ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

লালমনিরহাট থেকে ধীরে ধীরে উত্তরাঞ্চলে ছড়াচ্ছে তামাক চাষ

ফারুক আলম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৫, ১৯ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৩:০৫, ১৯ জানুয়ারি ২০২১
লালমনিরহাট থেকে ধীরে ধীরে উত্তরাঞ্চলে ছড়াচ্ছে তামাক চাষ

লালমনিরহাট জেলায় তামাকের চাষ হচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে। এই জেলার আদিতমারী, হাতিবান্ধা উপজেলায় তামাক চাষ উদ্বুদ্ধ করণের জন্য কম্পানিগুলো তাদের শাখা খুলেছে। এখান থেকেই কম্পানিগুলো তাদের বিষদৃষ্টি পাশের জেলাগুলোতে সম্প্রসারণ করেছে। কম্পানির ফাঁদে পড়ে উঠোনবাড়িতেও তামাকের চাষ হচ্ছে। 

রংপুরের গঙ্গাচরা, কাউনিয়া এবং একেবারেই নতুন করে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার কৃষকদের মাধ্যমে তামাক চাষে সফল হয়েছে। এখন সেখানকার দেশীয় ফসল আলু, কলা, তিল-তিসী এমন কি ধানী জমিতেও তামাকের বিষাক্ত ঘ্রাণ বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে।

ফুলবাড়ি উপজেলার মিয়া পাড়া এলাকার কৃষক হাসান বলেন, তাদের অঞ্চলে এখন তামাকের ভালো ফলন হচ্ছে। এখন সব থেকে লাভজনক ফসল তামাক। আগেই কম্পানি খরচ দেয়। যার ফলে তারা তামাক চাষ করছেন। তারা শ্রমবাজার নিরুপণ করেননি। তামাক চাষে যে শ্রম ব্যয় হয়, সে তুলোনায় লাভ যে কম, তারা তা হিসেব করেননি।

আব্দুল করিম জানান, তাদের অঞ্চলে তামাক চাষ ছিলই না। গত ৪ থেকে ৫ বছর থেকে তামাকের চাষ হচ্ছে। দিনকে দিন তামাক চাষে ঝুঁকে পড়ছে মানুষ।

সরেজমিনে দেখা যায়, তামাক চাষে উদ্বুদ্ধ করণের জন্য সেই সব এলাকায় কোনো কেন্দ্র নেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নাওডাঙা নামক স্থানে কোম্পানির প্রতিনিধিরা অস্থায়ীভাবে বসে। সেখান থেকেই তারা কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে। সেখান থেকেই তারা কৃষকদের আগাম সার, বীজ, টাকাসহ সকল সুবিধা দিয়ে আসছে। অনেকটা দাদন ব্যবসা বা নব্য নীলকরের আবির্ভাব।

নারায়ন চন্দ্র বর্মণ (প্রাণিবিদ্যা) জানান, তামাক চাষ শুধু পরিবেশের ক্ষতিই করে না, যে ঘরে তামাক রাখা হয়, সেই ঘরে এ্যাজমা বা এ জাতীয় কোনো রোগী থাকলে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তামাক যে কোনো প্রাণির জন্যই ক্ষতিকর। তামাক পাতা শুকানোর পরে যে ধুলো থাকে, সেখান থেকে লিভার সিরোসিস, সিলোকোসিলের মত মারাত্মক মরণব্যাধি হতে পারে। যে রোগে মৃত্যু নিশ্চিত।

খোদ কৃষি বিভাগের একটি একটি সুত্র বলছে, তামাক চাষ বন্ধে সরকারের পক্ষ থেকে সরাসরি বাধা প্রদান করা হচ্ছে না। তামাকের সাথে আমদানি-রফতানি জড়িত। এখানে রাজস্বের একটি বিষয় জড়িত।

কৃষি বিভাগের আর একটি সুত্র জানাচ্ছে, গেল বছর দশটি করে সূর্যমুখী চাষের প্রদর্শনী প্লট করা হয়েছিল। যার প্রেক্ষিতে এবার সূর্যমুখীর বীজ বিতরণ করা হয়েছে। বিপুল সংখ্যক কৃষকদের সূর্যমুখী চাষে সম্পৃক্ত করা হয়েছে।

আরও দাবি করছে, সূর্যমুখীর বীজ ক্রয় করার মত কোনো ব্যবসায়ী গেলো বছর ছিল না। ভুট্টা, সূর্যমুখীর মতো ফসলের ক্রয় কেন্দ্র গড়ে উঠলে বা বিক্রির নিশ্চয়তা থাকলে তামাক চাষ থেকে সরে আসবে কৃষক।

রায়হান শরীফ জানান, ভুট্টা, সূর্যমুখীর মতো ফসলগুলি তামাকের মতো প্রাণিকূলের জন্য ক্ষতিকর নয়। বরং ভুট্ট, সূর্যমুখীর মতো ফসলগুলি জীববৈচিত্রের জন্যই প্রয়োজন। তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, সূর্যমুখীর বিজ বিলুপ্ত টিয়াসহ অনেক পাখির প্রিয় খাবার। আবার ভুট্টার সকল কিছুই পোল্ট্রি, মাছ, ডেইরিতে ব্যবহার করা যায়। দেশের বড় বড় কম্পানিগুলো যদি এসব ফসলে আমাদানী নির্ভর না হয়ে এলাকাভিত্তিক কাজ করতো, তাহলে সবদিক থেকেই উপকৃত হতো পরিবেশ। তবে, কৃষকের এসব ফসল বিক্রির নিশ্চয়তা প্রদান এখন সময়ের দাবি।

রংপুরের গঙ্গাচরা কৃষি কর্মকর্তা মো. মশিউর রহমান বলেন, বরাবরের মতো তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। অন্যান্য ফসলে আগ্রহী করা হচ্ছে। এই সময়ে ভুট্টা, সূর্যমুখী চাষ করা যায়। তামাক চাষের বড় সমস্যা হচ্ছে, তামাক কোম্পানিগুলো কৃষকদের নগদ অর্থ থেকে সব রকম সহযোগিতা করে চাষে উদ্বুদ্ধ করছে। যার ফলে তামাকের চাষ যতোটা কমার কথা সেভাবে কমছে না। সূর্যমুখীর মতো নতুন ফসলগুলোকে এক্সটেনশন করতে হবে। ভুট্টা যেমন অনেকটাই এগিয়েছে। সূর্যমুখী, ভুট্টার স্থায়ী ক্রেতা তৈরি করতে পারলে, তামাক থেকে সরে আসবে কৃষক। ক্রয় কেন্দ্র তৈরি হলে, নতুন ব্যবসা গড়ে উঠবে। তখন কৃষকদের উৎপাদিত এসব ফসল বিক্রি করতে সমস্যা হবে না।

তবে, কোনো তামাক চাষীকে তামাক চাষ থেকে সরিয়ে আনার নির্দিষ্ট তথ্য নেই। কিছু তামাক চাষী হয়তো সূর্যমুখী চাষ করেছেন। আবার সূর্যমূখীর চাষ দেখে তামাক চাষীরাও সূর্যমূখীর চাষে এগিয়ে আসবেন বলে তিনি আশাবাদী। তার উপজেলায় এবার ৩৪০ জন কৃষকের মাধ্যমে ৪০০ বিঘা জমিতে সূর্যমুখী চাষ হয়েছে।

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলায় কৃষি কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রশীদ বলেন, যে কোনো ফসল চাষে প্রতিযোগিতায় আসতে হবে। তামাক একটি ক্যাশ এবং নিরকোটিক ক্রোপ। এই অঞ্চলে অন্য ফসল চাষে লাভ বেশি। সব রকম জমিতে সূর্যমুখীর চাষ হয়। সব দিক থেকে তামাকের চেয়ে অনেক খরচ কম হয় ভুট্টা,সূর্যমুখীর মতো ফসলে। ফুলবাড়ি উপজেলায় ৫০০ বিঘা জমিতে সূর্যমুখীর চাষ হয়েছে। প্রতি বিঘায় ১২ মণের বেশি বীজ পাওয়া যায়। সূর্যমুখি চাষে তামাকের মতো হেল্থ হ্যাজার্ড নাই। দুই ফসলি জমিতে চাষ করলে, ওটা তিন ফসলি জমি হবে। এক কেজি সূর্যমুখীর বীজের বাজার মূল্য ১ হাজার ৫০০ টাকা। এক কেজি বীজ দিয়ে দুই বিঘা জমি চাষ করা যায়। বালারহাট নভরত্নে একই স্থানে ১০০ বিঘা জমিতে সূর্যমুখীর চাষ হয়েছে।

অদূর ভবিষ্যতে যদিও এইসব অঞ্চলে তামাক চাষ কমানো সম্ভব হলে তবেই কিছুটা সুফল পাওয়া যাবে। এসব অঞ্চলে কবে কমবে তা বলা না গেলেও, তামাক চাষ ধীরে ধীরে বড় বড় চরাঞ্চল এবং পাহাড় এলাকায় ছড়াবে বলে দায়িত্বশীল একটি সুত্র জোড় দাবি করছে।

আরও পড়ুন: এই মৌসুমে তামাক চাষ বন্ধে পদক্ষেপ নেয়ার এখনই সময়

ঢাকা/আমিনুল

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়