ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

পাভেল রহমানের ক্যামেরায় বঙ্গবন্ধু

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০৯, ১৭ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১৬:৫৩, ১৭ মার্চ ২০২১

চোখের দেখা আর দেখার চোখ এক জিনিস নয়। বেশিরভাগ মানুষেরই দেখা হচ্ছে, চোখের দেখা। কিন্তু দুই চারজন অসাধারণ মানুষের দেখা মানে চোখের দেখা নয়। তারও বেশি কিছু। তারা দেখেন ভেতরের চোখ দিয়ে। দেখার এই ফারাকের কারণেই তারা হয়ে ওঠেন আলাদা, শিল্পী। তেমনি এক শিল্পী, যিনি জীবনের অনেক কিছু দেখেছেন, দেখছেন ক্যামেরার চোখ দিয়ে। যার জীবনে রয়েছে অনেক বিরল ঘটনা। ঐতিহাসিক অনেক কিছুর সঙ্গে জগিয়ে রয়েছে তার ক্যামেরা। আছেন তিনিও।

একজন পাভেল রহমান। রংপুরের ছেলে। শখের বশে বাবার ক্যামেরা দিয়ে ফটোগ্রাফি চলছিল তার। তিনি তখন ১৬ বছরের টগবগে তরুণ। চোখে স্বপ্ন আর বুকে বিশ্বাস নিয়ে স্বাধীন দেশের রাজধানীতে চলে আসেন। সম্বল কেবল একটা ক্যামেরা। তাও পুরনো। শুরু হয় স্বাধীন দেশে পাভেল রহমানের বেঁচে থাকার যুদ্ধ। সেটা ৭২ সালের গল্প।  

৭২ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনসভায় তিনি খুব কাছ থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের  ছবি তোলেন। সেটা যেমন তেমন ছবি নয়।  বঙ্গবন্ধুর খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছে দুটি ছিন্নমূল শিশু। সেই ছবি পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর সবার নজরে পড়েন পাভেল রহমান। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল তাকে ডেকে পাঠান। আবাহনী ক্লাবের অফিসিয়াল ফটোগ্রাফার হিসেবে নিয়োগ দেন। এসময় শেখ কামালের সঙ্গে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সূত্র ধরে পাভেল রহমানের অবাধ যাতায়াত শুরু হয় ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে।

বঙ্গবন্ধুর বাড়ির অবাধ যাতায়াতের সুবাদে একদিন তিনি বঙ্গবন্ধুকে চিরন্তন বাঙালির ঘরোয়া পোশাকে পেয়ে যান। লুঙ্গি আর সেন্ডো গেঞ্জি পরে পাইপ টানছিলেন জাতির পিতা। ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারেননি পাভেল। মুহূর্তে ক্যামেরা তাক করে সার্টার টিপে দেন। ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলোতে চমকে ওঠেন জাতির জনক। দূর থেকেই গম্ভীর গলায় বলেন, ‘কে রে তুই, আমার ছবি তুললি?’ পাভেল রহমান কাছে গিয়ে পরিচয় দেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর চেহারায় কোনো পরিবর্তন আসে না। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা ছবি তোলার জন্য তোর শাস্তি হবে!’

শাস্তির কথা শুনে পাভেল রহমান ভয় পেয়ে যান। নিচের দিকে তাকিয়ে থাকেন। বঙ্গবন্ধু তার কাছে গিয়ে দাঁড়ান। বলেন, ‘এখন আমি পাঞ্জাবি পরবো, তুই আমার সুন্দর একটা ছবি তুলে দিবি। এটাই তোর শাস্তি!' এরপর হেসে দেন বঙ্গবন্ধু। পাভেল রহমানেরও ভয় কেটে যায়। সেদিনের পর থেকে জাতির জনকের পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের অসংখ্য ছবি তুলেছেন পাভেল রহমান। বিশেষ করে, বড় ছেলে শেখ কামালের বিয়ের সময়ের শেখ মুজিব ও বেগম মুজিবের রঙ খেলার ছবিগুলোর কথা এতদিন পরেও তার মনে জ্বলজ্বল করছে।

জাতির জনকের ব্যক্তিগত, পারিবারিক অনেক ঐতিহাসিক ছবির সঙ্গে জড়িয়ে আছে পাভেল রহমানের হাজারো স্মৃতি। বেশ কিছু অপ্রকাশিত ছবিও রয়েছে বলে জানান তিনি। জানালেন, অচিরেই সেসব ছবি সবার সামনে নিয়ে আসবেন। ৭২ থেকে ৭৫—এই সময়ে বঙ্গবন্ধু পরিবার এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে আবেগে গলা কেঁপে ওঠে তার। কেবল বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের ছবিই নয়, অনেক বিখ্যাত ছবির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন পাভেল রহমান।  এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ৯০-এর গণ উভ্যুত্থানের সময়ের নূর হোসেনের পিঠে রঙ দিয়ে লেখা,  ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ ছবিটি। এছাড়া, রয়েছে ৯১ সালের সাইক্লোনের ভয়াবহ বেশ কিছু ছবি।।

জীবনের অনন্য সাধারণ বেশ কিছু ছবি এবং ছবির পেছনের গল্প নিয়ে পাভেল রহমানের বই ‘সাংবাদিকতা আমার ক্যামেরায়’ প্রকাশ পায় ২০১৬ সালে। মাওলা ব্রাদার্স প্রকাশ করে ৪০০ পৃষ্ঠার এই বইটি। যার মূল্য ১হাজার ৫০০ টাকা। এই বই প্রকাশের ক্ষেত্রে পাভেল রহমান অনেককে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন। এর মধ্যে রয়েছেন, অভিনেতা আফজাল হোসেন, স্পন্সর প্রতিষ্ঠান মাত্রা ও মাওলা ব্রাদার্সের আহমেদ মাহমুদুল হককে। যাদের সহযোগিতা না পেলে তার এই বইটি প্রকাশ পেতো না বলেও জানান তিনি। ২০১৭ সালে যে বইয়ের জন্য পাভেল রহমান বাংলা একাডেমি প্রবর্তিত শহীদ মুনীর চৌধুরী পুরস্কার লাভ করেন। 

/এনই/

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়