ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

‘আমি নিশ্চিত, আমার ব্রেইন হ্যাক করেছে তারা’

তারেকুর রহমান, কক্সবাজার  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:২৩, ৩ ডিসেম্বর ২০২১   আপডেট: ২১:০০, ৩ ডিসেম্বর ২০২১

‘চিকিৎসক, প্রশাসন ও পাড়া প্রতিবেশী আমাকে সিজোফ্রিনি কিংবা মেন্টাল বললেও আমি নিশ্চিত, আমার ব্রেইন হ্যাক করেছে তারা। এমআরআই পরীক্ষায় আমার মাথায় নিউরো চিপ শনাক্ত হয়েছে। আমার ব্রেইন হ্যাক করেছে হ্যাকাররা। তাদের দাবিকৃত অর্থ না দিলে মুছে দেওয়া হবে আমার মস্তিষ্কের সব স্মৃতি।’— এই অভিযোগ তুলে অঝোরে কাঁদলেন কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার সাবেক ইউপি মেম্বার মো. হারুনুর রশিদ। তিনি কুতুবদিয়া উপজেলার আলী আকবার ডেইল ইউনিয়নের ৩নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য এবং সিকদার পাড়ার বাসিন্দা।

বৃহস্পতিবার (২ ডিসেম্বর) বিকেলে নিজের চিকিৎসার পরামর্শপত্র এবং অভিযোগের কাগজপত্র হাতে নিয়ে হ্যাকার কর্তৃক নিজের সর্বনাশের কথা তুলে ধরেন তিনি।

মো. হারুনুর রশিদের দাবি, বছর তিনেক আগে শ্বশুরবাড়িতে গেলে তার শ্যালিকা আসমা উল হোসনা চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে কিছু একটা খাওয়ালে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। এরপর শ্যালিকাসহ হ্যাকার চক্র তার মাথায় ইনজেকশন পুশ করে একটি ছোট ইলেকট্রিক যন্ত্র (কম্পিউটার ডিভাইস) বা নিউরো চিপ স্থাপন করে তার বিপুল অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতিনিয়ত তাকে সাইবার নির্যাতন করছে।

এ ব্যাপারে রাইজিংবিডির কয়েকটি প্রশ্নের সম্মুখীন হন ভুক্তভোগী মো. হারুনুর রশিদ—

ব্রেইন হ্যাক হয়েছে এটা কীভাবে বুঝলেন— এমন প্রশ্নের জবাবে হারুন বলেন, ‘ঘুম থেকে উঠে আমার অবস্থা ব্যতিক্রম হয়েছিল। আমার মধ্যে আমি ছিলাম না। পরে খেয়াল করি আমার মাথায় হালকা চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। মাথায় হাত দিয়ে হালকা রক্তপিণ্ডের মতো কিছু দেখতে পাই। এরপরই আমার শ্যালিকা আসমা উল হোসনাকে মাথা দেখিয়ে কী হয়েছে দেখতে বললে সে ঠাট্টাভাবে বলে দেয় পোকার কামড়ে হয়তো রক্ত বের হয়েছে। এর পরদিন থেকে আমি একজন খুব পরিচিত কণ্ঠের গায়েবি আওয়াজ শুনতে পাই। ওই আওয়াজে আমাকে গালিগালাজ করা হচ্ছিলো। পরে দেখি আমার ফেসবুক এলোমেলোভাবে চলছে। আমার ব্যবহৃত আইফোনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডাউনলোড হচ্ছে কয়েকটি গেমস। এমনকি কয়েক দফায় আমার ব্যাংক হিসাব থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ গায়েব হয়ে যায়। এরপর ক্রমাগতভাবে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি এবং বুঝতে পারি আমার ব্রেইন হ্যাক করা হয়েছে।’ 

কথিত ব্রেইন হ্যাক হওয়ার আগে যে চিন্তা-ভাবনা ছিল ব্রেইন হ্যাক হওয়ার পর সেই চিন্তা-ভাবনা পাল্টে গেছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মানুষজন চিনতে পারলেও আমার সব চিন্তা-ভাবনা এলোমেলো হয়ে গেছে। কোনো অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন হাতে নিলে শরীর হালকা কেঁপে ওঠে। আমার হাতের স্পর্শের পরপরই ফোনে আপনা-আপনি পাবজি গেমসসহ ৪-৫টি অপরিচিত গেমস ডাউনলোড হয়ে যায়। আমার হাত দিয়ে স্পর্শ করা স্মার্টফোনটি মুহূর্তেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির বা ডিভাইসের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এতে ফোনে থাকা যাবতীয় ডকুমেন্ট ও সব ধরনের তথ্য সহজে হ্যাকাররা পেয়ে যাচ্ছে।’  

কারা তার ব্রেইন হ্যাক করেছে— এমন প্রশ্নের জবাবে মো. হারুনুর রশিদ বলেন, ‘কুতুবদিয়া উপজেলার বাসিন্দা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া আতিকুর রহমান নামের এক শিক্ষার্থী আমার শ্যালিকা আসমা উল হোসনার সহযোগিতায় মাথায় ওই চিপ স্থাপন করে আমার ব্রেইন হ্যাক করেছেন এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ক্লোন করে প্রায় ২০ লাখের বেশি টাকা উত্তোলন করে ফেলেছেন।’ 

নিউরো চিপ বসানোর জন্য অপারেশ করতে হয় যেটা বাংলাদেশ কিংবা বিশ্বের কোথাও এখনও পর্যন্ত এমন বিষয় শোনা যায়নি। কিন্তু হাসপাতাল ও উন্নত যন্ত্রপাতি ছাড়া কীভাবে মাথায় নিউরো চিপ স্থাপন সম্ভব— এই প্রশ্নের উত্তরে হারুনুর রশিদ নির্বিঘ্নে বলেন, ‘অনেক মুভিতে দেখেছি এভাবে মাথায় নিউরো চিপ স্থাপন করে অন্যজনের ব্রেইন হ্যাকের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার ধন-সম্পদ হাতিয়ে নেয়, তখন তো কোনো হাসপাতাল কিংবা উন্নত যন্ত্রপাতি দেখা যায় না। এটা স্থাপন করতে তেমন বড় অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে না হ্যাকারদের। ডিজিটাল ও তাদের হ্যাকিং পদ্ধতি অবলম্বন করে তারা অপারেশন ছাড়াই নিউরো চিপ স্থাপন করতে পারে।’  

আরও অনেকের প্রতিনিয়ত হ্যাকার দ্বারা ব্রেইন হ্যাকের শিকার হচ্ছেন— এমন দাবি করে হারুনুর রশিদ বলেন, ‘আমার মতো কক্সবাজার জেলায় আরও দুইজন ব্রেইন হ্যাকের শিকার হয়েছেন। একজন কুতুবদিয়া উপজেলায়, আরেকজন সদর উপজেলায়। তারাও আইনের আশ্রয় নিয়েছে। সেই কাগজপত্র আমার কাছে রয়েছে।’ 

তাবে তাদের নাম প্রকাশ না করতে ইচ্ছুক তিনি। পরে ভুক্তভোগীদের অনুমতি সাপেক্ষে প্রকাশ করতে পারবেন বলে জানান।

হারুনুর রশিদ অভিযোগ করে বলেন, ‘মাথার ব্রেইন হ্যাকার বিদেশি চক্র বাংলাদেশে রয়েছে। তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে দেশীয় কিছু হ্যাকার। যারা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে চিপ (ক্ষুদ্র কম্পিউটার ডিভাইস) টার্গেট করা ব্যক্তিদের শরীরে স্থাপন করে এবং যাবতীয় তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি অর্থও লুটে নিচ্ছে। আমার ব্রেইন হ্যাকার আতিকুর রহমান ওই দলের একজন।’ 

আতিকের মাথায়ও এমন নিউরো চিপ রয়েছে দাবি করে হারুন বলেন, ‘হ্যাকারদের সঙ্গে ব্রেইন টু ব্রেইন কথা বলতে সক্ষম হচ্ছেন আতিক। তাদের মধ্যে নিয়মিত কথাও হচ্ছে। তাই আমার প্রত্যেকটি কথা শোনার পাশাপাশি আমার গতিবিধি নজরদারি এবং দৈনন্দিন সব কার্যক্রম সম্পর্ক জানতে পারছেন তারা। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমার মস্তিষ্ক থেকে সব স্মৃতি মুছে ফেলার হুমকিও দিচ্ছে তারা।’   

এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে আতিকুর রহমান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হলেও এত এক্সপার্ট নই।’ কোনো হ্যাকার চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগও নাকচ করেন তিনি।

এই অভিযোগে সন্দেহভাজন দুইজনকে অভিযুক্ত করে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) এবং সাইবার ট্রাইব্যুলে মামলাও করেছেন মো. হারুনর রশিদ। যদিও জিডি এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তারাও ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন ‘কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং’ বলে উল্লেখ করছেন।

হারুন বলেন, তার এমআরআই পরীক্ষা চট্টগ্রামের এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেডে করেছেন এবং সেই পরীক্ষায় মাথায় ডিভাইস শনাক্ত হয়েছে। চিকিৎসা করার পরও এর কোনো সমাধান নেই বলে জানান তিনি। বরং চিকিৎসকরাও মেন্টাল বলে তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। 

থানায় জিডির পাশাপাশি ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছেন জানিয়ে হারুন দাবি করেন, প্রথমে মামলাটি ভুয়া ও হাস্যকর উল্লেখ করে নিতে চাননি আদালত। পরে হারুনের কথা শোনার পর মামলাটি গ্রহণ করে পুলিশের ঢাকার গোয়েন্দা বিভাগকে (ডিবি) তদন্তের ভার দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন: ব্রেইন হ্যাক করার অভিযোগে মামলা, তদন্তে ডিবি

এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. শামীম বলেন, ‘বাদীর ফোন ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য পাঠানোর আগমুহূর্তে লস মুডে চলে যায়। বিবাদীর একটি মোবাইল সেট জব্দ করা হয়েছিল, ফোনে তেমন কিছুই না পাওয়ায় মামলাটি নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়া যায়নি। তবে ভিকটিমের মাথায় যেহেতু এখন নিউরো চিপের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ভিকটিম হারুন চাইলে মামলাটি আবার পুনরুজ্জীবিত করতে পারেন।’

ব্রেইন হ্যাকের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ শামশুল ইসলাম খান বলেন, ‘ব্রেইন হ্যাকের বিষয়টি অবিশ্বাস্য এবং হলিউড-বলিউডের মুভির কোনো গল্পের মতোই মনে হচ্ছে।’

/বকুল/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়