ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

সুরের ঝরনাধারা

সাইফ বরকতুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০৮, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪   আপডেট: ১০:৩৬, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২
সুরের ঝরনাধারা

লতা মঙ্গেশকর। সংগীত জগতের এক জীবন্ত কিংবদন্তি। উপমহাদেশের জনপ্রিয়, নন্দিত গায়িকা। আজ (২৮ সেপ্টেম্বর) লতা মঙ্গেশকরের ৮৫তম জন্মদিন। ১৯২৯ সালের এই দিনে ব্রিটিশ-ভারতের ইন্দোরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ১৯৪৩ সালে লতা মঙ্গেশকরের সংগীত জীবনের যাত্রা শুরু হয়।


দীর্ঘ ৭ দশকের মিউজিক ক্যারিয়ারে অন্তত ৩০ হাজার গানে কণ্ঠ দিয়েছেন ‘নাইটিঙ্গেল অফ ইন্ডিয়া’ খ্যাত এই শিল্পী। জীবনের এতটা পথ পাড়ি দিয়ে আজও তার কণ্ঠমাধুর্য বিমোহিত করে চলেছে অগণিত ভক্ত-শ্রোতাদের। এক হাজারের বেশি ভারতীয় ছবিতে গান করেছেন তিনি। ভারতের ২০টি আঞ্চলিক ভাষাতেও গান গাওয়ার একমাত্র রেকর্ডটি তারই। বাংলা গানেও তার অবদান কম নয়; গেয়েছেন অনেক গান।


ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান ভারতরত্ন পাওয়া তিনিই দ্বিতীয় সংগীতশিল্পী। কৃষ্ণপ্রেমে সমর্পিত লতা মঙ্গেশকর বিশ্বাস করেন, ভালোবাসা পাওয়াটাই জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। মায়ের মুখে তিনি শুনেছিলেন, দুঃখ যতো বাড়বে, ততোই উজ্জ্বলতর হয়ে ওঠে শিল্প। মায়ের এ কথা তার নিজের জীবনেও কি প্রভাব ফেলেনি?
শৈশবে বাড়িতে থাকাকালীন কে. এল. সায়গল ছাড়া আর কিছু গাইবার অনুমতি ছিল না তার। বাবা চাইতেন লতা মঙ্গেশকর শুধু ধ্রুপদী গান নিয়েই থাকুক। জীবনে প্রথম রেডিও কেনার সামর্থ্য যখন হলো, তখন তার বয়স আঠারো। কিন্তু রেডিওটা কেনার পর নব ঘুরাতেই প্রথম যে খবরটি তাকে শুনতে হয় তা হচ্ছে- কে. এল. সায়গল আর বেঁচে নেই। সঙ্গে সঙ্গেই রেডিওটা ফেরত দিয়ে দেন তিনি।


মারাঠি একটি গানের মধ্য দিয়ে ১৯৪২ সালে মিউজিক ক্যারিয়ার শুরু করেন লতা মঙ্গেশকর। তার গাওয়া প্রথম হিন্দি গান ১৯৪৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আপ কি সেবা মে’ চলচ্চিত্রে ‘পা লাগু কার জোরি’। সেই থেকে শুরু। ভারতীয় চলচ্চিত্রে সংগীতকে তিনি একাই অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। ভারতীয় আরেক কিংবদন্তি অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন তার কণ্ঠকে তুলনা করেছেন ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে। যার তুলনা শুধু তিনি নিজে। সুতরাং এটা বলাই যায়, লতা মঙ্গেশকরের যত প্রশংসাই করা হোক না কেন তা কম হবে। শুধু ভারত নয় সমগ্র উপমহাদেশে লতা মঙ্গেশকর আর দ্বিতীয়টি নেই।


সঙগীত ছাড়াও ফটোগ্রাফিতে আগ্রহ আছে তার। ছবি তুলতে ভালোবাসেন।  রান্না করতেও  পছন্দ করেন। এছাড়া বই পড়তেও খুব ভালোবাসেন তিনি। নানান সময়ে তার গানগুলো যেমন আলোচিত হয়েছে তেমনি হয়েছে জনপ্রিয়। তার কণ্ঠের কত গানের জনপ্রিয়তায় যে কতশত হিন্দি চলচ্চিত্র ‘সুপার হিট’-এর তকমা পেয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তার কণ্ঠে যে শুধু গানই উঠেছে তা নয়, তার গানের মধ্যে যে মমত্ববোধ তা সবসময়ই ছুঁয়ে গেছে শ্রোতার হৃদয়।


লতা মঙ্গেশকর তার কণ্ঠের মন্ত্রমুগ্ধতা ছড়িয়ে রেখেছেন সমগ্র সংগীত জগতে। সুরের ছন্দে মুখর সেই কণ্ঠ আজো সবার হৃদয়ে ভালোলাগার দোলা দিয়ে যায়। আর এ কারণেই ভারতীয় সংগীতে তিনি এখন আর একজন কণ্ঠশিল্পী নন, একটি প্রতিষ্ঠানও বটে। সুদীর্ঘ ধারাবাহিকতা, শিল্পের প্রতি নিষ্ঠার কারণে তিনি শুধুমাত্র উঠতি শিল্পীদের কাছেই নয়, প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের কাছেও অনুপ্রেরণা। বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী সোনু নিগম লতা মঙ্গেশকর সম্পর্কে  বলেছেন, আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা লতাজির সময়ে জন্মেছি। তিনি আমাদের কাছে সংগীতের দেবী। তিনি শুধু আমাদের প্রজন্মের কাছেই নয়, আগামী প্রজন্মেরও অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন।
সংগীতশিল্পী শ্রেয়া ঘোষাল বলেছেন, লতাজি আমার শিক্ষক, আমার অনুপ্রেরণা। আর লতাজির জন্যই তো আমি গান এত ভালোবেসেছি। জগতের সমস্ত খুশি তার জন্মদিনে উপহার দিতে ইচ্ছা হয় আমার।


সুদীর্ঘ সংগীত জীবনে অসংখ্য গানের মধ্যে ঢেলে দিয়েছেন সুরের ঝরনাধারা। ১৯৭৪ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত বিশ্বে সর্বাধিক গান রেকর্ড করার জন্য গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস-এ নাম ওঠে তার। শুধু সংগীত শিল্পীদের কাছেই নয় বলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রী ও সিনেমা নির্মাতাদের কাছেও ভারতরত্ন লতার কণ্ঠের আবেদন আকাশচুম্বী। দশকের পর দশক তার সুরেই যে প্রাণ পেয়েছে হিন্দি গান। অভিনেত্রী দিয়া মির্জা বলেছেন, আমি মনে করি লতাজি যে অভিনেত্রীর জন্য গান করেন সেটা ওই অভিনেত্রীর কাছে আশীর্বাদস্বরূপ। কারণ আমরা সবাই জানি কি অসাধারণ প্রতিভা লতাজির রয়েছে।



লতা মঙ্গেশকর ভারতে জন্মগ্রহণ করেছেন বলে গর্বিত চলচ্চিত্র নির্মাতা যশ চোপড়া। যেভাবে লতাজি অক্লান্তভাবে গান গেয়ে চলেছেন তা সারা বিশ্বেই নজিরবিহীন বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। যশ বলেছেন, আমার প্রথম সিনেমা ‘ধুল কা ফুল’ থেকে ‘বীরজারা’ পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচ দশক লতাজির সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি।
উপমহাদেশের কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী কুন্দন লাল সায়গল বা কে এল সায়গলকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখতেন এই সুর সম্রাজ্ঞী। বালিকা বয়সে যখন গুনগুন করে গাইতেন, তখন প্রায় সারাক্ষণই তার কণ্ঠে থাকত কে এল সায়গলের গান। সে সময় কে এল সায়গল ছিলেন গানে এবং অভিনয়ে মুম্বাই চলচ্চিত্র জগতের মধ্যমণি। তার গান গাইতে গাইতেই মনের অজান্তে কে এল সায়গলের প্রতি ভালোলাগা তৈরি হয়। সেখান থেকেই ভালোবাসার সূচনা।


নাসরিন মুন্নি কবিরের লেখা ‘লতা মঙ্গেশকর : ইন হার ওন ভয়েস’ শিরোনামে লেখা বই থেকে এ তথ্য জানা যায়। সেখানে লতা মঙ্গেশকর স্বীকার করেছেন তার বালিকা বয়সের এই স্বপ্নের কথা। এই বইয়ে তিনি বলেছেন, ছোটবেলায় ভালো লাগা আর ভালোবাসার মানুষটির নাম ছিল কে এল সায়গল। কী অসাধারণ কণ্ঠ তার। সারাক্ষণই ভাবতাম, ওহ্ একবার যদি সায়গল সাহেবের দেখা পেতাম! আরো ভাবতাম, বড় হলে আর কাউকে নয়, কেবল তাকেই বিয়ে করব। শুধু ভাবতাম নয়, অনেক সময় বলেও ফেলতাম মনের এই ইচ্ছের কথা। বাবা কৌতুক করে বলতেন, তুই যখন বড় হবি, তখনতো সায়গল বুড়ো হয়ে যাবেন। তুই সেই বুড়োকেই বিয়ে করবি! আমি বলতাম, হোকগে বুড়ো! আমি সায়গলকেই বিয়ে করব।


পদ্মভূষণ, পদ্মবিভূষণ, ভারতরত্ন, দাদা সাহেব ফালকেসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন এ কিংবদন্তি শিল্পী। আজ জন্মদিনে তার কর্ম, সাধনার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাসহ তাকে প্রণতি জানাই।  


 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪/সাইফ/তাপস

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়