ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

সব ক’টা জানালা খুলে আজও অপেক্ষায় আনোয়ারা বেগম 

মাগুরা প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৫০, ১৬ ডিসেম্বর ২০২১   আপডেট: ২১:২৩, ১৬ ডিসেম্বর ২০২১

গভীর রাতে এখনো দরজার ঠক্ঠক্ শব্দ কানে বাজে। আনোয়ারা বেগমের (৭৫) ঘুম ভেঙে যায়। তিনি চমকে ওঠেন। দ্রুত হাতে দরজা খুলে দেন। কিন্তু রাতের শূন্যতা তাকে ঘিরে ধরে। দরজার ওপাশে কোথাও কেউ নেই!

গত ৫০ বছর স্বামীর জন্য অপেক্ষা করে আছেন আনোয়ারা বেগম। কিন্তু কেন এই অপেক্ষা, যেখানে তিনি নিজেই জানেন প্রাণের মানুষটির ফেরার আর কোনো উপায় নেই। সেখানে গেলে কেউ ফিরে আসে না, আসা যায় না।

১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার দীঘা ইউনিয়নের পাল্লা গ্রামের হাবিবুর রহমান মোহাম্মদ এবং তার ছোট ভাই আহম্মদ হোসেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই যুদ্ধ ‘মহম্মদপুর যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।

আনোয়ারা বেগমের স্বামী মোহাম্মদ ও দেবর আহম্মদ একই দিনে শহীদ হন। তিন ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে অকূল পাথারে পড়েন তিনি। বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমানের বয়স তখন মাত্র দশ। এ ঘটনার পর সন্তানদের জীবন বাঁচাতে স্বামীর ঘর ছাড়েন তিনি। কারণ এলাকায় সবাই জানতো যুদ্ধে গেছেন তাঁর স্বামী। তিনি মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী। এ কারণে তাঁর ভয় ছিল অন্যদের তুলনায় বেশি। তিনি ফরিদপুর মধুখালী বাবার বাড়ি চলে যান। বাবার বাড়ি থেকে নতুন করে জীবন শুরু করার চাপ ছিল। তিনি শহীদ স্বামী ও তিন সন্তানের দিকে তাকিয়ে সে পথে হাঁটেননি। তাঁর বিশ্বাস- স্বামী একদিন ফিরে আসবে।

জীবনযুদ্ধে পর্যুদস্ত আনোয়ারা বেগম শ্রবণ শক্তি হারিয়েছেন। বয়সের ভারে ন্যুজ। গুছিয়ে কথা বলতে পারেন না। চোখেও এখন কম দেখেন। শরীরে বাসা বেঁধেছে নানান অসুখ। এখন আর জীবনে কোনো চাওয়া নেই। মৃত্যর আগে লাল-সবুজ রঙের ‘বীর নিবাস’-এ  বসবাস করবেন এই হলো সাধ।

হাবিবুর রহমান মোহাম্মদ ঝিনাইদহের সাগান্না প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। আহম্মদ হোসেন স্থানীয় পাল্লা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক দুই ভাই বাড়ির অদূরে পাল্লা মীরপাড়ায় ক্যাম্প তৈরি করে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন।

মাগুরায় রণাঙ্গণের বীরযোদ্ধা তোজাম্মেল হোসেন। তাঁর কণ্ঠে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের সেই স্মৃতিজাগানিয়া রোমহর্ষক মহম্মদপুর যুদ্ধের কথা। তিনি বলেন, মহম্মদপুর উপজেলা সদরের তৎকালীন টিটিডিসি হলে পাকসেনারা (উপজেলা পরিষদ ভবন) রাজাকার, পীচ কমিটির সদস্য এবং ওয়েস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর (ডব্লিউপিআর) রেঞ্জার্স ফোর্সের সমন্বয়ে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলে। এই ঘাঁটিতে অপারেশন চালানোর জন্য মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুতি নিতে থাকে।

১৯ নভেম্বর ১৯৭১। ঈদুল ফিতরের আগের দিন; শুক্রবার। রাত আনুমানিক সাড়ে ৯টা। মুক্তিযোদ্ধারা সমবেত হতে শুরু করেন। রেকি করে তিনটি দলে প্রায় ২০০ যোদ্ধা ভাগ হয়ে যাই। অগ্রবর্তী দলের কমান্ডার হিসেবে আমার দলের উপর পড়ে প্রথম আক্রমণের দায়িত্ব। ভোর চারটার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা  ক্যাম্পের চারদিক থেকে অতর্কিতে আক্রমণ করে। 

উভয় পক্ষের মধ্যে দীর্ঘ সময় গুলি বিনিময় চলতে থাকে। রেঞ্জার্স ফোর্স অত্যাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করায় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেয়। এক পর্যায়ে আমাদের চারটি দলের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। সুরক্ষিত কংক্রিটের বাঙ্কার ওরা ভারি অস্ত্রের সাহায্যে গুলি ছুড়তে থাকে। কিন্তু আমাদের সামনে কোনো নিরাপত্তা ব্যুহ ছিল না।

সর্বশেষ চেষ্টা হিসেবে আমার দল নিয়ে টিটিডিসি ভবনের পূর্ব পাশের বেড়িবাঁধের আড়াল থেকে শত্রুকে লক্ষ্য করে গোলা ছুড়তে থাকি। এ সময় মাথায় গুলিবিদ্ধ হন আহম্মদ হোসেন। আমি তাঁকে সরিয়ে এনে সড়কের পাশে মুসল্লীবাড়ির পুকুরের কোণায় আশ্রয় নেই। ততক্ষণে তাঁর রক্তে আমার শরীর প্রায় ভিজে গেছে। কিছুক্ষণ পরেই যুদ্ধে অংশ নেওয়া বড় ভাই মোহাম্মদ হোসেন ভাইকে বাঁচাতে এগিয়ে এসে গুলিবিদ্ধ হন। আমার দুই হাতের উপর শহীদ হন দুই সহোদর।

আহম্মদ-মোহাম্মদের মৃতদেহ একপর্যায়ে পুকুরের পানিতে পড়ে যায়। ওদিকে আক্রমণের তীব্রতা বাড়তে থাকলে আমরা পিছু হটতে থাকি। পরে রাজাকাররা শহিদ দুই ভাইয়ের লাশ নিয়ে উল্লাস করতে থাকে। মৃতদেহকেও তারা সেদিন নিস্তার দেয়নি, নানাভাবে অপমানিত করে।

ঈদের দিন সকালে বাড়ির উঠানে একসঙ্গে দুই ছেলেসহ তিনজনের লাশ এনে রাখা হয়। তাঁদের বাবা আফসার উদ্দিন নির্বাক হয়ে পড়েন। সেদিন গলা ছেড়ে কান্নার সুযোগও ছিল না। পাকসেনাদের ভয়ে তড়িঘড়ি গোপনে বাড়ির অদূরে নাগড়ীপাড়া কবরস্থানে তিনজনকে সমাহিত করা হয়। আফসার উদ্দিন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে একসঙ্গে দুই ছেলের আত্মদানের জন্য গর্ব করে গেছেন।

শহিদ মোহাম্মদের বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান জানান, স্বাধীনতার পর ৫০ বছর তারা কষ্ট করেছেন। তাতে দুঃখ নেই। বাবার পরিচয়ে তিনি গর্ববোধ করেন। এখন শুধু চাওয়া মায়ের চিকিৎসার খরচ।

শহিদপুত্রের এটুকু চাওয়া নিশ্চয়ই খুব বেশি নয়?
  
 

শাহীন/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়