ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বগুড়া বিআরটিএ: ‘নো দালাল, নো সার্ভিস’ 

এনাম আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:১৬, ১৫ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ০৮:০৯, ১৬ জানুয়ারি ২০২১
বগুড়া বিআরটিএ: ‘নো দালাল, নো সার্ভিস’ 

বগুড়া বিআরটিএ অফিসের সামনে লাইসেন্সপ্রার্থীরা

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)-এর বগুড়া অফিস দালালের আখড়ায় পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন সেবাপ্রার্থীরা। তারা বলছেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে এসে প্রায় প্রতারণার শিকার হতে হচ্ছে। এই অফিসে দালাল ছাড়া কোনো কাজই হয় না। এখানে অনেকটা ‘নো দালাল, নো সার্ভিস’ নীতিতেই চলে। অভিযোগ রয়েছে—পিওন থেকে শুরু করে কর্মকর্তারাও মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে এসব দালালকে প্রশ্রয় দেন। তবে, এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

নিয়ম অনুযায়ী, শুধু মোটরসাইকেল অথবা শুধু হালকা মোটরযানের লার্নার ড্রাইভিং লাইসেন্স ফি ৩৪৫ টাকা। মোটরসাইকেল ও হালকা মোটরযানের লার্নার ড্রাইভিং লাইসেন্স ফি ৫১৮ টাকা। স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ৫ বছর মেয়াদি পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স ফি ১৬৮০ টাকা। ১০ বছর মেয়াদি অপেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ব্যাংকে জমা দিতে হয় ২ হাজার ৫৪২ টাকা।

চলতি বছরের (২০২১) ১০ জানুয়ারি (রবিবার) থেকে ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত বিআরটিএ অফিস ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ সেবাপ্রার্থীকে দালালের খপ্পরে পড়তে হচ্ছে। কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ টার্গেটে পরিণত হয়ে এমন খপ্পরে পড়ছেন। যে কারণে সরকারের বেঁধে দেওয়া চার্জের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে সেবাপ্রার্থীদের। দালালদের মাধ্যমে যারা লাইসেন্স করছেন, তাদের মোটরসাইকেলের লাইসেন্সের গুনতে হচ্ছে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা, মোটরসাইকেল ও হালকা মোটরযানের জন্য জন্য দিতে হচ্ছে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ১০ হাজার টাকারও বেশি দিতে হচ্ছে। 

নির্ভরযোগ্য-সূত্র বলছে, দালালরা সেবাপ্রার্থীদের কাছ থেকে পরীক্ষা পর্যন্ত কাজের দ্বিগুণেরও বেশি টাকা নিচ্ছে। তবে, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে আলাদাভাবে মোটরসাইকেলের জন্য দালালরা নেয় ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা। এরপর অফিসে জমা দেন ১ হাজার ৫০০ টাকা। মোটরসাইকেল ও হালকা মোটরযানের জন্য নিচ্ছেন ৩ হাজার টাকা। অফিসকে দিচ্ছেন ২ হাজার টাকা। আর পেশাদার লাইসেন্সের জন্য নেন ২ হাজার ৫০০ টাকা। 

অভিযোগ রয়েছে, দালালদের ৩ হাজার টাকা দিয়ে অফিসে লার্নার জমা দিলে আর পরীক্ষাও দিতে হয় না। শুধু নাম রোল নম্বর দিলেই পরীক্ষার পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্সপ্রার্থীরা পাসের স্লিপ নিয়ে ব্যাংকে টাকা জমা দিতে পারেন। এরপর ফিংগার প্রিন্ট করতে আরও ৫০০ টাকা দিতে হয়। প্রতিদিন দুই শতাধিক সেবাপ্রার্থী লাইসেন্সের জন্য পরীক্ষা দিতে আসেন। এর মধ্যে পাস করেন হাতেগোনা ১৫ থেকে ২০জন। পরীক্ষায় উপস্থিত হন প্রতিদিন গড়ে ২২০ জন। সে অনুযায়ী অকৃতকার্য সেবাপ্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ২০০ জনে। এই ২০০ জনের সিংহভাগই পাস করার জন্য দালালদের ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত দিয়ে থাকেন। দালালরা সেখান থেকে নিজেদের অংশ কেটে ১ হাজার ৫০০ টাকা বিআরটিএ অফিসে দেয়। এভাবেই পরীক্ষার মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে এই অফিসের কর্মকর্তারা দালালদের মাধ্যমে আয় করেন ৩ লাখ টাকারও বেশি।  

বিআরটিএ অফিসের ভেতরে ও মূল ফটকের সামনে প্রতিদিন শফিক, সবুজ, আব্দুল গনি, সেলিম হাসানসহ কয়েকজনকে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। মূলত এই ব্যক্তিরাই লাইসেন্সপ্রার্থীদের কাছ থেকে সরকারি নির্ধারিত ফি’র চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি টাকা নিয়ে লাইসেন্স করে দেন। 

তবে, বিআরটিএ বগুড়া অফিসের সহকারী পরিচালক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই ব্যক্তিদের মধ্যে মাত্র আব্দুল গনি ও সেলিম হাসান তার অফিসে চাকরি করেন। বাকিদের তিনি চেনেন না। বিআরটিএ বগুড়ার ওয়েব সাইটে কর্মরত ১০ স্টাফের মধ্যে আব্দুল গনির নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে, তিনি রীতিমতো অফিসের চেয়ার টেবিলে বসে কাজ করেন।

এদিকে, রাজশাহীর স্বাস্থ্য বিভাগে চাকরি করেন রাসেল তালুকদার। বগুড়া বিআরটিএ অফিসে এসেছেন মোটর সাইকেলের ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য। করোনার আগে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করলেও এখনো তার ফিংগার প্রিন্ট সম্পন্ন হয়নি। এই পর্যন্ত তিনি ৫ বার ফিংগারপ্রিন্টের জন্য বগুড়ার এই অফিসে এলেন। 

সর্বশেষ ২ জানুয়ারি বগুড়ার বিআরটিএ অফিসে লাইসেন্সপ্রার্থীদের ফিংগারপ্রিন্ট করা হয়েছে। এরপর থেকে সার্ভার জ্যামসহ যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এই মুহূর্তে আর কারোই ফিংগারপ্রিন্ট নেওয়া হচ্ছে না। তাই রাজশাহীতে ফিরে যাচ্ছেন তিনি। কবে নাগাদ তার ফিংগারপ্রিন্ট হবে—এর দিনক্ষণ জানতে পারেননি। তিনি কোনো দালাল ধরে লাইসেন্সের আবেদন করেননি। যে কারণে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তার লার্নার ও ব্যাংকে জমা দেওয়ার জন্য খরচ পড়েছে প্রায় ৩ হাজার টাকা। বিআরটিএ অফিসের একজন দালালের সঙ্গে তার পরিচয় আছে। ওই দালাল মোটরসাইকেল ড্রাইভিং লাইসেন্সের থিওরিক্যাল ও প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় পাস করে দেওয়াসহ সবকিছু করে দেয়। শুধু ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা তার হাতে গুঁজে দিলেই আর চিন্তা নেই। এ কারণেই তিনি ২ হাজার টাকা দিয়ে নিশ্চিন্তে ছিলেন। এরপরও তাকে রাজশাহী থেকে বারবার বগুড়ায় আসতে হচ্ছে। এছাড়া, বগুড়ার শাকপালা এলাকার আরিফুল ইসলাম গত বছরের অক্টোবরে দালালের মাধ্যমে ৭ হাজার টাকার বিনিময়ে লাইসেন্সের আবেদন করেছেন। তার নম্বর প্লেটের জন্য খরচ পড়েছে ১৪ হাজার ৮০০ টাকা। এখনো তিনি লাইসেন্স পাননি। কবে নাগাদ লাইসেন্স পাবেন, তাও জানেন না। যার মাধ্যমে তিনি লাইসেন্সের আবেদন করেছেন, সেই দালাল ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়েছে। 

বগুড়ার মাটি ডালি এলাকার সোলায়মান আলী তার চাচার ৫০ সিসির মোটরসাইকেলের নম্বর প্লেট হাতে পেয়েছেন ১১ জানুয়ারি। তিনি জানান, এই নম্বর প্লেট করতে তার খরচ পড়েছে ৯ হাজার টাকা। টাকা তিনি ব্যাংকে জমা দিয়েছেন।  নম্বর প্লেট হাতে নেওয়ার সময় অফিসকে আরও ৩০০ টাকা দিতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এখানে দালাল ছাড়া কোনো কাজ হয় না। এখানে অনেকটা নো দালাল নো সার্ভিসনীতিতে চলছে সব কাজ কর্ম।’

কারচালক বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার জাহিদুল ইসলাম জানান, তার ড্রাইভিং পরীক্ষা ছিল জানুয়ারির ৬ তারিখে। কিন্তু তিনি ৬ তারিখে পরীক্ষায় হাজির হতে পারেননি। গত বছরের নভেম্বর মাসে তিনি ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য দালালকে মাধ্যম করে আবেদন করেন। তিনি দালালের মাধ্যমে লাইসেন্স নিতে চাননি। তাই সরাসরি অফিস থেকে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কিভাবে পাবেন, জানতে চাইলে একজন ৫ নম্বর কক্ষ দেখিয়ে দেন। এরপর সেই কক্ষ থেকে তাকে ফটোস্ট্যাট ও কম্পিউটার দোকানে পাঠানো হয়। সেখানে লাইসেন্স করানোর জন‌্য ৯ হাজার টাকা দাবি করে একজন দালাল। তিনিও রাজি হয়ে যান। পরীক্ষায় উপস্থিত হতে না পারায় দালাল জানায়, বিআরটিএ অফিসে আসতে হবে।  তবে, পরীক্ষা দিতে হবে না, শুধু আর কিছু টাকা দিতে হবে।

১১ জানুয়ারি মঙ্গলবার অফিস কক্ষের বাইরে মোটরসাইকেলের ফিটনেস দেখছিলেন মোটরযান পরিদর্শক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. হাসান। মোটরসাইকেলের ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে কত টাকা লাগবে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আগে প্রশ্ন করতে শিখুন, তারপর প্রশ্ন করুন, কী জানতে চান বলুন।’। এরপর তিনি ৫ নম্বর কক্ষে গিয়ে যোগাযোগ করতে বলেন। ৫ নম্বর কক্ষে গিয়ে দেখা গেলো, সেখানে সারি সারি মানুষ। ওপরে লেখা হেল্প ডেস্ক। তবে, হেল্প ডেস্কে কেউ ছিলেন না। ঘণ্টাখানেক পর একজন এলেন। আর তখনই হুমড়ি খেয়ে সবাই তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। মোটরসাইকেলের ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে কী কী কাগজপত্র লাগবে—এই প্রতিবেদক জানতে চেয়েও কোনো উত্তর পায়নি। 

একসময় চেয়ারে বসা লোকটি বললেন, ‘আপনার আগে লার্নার নিতে হবে। এজন‌্য পাশের কোনো ফটোকপি ও কম্পিউটারের দোকান থেকে লার্নার সংগ্রহ করতে হবে। ’ তার কথামতো একটি কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে লার্নারের বিষয়টি বলতেই দোকানের বাইরে থেকে একজন লোক বললেন, ‘মোটর সাইকেলের লাইসেন্স করবেন? আপনার নম্বর করা আছে? আমার সঙ্গে আসুন। সব করে দিচ্ছি।’ সঙ্গে যাওয়ার পর তিনি বলেন, ‘মোটরসাইকেলের লাইসেন্স করতে ৭ হাজার টাকা লাগবে। আর কাজ করে দেওয়ার জন‌্য আমাকে ৫০০ টাকা দিতে হবে। ’

এদিকে, মেকানিক্যাল অ‌্যাসিসটেন্ট সেলিম হাসানের কাজ গাড়ির ফিটনেস চেক করা। গাড়ির ফিটনেস চেক করার নিয়ম হলো গাড়ি দেখে তারপর ছাড়পত্র দেওয়া। কিন্তু ২০০ টাকা দিলেই কাগজপত্র না দেখেই তিনি ফিটনেস ছাড়পত্র দেন। শুধু কাগজপত্র দেখেই তিনি গাড়ির ছাড়পত্র দিয়ে দেন। বড় ট্রাক, বাস, কার, মাইক্রোবাসের ফিটনেস পরীক্ষা করেন মোটরযান পরিদর্শক এসএম সবুজ ও পরিদর্শক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. হাসান। অভিযোগ আছে, যিনি গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করাবেন, তার কাছে থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেন তারা। 

অভিযোগের বিষয়ে বগুড়া বিআরটিএ সহকারী পরিচালক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ‘বগুড়ার অফিসে স্থায়ী স্টাফ ১০ জন। চুক্তিভিত্তিক কোনো স্টাফ নেই। উল্লিখিত ব্যক্তিদের মধ্যে শুধু আব্দুল গনি ও সেলিম হাসান কাজ করেন। বাকিদের চিনি না। শফিককে চিনি।’ 

‘বিআরটিএ অফিসে দালালের উৎপাত কমানো গেছে?’—এমন প্রশ্নের উত্তরে সৈয়দ মেজবাহ বলেন, ‘কিছু লোক তো আসে। মোটরসাইকেলের শোরুম থেকে অনেকেই প্রতিনিধি হিসেবে আসেন। ’ 

‘আপনাদের সুবিধার জন‌্যই নাকি দালালদের প্রশ্রয় দেন’—এমন অভিযোগের বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। বিআরটিএ’র এই সহকারী পরিচালক। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন ২ শতাধিক লাইসেন্সপ্রার্থী পরীক্ষা দেন।’ মোটরসাইকেলের ড্রাইভিং লাইসেন্সের পরীক্ষায় অকৃতকার্যদের কাছ থেকে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকা নিয়ে পাস করিয়ে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে মোটরযান পরিদর্শক এসএম সবুজসহ যারা পরীক্ষা নেন, তারাই ভালো বলতে পারবেন।’ তবে, দালালের মাধ‌্যমে অবৈধভাবে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায়ের অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন। 

 বগুড়া/এনই 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়