ঢাকা     বুধবার   ০৪ অক্টোবর ২০২৩ ||  আশ্বিন ১৯ ১৪৩০

সিডরের ১৫ বছর: শেষ হয়নি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ

আলী আকবর টুটুল, বাগেরহাট || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৫, ১৫ নভেম্বর ২০২২   আপডেট: ১৪:২৪, ১৫ নভেম্বর ২০২২
সিডরের ১৫ বছর: শেষ হয়নি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের কাজ

সুপার সাইক্লোন সিডরের পরবর্তী উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের বাসিন্দাদের অন্যতম একটি দাবি ছিলো টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের। তাদের সেই দাবি মেনে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হলেও সাত বছরে তা শেষ হয়নি। বরং বাঁধের অনেকাংশই নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। 

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, নদী শাসন ছাড়া শুধু বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত করে ভাঙনের প্রতিকার মিলবে না। 

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় সিডর। রাতেই লন্ডভন্ড হয়ে যায় উপকূল। ভোরের আলো ফুটতে দৃশ্যমান হতে থাকে তাণ্ডবের চিত্র। বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় পড়ে পুরো জেলা। এই ঝড়ে বাগেরহাট জেলায় ৯০৮ জন মানুষের মৃত্যু হয়।

সরকারি হিসেবে সিডরে বাগেরহাট জেলায় নিহত এবং আহত হয়েছিলেন ১১ হাজার ৪২৮ জন। সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয় ৬৩ হাজার ৬০০ বাড়িঘর। আংশিকভাবে বিধ্বস্ত বাড়িঘরের সংখ্যা ১ লাখ ৬ হাজার। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয় পাকা ৫ কিলোমিটার সড়ক, কাঁচা সড়ক ধ্বংস হয় প্রায় ৫০ কিলোমিটার এলাকার। আর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয় সাড়ে ১৬ কিলোমিটার বাঁধ। মারা যায় ১৭ হাজার ৪২৩টি গবাদি পশু। বিনষ্ট হয় ১২ হাজার হেক্টর ক্ষেতের ফসল ও ৮ হাজার ৮৮৯ হেক্টর চিংড়ি ঘের। 

ঝড়ের পর স্বজন হারানোর বেদনা ও আর্থিক ক্ষতি ভুলে উপকূলবাসীর একমাত্র দাবি ছিল টেকসই বেড়িবাঁধ। সিডরের ১৫ বছরেও জেলার শরণখোলা বাসীর প্রাণের দাবি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ এখনো শেষ হয়নি। 

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সরকার ২০১৬ সালে ২৬ জানুয়ারি ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের (সিইআইপি) অধীনে মোরেলগঞ্জ থেকে শরণখোলা উপজেলার বগী-গাবতলা পর্যন্ত ৬২ কিলোমিটার টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ শুরু হয়। বেড়িবাঁধের প্রায় ৬০ কিলোমিটার কাজ সম্পন্ন হলেও অরক্ষিত রয়ে গেছে সাউথখালী ইউনিয়নের গাবতলা, আশার আলো মসজিদ থেকে বগী ও  তেরাবাকা-শরণখোলা পর্যন্ত দুই কিলোমিটার এলাকা। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঠিকাদার পরবর্তী সময়ে আরো তিন দফা সময় বাড়িয়েছেন। সর্বশেষ বর্ধিত মেয়াদ অনুয়ায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বাঁধ হস্তান্তরের কথা রয়েছে।

সম্প্রতি উপকূলে দুর্যোগ না থাকলেও বাঁধ নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। নদী শাসন ছাড়া শুধু বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত করে ভাঙনের প্রতিকার মিলবে না বলে দাবি স্থানীয়দের। 

এদিকে বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে। এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মাণাধীন ৩৫/১ পোল্ডারের বেড়ি বাঁধে পর্যাপ্ত স্লুইসগেট নির্মাণ না করে অপরিকল্পিতভাবে ছোট করে অল্প সংখ স্লুইজ গেট নির্মাণের কারণে বৃষ্টি বা জোয়ারের পানি নিষ্কাশন হয় না ঠিকমত। 

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, একটু ভারি বৃষ্টি হলেই কয়েকদিন পানিবন্দী হয়ে পড়তে হয় তাদের। পানি নামার ব্যবস্থা না থাকায় গত ২৭ জুলাই বৃষ্টির পানিতে ৭ দিন পানিবন্দী ছিল উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ। পানিতে নিমজ্জিত ছিল আমনের বীজতলা। একসপ্তাহ পরেও পানি না নামায়, বাঁধ কেটে দেয় ক্ষুব্ধ জনতা।

স্থানীয় সিদ্দিক ফকির নামের এক ব্যক্তি বলেন, সিডরের পর থেকে আমাদের একমাত্র দাবি ছিল টেকসই বেড়িবাঁধ ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ। কিন্তু এখানো বেড়িবাঁধ নির্মাণ শেষ হয়নি। প্রতিবছরই ঝড়ে আমাদের জান মালের ক্ষতি হয়। 

চলতি বছরের ১১ মে দুপুরে শরণখোলা উপজেলার গাবতলা বাজার সংলগ্ন বেড়িবাঁধের মাঝে ১৫-২০ ফুট লম্বা ফাটল দেখা যায়। এর আগে, ফেটে যাওয়া এলাকায় বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা গাবতলা গ্রামের ছফেদ খানের ১০ কাঠা জমি গাছপালাসহ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় বলেও জানান তিনি।

ছফেদ খান বলেন, বেড়িবাঁধের বাইরে আমার এক বিঘা (৬৫ শতক) জমি ছিল। হঠাৎ করে ১০ কাঠা জমি দেবে যায়। পরবর্তীতে সেই জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়। বাকি জমিতেও ফাটল রয়েছে। যে কোনো সময় নদীতে জমির ওই অংশটুকু বিলীন হবে। এভাবে বাপ-দাদার অনেক জমি হারিয়েছি আমরা। নির্মাণাধীন বাঁধে মাটি না দিয়ে বালু দেওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

সাউথখালী ইউনিয়ন ৭ ওয়ার্ডের বাসিন্দা রিয়াদুল পঞ্চায়েত বলেন, আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল নদী শাসন করে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের। কিন্তু নদী শাসন না করেই বাঁধ নির্মাণ হওয়াতে ঝুঁকি হ্রাস পায়নি। নদী শাসন না করে নির্মিত বাঁধ বড় কোনো দুর্যোগে আবারও স্থানীয়দের জীবন-জীবিকা সংকটে ফেলবে। 

নদী শাসন করে বাঁধ নির্মাণের দাবীতে ১৫ নভেম্বর সিডর দিবসে বলেশ্বর নদীর তীরে স্থানীয়রা মানববন্ধন করবে বলে জানিয়েছেন একই ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জাকির হোসেন। 

শরনখোলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রায়হান উদ্দিন শান্ত বলেন, সিডর বিধ্বস্ত মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বর্তমান সরকার ব্যাপক কাজ করেছে। কিন্তু টেকসই বেড়িবাঁধের নামে যে বাঁধ হয়েছে তা পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা হয়নি। পর্যাপ্ত স্লুইজ গেট না থাকায় এই এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। সম্পন্ন হওয়া বাঁধে আরও স্লুইজ গেইট নির্মাণ এবং অসম্পূর্ণ যে বাঁধ রয়েছে সেই বাঁধ দ্রুত নির্মানের দাবি জানাচ্ছি আমি।

উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের (সিআইপি) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সময় নদীর গতি-প্রকৃতি যেভাবে ছিল, সেভাবে জরিপ করে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু নদী গতিপথ পরিবর্তনের কারণে বাঁধে ভাঙন দেখা দিতে পারে।

মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়