ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

দ্বিশত জন্মবর্ষে জ্ঞান বিদ্যা দয়ার সাগর

তপন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৪, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দ্বিশত জন্মবর্ষে জ্ঞান বিদ্যা দয়ার সাগর

ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ কেউ এই নামে তাঁকে চেনে না। একুশ বছর বয়সে বন্দ্যোপাধ্যায় চাপা পড়ে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। নিতান্ত সহজ সরল মানুষ। পায়ে চটি, পরনে ধূতি ও গায়ে ভারি চাদর- এই পোশাকেই তিনি ব্রিটিশ রাজ দরবার, কলেজ, মিটিং-মিছিলে যেতেন। বাঙালি সর্বপ্রথম বড় হওয়ার, যোগ্য হওয়ার, আধুনিক প্রগতিশীল ও বিশ্বজনীন হওয়ার দৃষ্টান্ত খুঁজে পেয়েছিল এই মানুষটির মধ্যে। বিশ্বকবি তাঁর সম্বন্ধে বলেছেন: ‘‘তিনি হিন্দু ছিলেন না, বাঙ্গালী বা ব্রাহ্মণ ছিলেন না, ছিলেন ‘মানুষ’।’’ রবীন্দ্রনাথ আরো বলেছেন, ‘‘...মহৎ চরিত্রের যে অক্ষয় বট তিনি বঙ্গভূমিতে রোপণ করিয়া গিয়াছেন, তাহার তলদেশে জাতির তীর্থস্থান হইয়াছে।’’   

বিদ্যাসাগর সমাজ সংস্কার ও শিক্ষাবিস্তারের ক্ষেত্রে রাজা রামমোহন রায়ের  সুযোগ্য উত্তরাধিকারী। রামমোহনের প্রজ্বলিত রেনেসাঁর মশাল তিনি বহু বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে, জীবননাশের হুমকি উপেক্ষা করে, অকুতভয়ে, উত্তরোত্তর উজ্জ্বল থেকে উজ্বলতর করে তুলেছিলেন। কুসংস্কারাচ্ছন্ন বাংলার সমাজ সংস্কার, শিক্ষাবিস্তার, নারীশিক্ষা, বিধবা বিবাহ প্রচলন, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিরোধ, বাংলা গদ্যের ভিত্তি স্থাপনসহ বহু কর্মের জন্য বিদ্যাসাগর বিষয়ক আলোচনা আজো আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক। বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, ‘‘আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি। নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিৎ বা আবশ্যক বোধ হইবে, তাহাই করিব, লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সংকুচিত হইব না।” প্রচণ্ড বাধা, ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করে তিনি অক্ষরে অক্ষরে তাঁর প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে গেছেন।

বিশ শতকের অষ্টম-নবম দশক পর্যন্ত বিদ্যাসাগর রচিত ‘বর্ণ পরিচয়’ প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগ-এর সুবাদে আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত তো বটেই, এমনকি স্বল্প শিক্ষিত ও স্বশিক্ষিত বাঙালি মাত্রেই বিদ্যাসাগরের নাম শুনে থাকবেন। উনিশ শতকের বাংলায় প্রাতঃস্মরণীয় অনেক মনীষীর জন্ম হয়েছিল। যুগ প্রবর্তক ও বিরলতম গুণের অধিকারী ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম।  দু’শ বছর আগে বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা পণ্ডিত ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও মা ভগবতী দেবী। মা অধিকতরো কুসংস্কারাচ্ছন্ন যুগেও আধুনিক চিন্তার অধিকারী ছিলেন। আর্থিক অবস্থা করুণ থাকলেও পাণ্ডিত্যের জন্য তাঁদের পরিবারের খ্যাতি ছিল। বালক ঈশ্বরকেও কঠোর দারিদ্র্যের মোকাবিলা করতে হয়। আর্থিক দুরবস্থার কারণে ঠাকুরদাসকে অল্প বয়সে কলকাতায় যেতে হয়। তিনি প্রথমে নামমাত্র বেতনে এক ব্যবসায়ীর খাতা লেখার কাজে নিযুক্ত হন। ন্যায়নিষ্ঠা, নীতিপরায়ণতা, সততা, অধ্যবসায় ও স্বাধীনচেতা মনোভাবের কারণে ঠাকুরদাস ক্রমে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। পিতার এই সকল দুর্লভ গুণ সন্তানের মধ্যেও বিকশিত হয়েছিল। আর্থিক অতি বিপন্নতার মধ্যে মানুষ হলেও ঈশ্বরচন্দ্রের মনোবল ছিল অসীম ও দৃঢ়।

ঈশ্বরচন্দ্র স্কুলের পড়াশোনায় মেধাবী ছিলেন। আশৈশব তিনি নিয়মানুবর্তী ও মনোযোগী ছিলেন। গ্রামের পাঠ শেষে আট বছরের বালক বাবার সঙ্গে পায়ে হেঁটে কলকাতায় পা রেখেছিলেন। পথের মাইলফলক দেখে দেখে যে ইংরেজি সংখ্যা গোনা শেখার কাহিনি তা আষাঢ়ে নয়। পয়সার অভাবে বাতির তেল যোগাড়ে অসমর্থ হয়ে রাতে রাস্তার ধারে লাইটপোস্টের নিচে বসে পড়ার গল্পও অতিরঞ্জিত নয়। তুখোর মেধাবী বালক ঈশ্বরচন্দ্র বাবার সঙ্গে কলকাতার বড়বাজারে ভাগবত সিংহের বাড়িতে থেকে শিবচরণ মল্লিক মহাশয়ের পাঠশালায় এক বছর অধ্যয়ন করেন। ১৮২৯ সালের ১ জুন তাঁকে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করা হয়।

ঈশ্বরচন্দ্র অপরিসীম শ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে পড়াশোনা করে স্কুলে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে মাসিক পাঁচ টাকা বৃত্তি লাভ করেন। সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের পাঠ শেষ করে ইংরেজি পড়া শুরু করেন। ১৮৩৩-১৮৩৫ এর মধ্যে তিনি সাহিত্যের পাঠ শেষ করেন। সংস্কৃত কলেজে বার্ষিক পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৮৩৫ সালে ঈশ্বরচন্দ্র অলঙ্কার শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই শেণিতে তিনি এক বছর পড়াশোনা করেন এবং চূড়ান্ত পরীক্ষায় প্রথম হয়ে ব্যাপক সুনাম ও পুরস্কার অর্জন করেন। এরপর বেদান্ত শ্রেণি। সেখানেও কৃতিত্বের পরিচয় দেন। এরপর স্মৃতি শ্রেণি। স্মৃতিতেও অসাধারণ সাফল্য প্রদর্শন করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বারো বছরে সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণ, কাব্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, স্মৃতি, ন্যায় ও জ্যোতিষ শাস্ত্রে প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ১৮৩৯ সালে তিনি হিন্দু আইন কমিটির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কমিটি শংসাপত্রে তাঁর নামের আগে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি ব্যবহার করেন। এই উপাধি যথার্থ। তাঁর জীবনের পরবর্তী কর্মকাণ্ড বিবেচনায় বিদ্যার সাগর, জ্ঞানের সাগর, দয়ার সাগর, করুণা সাগর, মানবতার সাগর, প্রগতিশীলতার সাগর, বিবেকের সাগর ইত্যাদি কোনো প্রশংসাই পর্যাপ্ত নয়। মাত্র একুশ বছর বয়সে পড়াশোনা শেষে ১৮৪১ সালে তিনি সংস্কৃত কলেজ ত্যাগ করেন। তখনকার প্রথানুসারে প্রায় ১১ বছর বয়সে দীনময়ী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।

তাঁর কর্মজীবনেরও শুরু ১৮৪১ সালের ২১ ডিসেম্বর। তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং সেইসঙ্গে বিদ্যালয় পরিদর্শকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পাঁচ বছর পর তিনি সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক পদে যোগদান করেন। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণকারী পিতাকে গ্রামে পাঠিয়ে ছোট ভাইকে নিয়ে আসেন। এ ছাড়া গ্রামের অনেক অনাথ ছেলেও তাঁর বাসায় থেকে পড়াশোনা করতো। সংস্কৃত কলেজে অল্প সময়ে তিনি ধাপে ধাপে পদোন্নতি অর্জন করেন। প্রথমে সহকারী অধ্যাপক, পরে সংস্কৃতের অধ্যাপক ও শেষে কলেজের অধ্যক্ষের পদ অলঙ্কৃত করেন। তিনি ১৮৪৬ সালে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে একটি মূল্যবান প্রতিবেদন কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করেন। কলেজ কমিটির সম্পাদক রসময় দত্তের সঙ্গে বাদানুবাদের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সংস্কৃত কলেজ ছেড়ে ১৮৪৭ সালে আবার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে চলে আসেন। এই বছরেই তিনি সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটরি নামে একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন। সংস্কৃত কলেজ নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে ১৮৫০ সালে শিক্ষা সংস্কার ও কলেজ পুনর্গঠনের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে তাঁকে সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপকের পদে বরণ করে। তিনি ১৮৫১ সালে অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। এরপর তিনি সংস্কৃত কলেজের ব্যাপক সংস্কার করেন এবং ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন। সংস্কৃত কলেজে ব্রাহ্মণের সন্তানেরাই পড়ার সুযোগ পেতো। তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের সকল বর্ণের সন্তানদের পড়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। কলেজ ছুটি থাকতো প্রতিপদ ও অষ্টমী তিথিতে। তিনি এর পরিবর্তে রবিবার ছুটির দিন ঘোষণা করেন।

কর্মজীবনেই তাঁর সাহিত্যসাধনার শুরু। প্রথমে তিনি বাংলায় উন্নতমানের পাঠ্যপুস্তকের অভাব অনুভন করেন। এই সময় তিনি বহু বাংলা গদ্যগ্রন্থ রচনা করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনিই বাংলা গদ্য রচনার দিশারী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে বাংলা গদ্যের জনকের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। তাঁর গদ্য রচনা সম্পর্কে ঐতিহাসিক ড. সুকুমার সেন বলেন, ‘বিদ্যাসাগরের আগে গদ্যের চল ছিল চাল ছিল না।’ বিদ্যাসাগর বহু সংস্কৃত, ইংরেজি ও হিন্দি গ্রন্থের সফল অনুবাদ ও ভাবান্তর করেছিলেন। তাঁর অনূদিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে বিশেষ উল্লেখ্য হলো ‘রামায়ণ’ মহাকাব্য অবলম্বনে ‘সীতার বনবাস’, কবি ও নাট্যকার শেকসপীয়রের ‘কমেডি অব এররস’ অবলম্বনে ‘ভ্রান্তিবিলাস’, সংস্কৃত ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’র অনুবাদ ‘বেতাল পঁচিশ’ ও ‘কথামালার গল্প’ ইত্যাদি। তাঁর রচিত ‘বর্ণ পরিচয়’ প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগের কথা আগে বলেছি। এ ছাড়া ‘বোধোদয়’ ও ‘আখ্যানমঞ্জুরী’ আজও বাংলাভাষার গোড়াপত্তনে অপরিহার্য বিবেচিত হয়। তিনি কবি কালীদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ কাব্য অবলম্বনে বাংলা গদ্যে ‘শকুন্তলা’ রচনা করেন। এ ছাড়া তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। নিচে গ্রন্থপঞ্জিতে তা দেখা যেতে পারে।

গদ্য সাহিত্যের ভিত্তি স্থাপনের জন্য  বাংলাভাষাভাষীরা তাঁর কাছে যেমন ঋণী, তেমনি সমাজ সংস্কার, শিক্ষাবিস্তার, বিশেষ করে নারী শিক্ষা প্রসারে তাঁর মহান অবদানের জন্যও বাঙালি তাঁর কাছে অধিক বেশি ঋণী। কারণ, শেষোক্ত দুটো কর্ম সম্পাদনে তাঁকে বহু বাধার সম্মুখীন হতে হয়। একলব্যের মতো তিনি একাই সংগ্রাম করেন। মৃত্যু ও লাঞ্ছনার হুমকি গ্রাহ্য না করে তিনি লক্ষ্যভেদে অটল থাকেন। ১৮৪৯ সালে তিনি স্বদেশী কয়েকজন বিত্তবান ব্যক্তি ও বেথুন সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে নারীশিক্ষার সূত্রপাত করেন। ছোটলাট ফ্রেডারিক হ্যালিডে সাহেবের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি মেদিনীপুর, বর্ধমান, হুগলি ও নদীয়া জেলার নানা অঞ্চলে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সর্বমোট ২০টি মডেল স্কুল ও ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় গড়ে তুলেছিলেন।

বিদ্যাসাগরের মায়ের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধার গল্প এই দেশে কিংবদন্তির মতো প্রচারিত। তিনি মাকে দেবীর আসনে বসিয়েছিলেন। মায়ের আদেশে তিনি গ্রামে দাতব্য চিকিৎসালয় ও পূর্বে আলোচিত বিদ্যালয়গুলো স্থাপন করেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের চাকরিতে থাকাকালে তাঁর মা ছোট ভাইয়ের বিয়ের সংবাদ দেন এবং তাঁকে বাড়ি যাওয়ার আদেশ দেন। তিনি অধ্যক্ষের কাছে ছুটি চাইলে অধ্যক্ষ আবেদন না-মঞ্জুর করেন। মায়ের আদেশ অমান্য করা অসম্ভব বলে তিনি চাকরি ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। অধ্যক্ষ শেষাবধি ছুটি দিলে সেই রাতেই বাড়ি রওনা দেন। পথে প্রচণ্ড স্রোতস্বিনী দামোদর নদি। আবহাওয়া খারাপ। পারাপারের খেয়া বন্ধ। তিনি জীবন বাজি রেখে নদি সাঁতরে মায়ের কাছে পৌঁছান।

বিদ্যাসাগর ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে বন্ধু ও হিতৈষীদের সহযোগিতায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনের লক্ষ্যে ‘সর্বশুভঙ্করী সভা’র পত্তন করেন। ১৮৫০ সালের অগাস্টে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সহযোগিতায় বিদ্যাসাগর ‘সর্বশুভঙ্করী’ শিরোনামে সাময়িকী প্রকাশ করেন। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে ইংরেজ সিভিলিয়ানদের প্রাচ্য ভাষা শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠিত  ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ভেঙে বোর্ড অব একজামিনারস গঠিত হয়। বিদ্যাসাগরকে বোর্ডের সদস্য মনোনীত করা হয়। সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষের পদ ছাড়াও মাসিক অতিরিক্ত ২০০ টাকা বেতনে বিদ্যালয় পরিদর্শকের পদেও তিনি নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৮৫৫ সালে মফস্বলে স্কুল পরিদর্শনে যাওয়ার সময় বিদ্যাসাগর মহাশয় পাল্কিতে বসে ‘বর্ণ পরিচয়’-এর পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন। এই বছরের জুলাইয়ে বাংলা শিক্ষক প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে সংস্কৃত কলেজের অধীনে, ওই কলেজের সকালের সেশনে নরম্যাল স্কুল স্থাপন করেন। এই স্কুলে প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন অক্ষয়কুমার দত্ত। এই বছরেই তিনি পূর্বে বর্ণিত বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন সময়ে অন্য সকল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

এই বছরের অক্টোবর মাসে বিধবা বিবাহের সপক্ষে পর্যাপ্ত শাস্ত্রীয় প্রমাণসহ ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ বিষয়ক দ্বিতীয় পুস্তক প্রকাশ করেন। বিধবা বিবাহ আইনসম্মত করতে ব্রিটিশ সরকারের কাছে বহু স্বাক্ষর সংবলিত এক আবেদনও পাঠান। রাজা রাধাকান্ত দেব বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে আবেদন জানান। বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ রোধেও আইন প্রণয়নের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছিলেন। ১৮৫৬ সালের ১৬ জুলাই বিধবা বিবাহ আইন পাশ হয়। ৭ ডিসেম্বর কলকাতায় প্রথম বিধবা বিবাহ আয়োজিত হয়। অনুষ্ঠানের স্থান ১২ সুকিয়া স্ট্রীট, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। পাত্র প্রসিদ্ধ বাগ্মী রামধন তর্কবাগীশের ছোট ছেলে। সংস্কৃত কলেজের কৃতি ছাত্র ও অধ্যাপক এবং বিদ্যাসাগরের বন্ধু শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। পাত্রী বর্ধমান জেলার পলাশডাঙা গ্রামের ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বারো বছর বয়সের বিধবা কন্যা কালীমতী।

ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৩ সালে তাঁকে ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশনের পরিদর্শক নিযুক্ত করেন। ১৮৫৬ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। স্কুলে ৮-১৪ বছর বয়সী নাবালক জমিদারদের শিক্ষাদান করা হতো। ১৮৬৪ সালে এই প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে কলিকাতা মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন রাখা হয়। এই বছরের ৪ জুলাই ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটি তাঁকে সাম্মানিক সদস্য নির্বাচিত করে। ২ আগস্ট ফ্রান্সে অর্থাভাবে দুর্দশাগ্রস্থ মাইকেল মধুসূদন দত্তকে তিনি ১৫০০ টাকা পাঠান। কবি নবীনচন্দ্র সেনও যৌবনে বিদ্যাসাগরের অর্থে পড়াশোনা করেন।

১৮৬৭ সালে বাংলায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তিনি বীরসিংহ গ্রামে নিজ ব্যয়ে অন্নসত্র স্থাপন করেন। ছয় মাস দৈনিক ৪-৫ হাজার নরনারী ও শিশু অন্নসত্র থেকে অন্ন, বস্ত্র ও চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছিল। বিদ্যাসাগরের দানের ফিরিস্তি দেওয়া সম্ভব নয়। ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ যে কোনো ধরনের সমস্যায় পড়লে দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর যে কোনো মূল্যে তাদের উদ্ধার করতেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে মোহনদাস করমচাঁদ গাঁধি বলেছেন, ‘আমি যে দরিদ্র বাঙ্গালী ব্রাহ্মণকে শ্রদ্ধা করি তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।’ তাঁকে যথার্থ মূল্যায়ন করেছিলেন কবি শ্রী মধুসূদন। তিনি বিদ্যাসাগর সম্পর্কে লিখেছেন, ‘The genius and wisdom of an ancient sage. the energy of an Englishman and heart of a Bengali mother.’

বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জীবনের শেষ ১৮ বছর ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল পল্লী কার্মাটারে কাটিয়েছেন। কলকাতার তথাকথিত ‘সভ্যজগৎ’ থেকে তিনি স্বেচ্ছা নির্বাসনে গিয়েছিলেন। আত্মীয়-স্বজনের সংকীর্ণ মনোভাব ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে অসৌজন্যমূলক আচরণ তাঁকে ভীষণভাবে আহত করেছিল। কার্মাটারে তিনি একখণ্ড জায়গা কিনে একটি কুঁড়ে ঘড়ে বাস করতেন। তাঁর কুটিরের নাম ছিল নন্দনকানন। তিনি সাঁওতালদের দুঃখ-দুর্দশা দেখে বিচলিত হন এবং তা লাঘবে প্রয়াস নেন। তিনিই প্রথম সাওঁতাল মেয়েদের জন্য আনুষ্ঠানিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সমগ্র ভারত উপমহাদেশে সাঁওতালদের জন্য এটিই প্রথম স্কুল। তিনি সাঁওতালদের চিকিৎসার জন্য দাতব্য হোমিও চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। তিনি বয়স্ক সাঁওতালদেরও স্বাক্ষর করার চেষ্টা করেন। সাঁওতালরা তাঁকে ভগবান জ্ঞানে পূজা করতেন।

ক্রমেই তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে। প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে তাঁর চিকিৎসা হচ্ছিল  না। তিনি দুরারোগ্য লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হন এবং ১৮৯১ সালের  ২৯ জুলাই রাত ২টা ১৮ মিনিটে বাদুড়বাগানের বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তখন তাঁর বয়স ৭০ বছর ১০ মাস ৩দিন।

বিদ্যাসাগরের রচনাসমগ্র

১. বেতাল পঞ্চবিংশতি (১৮৪৭)
২. বাঙ্গালা ভাষার ইতিহাস, দ্বিতীয় ভাগ (১৮৪৮), মার্শম্যানের হিস্ট্রি অব বেঙ্গল অবলম্বনে রচিত
৩. জীবনচরিত (১৮৪৯)। উইলিয়াম ও রবার্ট চেম্বার্স রচিত খ্যাতিমান ইংরেজ মনীষীদের জীবনী অবলম্বনে রচিত
৪.বোধোদয়, শিশুশিক্ষা চতুর্থ ভাগ (১৮৫১)। রুডিমেন্টস অব নলেজ অবলম্বনে রচিত
৫. নীতিবোধ: প্রথম সাতটি প্রস্তাব (১৮৫১)। উইলিয়াম ও রবার্ট চেম্বার্সের মরাল ক্লাস বুক অবলম্বনে রচিত
৬. সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা (১৮৫১)
৭. ঋজুপাঠ: প্রথম ভাগ (১৮৫১), দ্বিতীয় ভাগ (১৮৫২), তৃতীয় ভাগ (১৮৫২)
৮.ব্যাকরণ কৌমুদি: প্রথম ভাগ (১৮৫৩), দ্বিতীয় ভাগ (১৮৫৩), তৃতীয় ভাগ (১৮৫৪)
৯. সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব (১৮৫৪)
১০.শকুন্তলা (১৮৫৪)। কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানম শকুন্তলম’ অবলম্বনে রচিত
১১. বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব-প্রথম পুস্তক (১৮৫৫)
১২. বর্ণ পরিচয়: প্রথম ভাগ (১৮৫৫), দ্বিতীয় ভাগ (১৮৫৫)
১৩. কথামালা (১৮৫৬)। ঈশপের কাহিনি অবলম্বনে রচিত
১৪ চরিতাবলী (১৮৫৬)
১৫.মহাভারত-উপক্রমণিকা ভাগ (১৮৬০)
১৬.সীতার বনবাস (১৮৬০)
১৭.ব্যাকরণ কৌমুদি: চতুর্থ ভাগ (১৮৬২)
১৮.বাখ্যানমঞ্জরী (১৮৬৩)
১৯.শব্দমঞ্জরী (১৮৬৪)
২০.ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯)
২১.বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার (১৮৭১)
২২.বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার-দ্বিতীয় পুস্তক (১৮৭৩)
২৩. অতি অল্প হইল (১৮৭৩)
২৪. আবার অতি অল্প হইল (১৮৭৩)
২৫. ব্রজবিলাস (১৮৮৪)
২৬. বিধবাবিবাহ ও যশোহর হিন্দুধর্মরক্ষিণী সভা (১৮৮৪)
২৭. রত্ন পরীক্ষা (১৮৮৬)
২৮. পদ্য সংগ্রহ: প্রথম ভাগ (১৮৮৮)
২৯. নিষ্কৃতিলাভ প্রয়াস (১৮৮৮)
৩০. সংস্কৃত রচনা (১৮৮৯)
৩১. পদ্য সংগ্রহ: দ্বিতীয় ভাগ (১৮৯০)
৩২. শ্লোক মঞ্জরী (১৮৯০)
৩৩. বিদ্যাসাগর চরিত (স্বরচিত, ১৮৯১)
৩৪. ভূগোল খগোল বর্ণনম (১৮৯২)

সম্পাদিত গ্রন্থ

১. অন্নদামঙ্গল (১৮৪৭)
২. কিরাতার্জ্জুনীয়ম (১৮৫৩)
৩, সর্বদর্শনসংগ্রহ (১৮৫৩-৫৮)
৪. শিশুপালবধ (১৮৫৩)
৫. রঘুবংশম (১৮৫৩)
৬. মেঘদূতম (১৮৫৯)
৭. কুমারসম্ভবম (১৮৬২)
৮.কাদম্বরী (১৮৬২)
৯. বাল্মীকি রামায়ণ (১৮৬২)
১০. উত্তম চরিতম (১৮৭২)
১১. হরষচরিতম (১৮৭৩)
১২. অভিজ্ঞানশকুন্তলম (১৮৮১)
১৩. পদ্যসংগ্রহ প্রথমভাগ (১৮৮৮, কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকে সংকলিত)
১৪. পদ্যসংগ্রহ প্রথমভাগ (১৮৯০, রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রচিত)
গ্রন্থ ও সম্পাদনার সূত্র: বিদ্যাসাগর রচনাবলী। তুলি ও কলম। জুন ১৯৬৭।                                                  

কৃতজ্ঞতা প্রকাশ

পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত বিদ্যাসাগর বিষয়ক প্রবন্ধ ও তাঁর সম্পর্কে ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত উপাত্তের সাহায্যে নিবন্ধটি রচিত

লেখক: শিক্ষাবিদ ও গবেষক


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়