘সুপারস্টার’ নামক প্যান্ডোরার বাক্সটি খুললে তার ভেতর থেকে কিছু অনভিপ্রেত জিনিস বেরিয়ে আসবেই। রাজ্জাকের ক্ষেত্রে এমনটা কখনো হয়নি। সুজাতা, সুচন্দা, শবনম, শাবানা, ববিতা, অঞ্জনা, নূতন, রোজিনা অনেক নায়িকার সঙ্গে কাজ করেছেন। এর মধ্যে রাজ্জাক-শাবানা, রাজ্জাক-ববিতা জুটি ভীষণ দর্শকপ্রিয়তা পায়। কিন্তু কখনো তাকে নিয়ে মুখরোচক কিছু শোনা যায়নি। এখানেও রাজ্জাক অন্যদের ছাড়িয়ে গেছেন। যে কারণে স্ত্রী রাজলক্ষ্মীর কাছে স্বামীর বদনাম বরাবরই অরণ্যে রোদনের মতোই শুনিয়েছে। 

রাজ্জাকের সহজ অভিনয় দক্ষতা তাকে দর্শকের খুব কাছের একজন করে তুলেছিল। তার জনপ্রিয়তার এটিই অন্যতম কারণ। যদিও তার অভিনয়ের সর্বোচ্চটা আমরা ব্যবহার করতে পারিনি। বলিউডে আমরা যেমন দেখি অমিতাভ বচ্চনকে কেন্দ্র করে চিত্রনাট্য তৈরি হয়। আমাদের এখানে তেমনটা দেখা যায় না। কলকাতায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কেও আমরা এখনো সমান তালে অভিনয় করে যেতে দেখছি। আমাদের দুর্ভাগ্য রাজ্জাকের মতো অভিনেতা মৃত্যুর কয়েক বছর  আগে থেকেই চলচ্চিত্র থেকে দূরে ছিলেন। এর কতটা শারীরিক অসুস্থতাজনিত, কতটা আমাদের চলচ্চিত্র পরিকল্পনার দৈন্য- ভেবে দেখা উচিত। 
 

শান্ত//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়