ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মামলার অন্যতম সাক্ষী হাফেজ মো. আমিনের বক্তব্য

কক্সবাজার প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১০, ৩১ জানুয়ারি ২০২২  
মামলার অন্যতম সাক্ষী হাফেজ মো. আমিনের বক্তব্য

ঘটনাস্থলের পাশে অবস্থিত শামলাপুর লামার বাজার বায়তুন নুর জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মো. আমিন এ মামলার অন্যতম সাক্ষী। আদালতে সাক্ষ্যও দিয়েছেন তিনি।

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানকে গুলি করার শুরু থেকে তিনি ঘটনা প্রত্যক্ষ করছেন। ঘটনার পর ওসি প্রদীপের ঘটনাস্থলে আসা, পা দিয়ে গুলিবিদ্ধ একটি সিনহার গলায় চাপ দেয়া, পিকআপ করে মৃতদেহ হাসপাতালে পাঠানোসহ সব কথা-ই বলেছেন হাফেজ আমিন।

তিনি বলেছেন, ১ আগস্ট ছিলো ঈদুল আজহা। ঈদের জামাত, পশু কোরবানির বিষয়ে কেন্দ্রীয় মসজিদের মাইকিং এর ঘোষণা শুনতে তিনিসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী মসজিদের ছাদে অবস্থান করছিলেন। ওই সময় এপিবিএন এ চেকপোস্টে উচ্চস্বরে কথা শুনলে ওই দিকে দৃষ্টি দেন। ওই সময় দেখা যায়, সিলভার রঙের একটি কার গাড়ির সামনে শামলাপুর ফাঁড়ির ইন্সপেক্টর লিয়াকত পিস্তল তাক করে দাঁড়িয়ে আছেন। পাশে ব্যারিকেড দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন এসআই নন্দ দুলাল। পূর্বে এবং পশ্চিমে ২ জন এপিবিএন সদস্য দাঁড়ানো ছিলেন।

হাফেজ আমিন জানান, তখন লিয়াকত চিৎকার করে গাড়ি থেকে বের হওয়ার নির্দেশ দিলে গাড়ির পশ্চিম পাশ থেকে ২ হাত উপরে তুলে লম্বা চুল থাকা এক যুবক বের হন। লিয়াকতের নির্দেশ পেয়ে এপিবিএন’র ২ সদস্য ওই যুবককে দুই হাত ধরে রাখে। লিয়াকত আবারো চিৎকার দিয়ে গাড়িতে থাকা ব্যক্তিকে বের হওয়ার জন্য বলেন। এরপর গাড়ির ড্রাইভিং সিটে থাকা ব্যক্তি হাত উপরে তুলে গাড়ি থেকে বের হন এবং লিয়াকতের দিকে সামনে একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ান। মুহূর্তেই কোন কথা না বলে লিয়াকত পর পর ২টি গুলি করেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে ওই ব্যক্তি সামনের দিকে হেলে মাটিতে পড়ে গেলেও লিয়াকত সামনে এসে আবারো ২ রাউন্ড গুলি করেন বলে জানান তিনি।

তিনি জানান, গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটে পড়া ব্যক্তিকে লিয়াকতের নির্দেশমতে নন্দ দুলাল হ্যান্ডকাপ পরিয়ে দেন এবং লম্বা চুলের ব্যক্তিকেও জন্য বলা হলে এপিবিএন’র ২ সদস্য তাদের কাছে হ্যান্ডকাপ না থাকার কথা লিয়াকতকে জানান। এতে লিয়াকত ক্ষুব্ধ হয়ে এপিবিএন সদস্যদের গালিগালাজ করেন। এসময় পূর্ব পাশে থাকা এপিবিএন’র অপর সদস্য শামলাপুর লামার বাজার দিকে গিয়ে রশি নিয়ে আসেন এবং চুল লম্বা ব্যক্তির হাত পেছনে দিয়ে বেঁধে বসিয়ে রাখেন।

এরপর মুঠোফোনে লিয়াকত ব্যস্ত হয়ে উঠেন বলে জানিয়ে হাফেজ আমিন জানান, প্রথম ফোনে কাউকে ঘটনাস্থলে আসার জন্য বলেন। এরপর অপর একজনকে জানান, একজন শেষ অপরজন আটক রয়েছে। তার অল্প সময়ের মধ্যে সিভিল পোশাকে চার জন ব্যক্তি সিএনজি যোগে ঘটনাস্থলে আসেন। এসময় টেকনাফ থেকে আসা মিনি পিকআপ শামলাপুর বাজারে যাওয়ার সময় আটকে এপিবিএন’র চেকপোস্টে এনে রাখা হয়। এরপর কার গাড়ি তল্লাশি চালান সিভিল পোশাকে আসা চার জনের দু’জন। তল্লাশি শেষে তারা একটি পিস্তল, কিছু কাগজপত্র এবং ক্যামেরা পাওয়ার কথা লিয়াকতকে জানান। এরপর পরই টেকনাফ থেকে দুটি গাড়ি যোগে ঘটনাস্থলে আসেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নেতৃত্বে পুলিশ।

ওসি প্রদীপ যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছেন তখনও গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি জীবিত ছিলেন বলে জানান আমিন। জানান, প্রদীপ ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রথমে লিয়াকতের সাথে কোন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। তারপর ‘তোকে অনেক দিনের টার্গেট ছিলো, আজ শেষ করতে পেরেছি’ বলতে বলতে এগিয়ে যান গুলিবিদ্ধ ব্যক্তির দিকে। গিয়ে প্রদীপ পা দিয়ে ওই ব্যক্তিকে চাপ দেন। এসময় ওই ব্যক্তি কিছু একটা বললে প্রদীপ বলেন ‘তোকে গুলি করেছি কি পানি দেয়ার জন্য? মেরে ফেলার জন্য মারা হয়েছে।’ এরপর ওই ব্যক্তির বাম পাশে জোরে জোরে দুইটি  লাথি মারেন এবং পা দিয়ে গলায় আবারো চাপ দিয়ে রাখেন প্রদীপ। এরপরই ফোনে কারো সাথে কথা বলেন প্রদীপ। কথা শেষ করে বলেন, সাগর-রুবেল গাড়ি তল্লাশি করো। দু’জন এগিয়ে গাড়ির পাশে এসে একজন জানান, স্যার গাঁজা-ইয়াবা পাওয়া গেছে। এরপর চার জন এসে মাটিতে লুটে থাকা ব্যক্তিকে হাত-পা ধরে মিনি পিকআপে খুব জোরে ছুড়ে দেন। পিকআপটি কক্সবাজারের দিকে চলে যায়।

এদিকে ২০২০ সালের ৬ আগস্ট প্রধান আসামি লিয়াকত আলী ও টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ৭ পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।

মামলায় প্রথমে গ্রেপ্তার হওয়া ১৪ আসামিকে র্যাবের তদন্তকারী কর্মকর্তা বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এদের মধ্যে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা ছাড়া ১২ জন আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা নিজেদের দোষ স্বীকার করে আদালতের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে।

গত ২৪ জুন মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি কনস্টেবল সাগর দেব আদালতে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আলোচিত এই মামলার ১৫ আসামির সবাই আইনের আওতায় আসে।

মামলায় কারাগারে থাকা ১৫ আসামি হলেন— বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, রুবেল শর্মা, টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাগর দেব, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ, পুলিশের করা মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নিজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।

২৭ জুন (রোববার) ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৩০২/২০১/১০৯/ ১১৪/১২০-খ/ ৩৪ ধারায় সকল আসামির উপস্থিতিতে কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালত মামলার অভিযোগ গঠন করেন। এছাড়া, ছয় আসামির পক্ষে আদালতে জামিন চাওয়া হলে আদালত তা নামঞ্জুর করেন। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি অ্যাড. ফরিদুল আলম মামলাটির চার্জ গঠনের শুনানি করেন।

চার্জ গঠন করে ২৬ জুলাই থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত একটানা ৩ দিন মামলাটির চার্জশিটভুক্ত প্রথম ১০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করে আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে লকডাউনের কারণে হাইকোর্টের নির্দেশে সারাদেশের মতো কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে স্বাভাবিক কার্যক্রম না চলায় নির্ধারিত ধার্য দিনে সাক্ষ্য গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন মামলাটির রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এবং কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) অ্যাড. ফরিদুল আলম।

তিনি জানান, এ মামলায় ৮৩ জন চার্জশিটভুক্ত সাক্ষী রয়েছে। আদালতে স্বাভাবিক কার্যক্রম চললে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণসহ অন্যান্য আইনি কার্যক্রমও স্বাভাবিক নিয়মে চলবে। বিচারকাজ শুরুর অন্যান্য কাজ এগিয়ে রয়েছে। আদালত খুললে এই মামলার কাজও শুরু হবে।

এদিকে, সিনহা হত্যা মামলাটি বেআইনি ও অবৈধ দাবি করে ৪ অক্টোবর মামলার প্রধান আসামি লিয়াকতের আইনজীবী মাসুদ সালাহ উদ্দিন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। কিন্তু ওই মামলার বিশেষ কোনো অগ্রগতি এখনও পর্যন্ত লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

তারকুল/এনএইচ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়